এডিটর’স কলাম I শ্রমের সম্মান
জীবিকার জন্য নানাবিধ কাজ করতে হয় মানুষকে। সবাই যে যোগ্যতা মোতাবেক কাজ পান, তা নয়। আর যে কাজই করুন, তার যথাযোগ্য পারিশ্রমিক সব ক্ষেত্রে মেলে না
কেতাবি নাম ‘আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস’। ‘মে দিবস’ নামেই অধিক খ্যাত। বলছি পয়লা মের কথা। দুনিয়াজুড়ে প্রতিবছর পালিত হয়। শ্রমিক আন্দোলনের দীর্ঘ পুঞ্জীভূত সংগ্রাম এবং তার অর্জন স্মরণ করিয়ে দিতে। ইতিহাস বলে, উন্নত কর্মপরিবেশ, ন্যায্য পারিশ্রমিক এবং সংগঠিত হওয়ার অধিকার আদায়ের জন্য শ্রমিকেরা দীর্ঘকাল ধরে লড়াই করে এসেছিলেন। পাশাপাশি উন্নত চিকিৎসার দাবি তুলে ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ দিকে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের শ্রমজীবীরা তুমুল বিক্ষোভ ও ধর্মঘটে অংশ নেন। দৈনিক ৮ ঘণ্টা শ্রমের দাবিতে যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো শহরের হে মার্কেটে ১৮৮৬ সালের ৪ মে আন্দোলনরত শ্রমিকদের ওপর গুলিবর্ষণের ঘটনা ঘটে। প্রাণ হারান বেশ কয়েকজন। এ ঘটনার রেশ ছড়িয়ে পড়ে দুনিয়াময়। শ্রমিকদের ন্যায্য অধিকারের দাবি আরও সুতীব্র হয়ে ওঠে। এর পরিপ্রেক্ষিতে ১৮৮৯ সালে ইন্টারন্যাশনাল ফেডারেশন অব সোশ্যালিস্ট গ্রুপস ও ট্রেড ইউনিয়নস যৌথভাবে ১ মে আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস পালনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। এর পরের বছর থেকে দিবসটি ফিরে ফিরে আসে নিজস্ব তাৎপর্য নিয়ে।
দুই
জীবিকার জন্য নানাবিধ কাজ করতে হয় মানুষকে। সবাই যে যোগ্যতা মোতাবেক কাজ পান, তা নয়। আর যে কাজই করুন, তার যথাযোগ্য পারিশ্রমিক সব ক্ষেত্রে মেলে না; তা বলাই বাহুল্য। বিশেষ করে সবচেয়ে শ্রমসাধ্য কাজ ও নিম্নআয়ের কর্মীদের বেলায় প্রায়ই কম-বেশি বৈষম্য পরিলক্ষিত হয়। কখনো কখনো তা মাত্রা ছাড়িয়ে যায়। অথচ শ্রমিক যদি শ্রমের ন্যূনতম ন্যায্য মজুরি না পান, এর নেতিবাচক প্রভাব শুধু তার জীবনেই পড়ে না, শ্রমকেও প্রভাবিত করে। উৎপাদন মান খারাপ হয়ে ওঠার শঙ্কা তৈরি হয়। অন্যদিকে, মজুরি নিয়ে শ্রমিকের মধ্যে সন্তুষ্টি তৈরি হলে ইতিবাচক প্রভাব পড়ে তার কাজে।
তিন
এ দেশের শ্রমজীবী মানুষের একটি বড় অংশই নিরক্ষর কিংবা স্বল্পশিক্ষিত। নিজেদের অধিকার সম্পর্কে তাদের অনেকের সম্যক ধারণা নেই। যারা এ ধারণা রাখেন, তারা অন্যদের মধ্যে তা ছড়িয়ে দেওয়ার মাধ্যমে রাখতে পারেন ভূমিকা। তাহলে সামাজিক তথা রাষ্ট্রীয় কর্মপরিবেশ আরও ন্যায়সংগত হয়ে উঠবে। ইন্টারন্যাশনাল লেবার অর্গানাইজেশন প্রকাশিত ‘বাংলাদেশের প্রচলিত শ্রম আইন অনুযায়ী অভিযোগ নিরসন ও ব্যবস্থাপনা’ শীর্ষক প্রকাশনা থেকে জানা যায়, এ দেশের আইন মতে, কোনো শ্রমিকের প্রাপ্য মজুরি ও অন্যান্য পাওনা বেআইনিভাবে কাটা হলে কিংবা এ রকম কারণে উত্থিত দাবি শ্রমিক নিজে কিংবা তার দেওয়া ক্ষমতাপ্রাপ্ত হয়ে তার পক্ষে প্রতিষ্ঠানের যৌথ দর-কষাকষি প্রতিনিধি লিখিতভাবে সংশ্লিষ্ট মালিককে জানাতে পারবেন। সেই দাবি জানার পরবর্তী ১০ দিনের মধ্যে তা নিষ্পত্তির ব্যবস্থা নিতে হবে মালিককে। আইনে আরও রয়েছে, ‘১০ দিনের মধ্যে মালিক বিষয়টি সমাধান করতে না পারলে আবেদনকারী ব্যক্তি বা পক্ষ বিষয়টির নিষ্পত্তিকল্পে বাংলাদেশ শ্রম আইন, ২০০৬-এর ধারা ১২৪(ক) অনুযায়ী মহাপরিদর্শক বা তৎকর্তৃক ক্ষমতাপ্রাপ্ত পরিদর্শকের কাছে মীমাংসার মাধ্যমে উক্ত পাওনা আদায়ের জন্য আবেদন করতে পারবেন এবং এ ক্ষেত্রে মহাপরিদর্শক বা তৎকর্তৃক ক্ষমতাপ্রাপ্ত পরিদর্শক বিষয়টি সর্বোচ্চ ২০ দিনের মধ্যে নিষ্পত্তি করবেন।’ আরও বলা হয়, ‘উপরোক্ত মীমাংসা কার্যক্রম সমাপ্তির পর মীমাংসার সিদ্ধান্ত প্রতিপালনে কোনো পক্ষ বা উভয় পক্ষ সম্মত না হলে সংশ্লিষ্ট পক্ষ বা উভয় পক্ষ বিষয়টি মীমাংসার জন্য শ্রম আদালতে মামলা করতে পারবেন।’ তা ছাড়া ‘এ ক্ষেত্রে অভিযোগ আনয়নকারী ব্যক্তি বা শ্রমিক মীমাংসা কার্যক্রম অনুসরণ করতে না চাইলে মীমাংসার আবেদন না করে সরাসরি শ্রম আদালতে বিষয়টি নিষ্পত্তির জন্য বা তার অধিকার প্রয়োগের জন্য দরখাস্ত করতে পারবেন।’
চার
আইনি মারপ্যাঁচ তো চূড়ান্ত ধাপ, অনেকটাই বিরূপ পরিস্থিতির সমাধান। মানুষ হিসেবে নিয়োগকারী ও নিযুক্তের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক মানবিক ও সুন্দর হওয়া বাঞ্ছনীয়। এ ক্ষেত্রে প্রচলিত মানসিকতার পরিবর্তন জরুরি। এক পক্ষকে যেমন পীড়নকারী চিন্তাভাবনা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে, অপর পক্ষের আচরণও হওয়া চাই সহযোগিতামূলক। তাহলে শ্রমের যথাযোগ্য ব্যবহার ঘটার সম্ভাবনা তৈরি হবে। তা ছাড়া সব শ্রমই যে লিখিত চুক্তির অধীনস্থ, তা-ও নয়। ‘দিন এনে দিন খাওয়া’ অর্থাৎ প্রতিদিনের উপার্জন প্রতিদিন করা ধরনের বেশ কিছু শ্রমও প্রচলিত রয়েছে সমাজে। যেমন রিকশা ও ভ্যান চালানো, পরিযায়ী শ্রমিক হিসেবে কাজ করা ইত্যাদি। এসব ক্ষেত্রেও ন্যায্য পারিশ্রমিক পাওয়া থেকে কোনো শ্রমিক যেন বঞ্চিত না হন, তা খেয়াল রাখা চাই।
পাঁচ
পবিত্র হাদিসে উল্লেখ রয়েছে, মহানবী হজরত মোহাম্মদ (সা.) বলেছেন, ‘তোমরা শ্রমিকের মজুরি পরিশোধ করো তার ঘাম শুকানোর আগেই’ [বায়হাকি, মিশকাত]। আর তা নিশ্চিত করা আমাদের সকলেই নৈতিক দায়িত্ব।
শ্রমের যথাযোগ্য মর্যাদা পাক সকল শ্রমিক। সবার মঙ্গল হোক।