ইভেন্ট I কালার’স ফ্রম দ্য চর
লেখাপড়া না জানা চরের মেয়ে রেশমার হাতের ছোঁয়ায় তৈরি হচ্ছে দারুণ সব ওড়না। সুতি ও সিল্কের মিশেলে এসব ওড়না আধুনিক যেকোনো পোশাকের সঙ্গে মানানসই। পোশাকের প্রতিটি রংকেই যেন তুলে আনা হয়েছে এসব ওড়নায়। নিখুঁত বুননশৈলী আর রঙের আধিক্য যে-কাউকে অনেক উচ্ছ্বসিত করবে। বলা হচ্ছে, ফ্রেন্ডশিপ উদ্যোগে গড়ে ওঠা পোশাকের প্রথম প্রদর্শনী কেন্দ্র ‘কালার’স ফ্রম দ্য চর’-এর কথা। রেশমার মতো এমন অনেক মেয়ের হাতের ছোঁয়ায় তৈরি হচ্ছে ওড়না, স্কার্ফ, তাঁতের শাড়ি ও সালোয়ার-কামিজ। ঢাকার ফ্যাশনপ্রেমীদের কাছে তাদের শিল্পকর্ম তুলে ধরতে এক প্রদর্শনী কেন্দ্র খুলেছে ফ্রেন্ডশিপ। গত ৮ মে রাজধানীর বারিধারার কালাচাঁদপুরে যাত্রা শুরু করলো ‘কালার’স ফ্রম দ্য চর’-এর প্রথম প্রদর্শনী কেন্দ্র। অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন প্রতিষ্ঠানটির এক্সিকিউটিভ ডিরেক্টর রুনা খান এবং কালার’স ফ্রম দ্য চর’-এর অ্যাসিস্ট্যান্ট ডিরেক্টর নাজরা মাহজাবিন সাবেত। রুনা জানান, আমাদের দেশের আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে আছে অনেক প্রতিভা। তাদেরকে আমাদের খুঁজে আনতে হবে, কাজে লাগাতে হবে। এর মাধ্যমে চরাঞ্চলে যেমন সৃষ্টি হচ্ছে কাজের নতুন অধ্যায়, তেমনি সচল হচ্ছে এই অঞ্চলের অর্থনীতির চাকা। আমাদের ফ্যাশনে দিন দিন চাহিদা বাড়ছে হাতে তৈরি পোশাক বা পোশাকের কাজের। এর কারণ স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য। অল্প শিক্ষিত হলেও তাদের কাজ একদম নিখুঁত। বুননের জন্য মূলত সুতি ও সিল্কের সুতা ব্যবহার করা হয়। রং করা, ছাপা, সূচিকর্ম ও কাপড় তৈরির পুরো প্রক্রিয়ায় দেশীয় পদ্ধতি এবং দেশীয় তাঁত ব্যবহার করা হয়। ফ্রেন্ডশিপের ‘কালার’স ফ্রম দ্য চর’ আপাদমস্তক পরিবেশবান্ধব। কাপড় তৈরিতে ব্যবহার করা রঙের পুরোটাই প্রাকৃতিক। কোনো ধরনের ক্ষতিকর রাসায়নিক রঙ এখানে ব্যবহার করা হয় না।
প্রদর্শনীতে স্থান পেয়েছে আমাদের দেশের আরেকটি ঐতিহ্য নৌকা। রুনা জানান, কাঠের তৈরি নৌকা সবাই বানাতে পারে না। খুব ছোট একটি গোষ্ঠী কাজটি করে থাকে। তবে এসব নৌকার দাম বেশি হওয়ায় নদীর পার্শ্ববর্তী এলাকাগুলোতে কমে গেছে এর বিক্রি। তাই নৌকা বানানোর কাজ থেকে নিজেদের গুটিয়ে নিচ্ছেন অনেকে। এখন যেসব নৌকা বানানো হয়, এগুলোর বেশির ভাগ পার হবার বা মাছ ধরার জন্য। আর সেই জায়গাটিও দখল করছে ট্রলার, যা তৈরিতে ব্যবহৃত হচ্ছে কাঠ, লোহা ও টিন। তাই হারিয়ে যেতে বসেছে বাংলার ঐতিহ্যবাহী নামকরা সব নৌকা। তবে এসব নৌকা সংরক্ষণে কাজ করছে ফ্রেন্ডশিপ। শেষ প্রজন্মের কারিগর দিয়ে বানানো হচ্ছে ছোট নৌকা, যা স্থান পাবে এই প্রদর্শনী কেন্দ্রে। আপনার বসবার ঘরটাকে সাজিয়ে তুলবে এসব নৌকা।
গাইবান্ধা কিংবা কুড়িগ্রামের প্রত্যন্ত চরগুলোতে নেই জীবনযাত্রার ন্যূনতম সুবিধা। দুর্গম এই চরগুলোর সুবিধাবঞ্চিত নারীদের কর্মসংস্থান করতে ফ্রেন্ডশিপ সেখানে গড়ে তুলেছে কাপড় বুনন কেন্দ্র। শখানেক সুবিধাবঞ্চিত নারী সেখানে কাপড় বুনছেন বাংলার ঐতিহ্যবাহী তাঁতে। এসব পণ্য প্রদর্শিত হবে ঢাকার এই ‘কালার’স ফ্রম দ্য চর’-এ। প্রদর্শন কেন্দ্রে পাওয়া যাবে হাতে বোনা তাঁতের শাড়ি, সেলাইবিহীন সালোয়ার-কামিজ, স্কার্ফ, ওড়না ও দক্ষ কারুশিল্পীদের তৈরি বাংলার ঐতিহ্যবাহী নৌকাগুলোর ক্ষুদ্র সংস্করণ। গাইবান্ধা ও কুড়িগ্রামের পাঁচটি বুনন কেন্দ্রে এখন প্রায় এক শ মহিলা কাজ করছে। গত এক দশকে এই কাজের জন্য প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে হাজারখানেক মহিলাকে। তাদের সবাই প্রত্যন্ত দুর্গম চর এলাকার বাসিন্দা, হতদরিদ্র কিংবা স্বামী পরিত্যক্ত। অনুষ্ঠানের উদ্বোধনের সময় প্রদর্শন কেন্দ্রে ছিল তাঁতে কাপড় বোনার সম্যক প্রদর্শনী। ছিল কাঠের নৌকার ক্ষুদ্র সংস্করণ তৈরির আয়োজন।
‘কালার’স ফ্রম দ্য চর’ প্রদর্শনী কেন্দ্রের উদ্যোগটি নিয়েছে বেসরকারি এনজিও ফ্রেন্ডশিপ। ২০০২ সালে প্রতিষ্ঠানটি একটি ভাসমান হাসপাতালের উদ্ভাবনী ধারণা দিয়ে তাদের কার্যক্রম শুরু করে। এরপর ফ্রেন্ডশিপ ক্রমাগতভাবে তার স্বতন্ত্র সমন্বিত সামাজিক উন্নয়ন মডেল তৈরি করে প্রত্যন্ত এলাকায় নিয়মিত কাজ করে যাচ্ছে। এসবের মধ্যে রয়েছে স্বাস্থ্য, শিক্ষা, জলবায়ু পরিবর্তন অভিযোজন এবং দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা, সমন্বিত নাগরিকত্ব, স্থায়ী অর্থনৈতিক উন্নয়ন এবং সাংস্কৃতিক সংরক্ষণ।
তৌহিদুল ইসলাম তুষার