ত্বকতত্ত্ব I মাত্রাতিরিক্ততায়
হিতে তখন বিপরীতটাই বেশি ঘটার শঙ্কা বাড়ে। মাইক্রো ট্রেন্ড আর সুন্দরতার অবাস্তব সব মানদণ্ডের সঙ্গে পাল্লা দিতে গিয়ে হারায় সহজাত সৌন্দর্য
এ বছরের শুরুর দিকে ইউএস ফুড অ্যান্ড ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন বরাবর একটি আরজি দাখিল হয়। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক একটি পরীক্ষাগারের করা সেই এক আবেদনেই নড়েচড়ে বসে গোটা রাষ্ট্রের সৌন্দর্যশিল্প। এমন কী ছিল সেই পিটিশনে! যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বেনজয়েল পার-অক্সাইড বিকোনোর প্রক্রিয়ায় রদবদলের জন্য করা হয়েছিল দরখাস্তটি। অ্যাকনে ট্রিটমেন্টের জন্য বহুল ব্যবহৃত এ উপাদান। কিন্তু মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহারে মানবদেহে ক্যানসারের কারণ হয়ে উঠতে সময় নেয় না। ভাবা যায়, এই একটি উপাদান প্রতিবছর প্রায় কোটি মানুষ ব্যবহার করেন বয়ঃসন্ধি থেকে বয়সকালের অ্যাকনে রুখতে। ত্বকে লক্ষণীয় পরিবর্তন আনতে কতশত চেষ্টাই-না করা হয়। কাশ্মীরের পাহাড় থেকে সংগৃহীত সাসটেইনেবলি-মেইড স্নেইল স্লাইম কিংবা সুগভীর সমুদ্র থেকে উত্তোলিত খনিজে তৈরি সানস্ক্রিন—সব জড়ো হয় বাসার এক কোণে রাখা ড্রেসারের ড্রয়ারে। উদ্দেশ্য—সেই আকাঙ্ক্ষিত সৌন্দর্য। তাতেও যদি মন ভরত। এর সঙ্গে আরও জড়ো হতে শুরু করে কোলাজেন বুস্টিং মাশরুম এক্সট্র্যাক্টে তৈরি মাস্ক, গ্রিন টি সিডের নির্যাসে তৈরি অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট রিচ সেরাম, ৮৫ শতাংশ বাম্বু ওয়াটারে তৈরি টোনার, জেড দিয়ে তৈরি পকেট সাইজ ফেস মাসাজার—আরও কত কী! একবার ভাইরাল হলেই হলো, সেই পণ্য কোটি মানুষের বিউটি বক্স অব্দি পৌঁছাতে খুব বেশি সময় নেয় না।
কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার হচ্ছে, জীবন বদলে যাওয়ার মতো ফল তো বাদই, এগুলোর মধ্যে বেশির ভাগের ব্যবহার ত্বকে লক্ষণীয় পরিবর্তন আনতেও ব্যর্থ। তার চেয়েও বড় বিস্ময়ের ব্যাপার হচ্ছে, সৌন্দর্যসচেতনদের সংগ্রহে থাকা এসব স্কিন কেয়ার কালেকশনের একটি বড় অংশ হালের জনপ্রিয় কে-বিউটিভিত্তিক। আকর্ষণীয় প্যাকেজিং আর চোখ কপালে তুলে দেওয়ার মতো সব ফর্মুলেশন দিয়ে যারা বিশ্ব বিউটি ইন্ডাস্ট্রির একটা বড় অংশ দখল করে বসে আছে। পরিণত হয়েছে রোজকার রূপরুটিনের অপরিহার্য অংশে। সোশ্যাল মিডিয়ার কল্যাণে জনপ্রিয় হয়ে ওঠা গ্লাস স্কিনের মতো ট্রেন্ডগুলো প্রেরণা জোগাচ্ছে টেন-স্টেপ বিউটি রুটিনে। সবার মাঝে আবশ্যক করে তুলেছে এসেন্স, টোনার, বুস্টার, শিট মাস্ক আর পিলের মতো প্রোডাক্টগুলোর ব্যবহার। যার আছে, তার আরও চাই। আর এ ধারাই প্রবণতাকে অব্যাহত রাখছে প্রতিনিয়ত।
এখন উচ্চ কর্মক্ষমতাসম্পন্ন, বিজ্ঞানসম্মত ফর্মুলেশন থেকে শুরু করে উদ্ভিদ থেকে নির্যাসিত যুগ পুরোনো আয়ুর্বেদীয় পরিচর্যার ল্যাব-মেইড বিকল্প মিলছে বিলাসী সৌন্দর্যপণ্য হিসেবে। বিকোচ্ছে হাতের নাগালে। বছর কয়েক আগেও সৌন্দর্যপ্রেমীদের উইশ লিস্টে থাকা এসব পণ্য সময়ের তাগিদেই হয়ে উঠেছে স্কিন স্টেপল। প্রতিদিনকার ব্যবহার্য। এর বিপরীত চিত্রেরও দেখা মিলছে। ভিন্ন ভিন্ন ব্যাখ্যা মিলবে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমজুড়ে। নিখুঁত সৌন্দর্য পেতে আরও অর্থবহ উপায়ে ত্বকচর্চার কথা বলা হচ্ছে প্রতিনিয়ত। সৌন্দর্যের দৌড়ে যে কেউই পিছিয়ে থাকতে চান না।
এই যে সৌন্দর্য নিয়ে এত মাতামাতি, সৌন্দর্য-বাণিজ্যের এমন উত্থানেরও কিন্তু নেতিবাচক প্রভাব রয়েছে। ভুল তথ্য প্রায়শ বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে এ বিউটি ইন্ডাস্ট্রিতে। শুধু কি তাই! একটা ভ্রান্ত ধারণা কিংবা উপাত্ত খোদ খরিদ্দারের ত্বকের বারোটা বাজিয়ে দিতে যথেষ্ট। স্কিন কেয়ার ইন্ডাস্ট্রি চিরগতিশীল, ক্রমাগত বিকশিত। কিন্তু ত্বকেরও যে নিজস্ব নিরাময় ক্ষমতা অনেক শক্তিশালী, সেটা অস্বীকারের উপায় নেই। সে ক্ষেত্রে একের ওপর এক মাল্টি-অ্যাকশন প্রোডাক্টে প্রলেপ আসলে ভালোর চেয়ে ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কাটাই বাড়ায়। তখন স্বভাবতই প্রশ্ন জাগতে পারে মনে, ত্বকচর্চার ব্যাপারটা কি সৌন্দর্যসচেতনেরা অতিরিক্ত জটিল করে ফেলেছেন?
ত্বককথন
নিজেকে সুন্দর দেখানোর জন্য কিংবা ত্বক সমস্যা সারাইয়ে যতটুকু দরকার, তার চেয়ে বেশি ব্যবহারের প্রয়োজনীয়তা অনুভূত করায় বিশ্ব বিউটি ইন্ডাস্ট্রি। অনেক বিশেষজ্ঞই দাবি করে থাকেন, মাল্টি-স্টেপ স্কিন কেয়ার রুটিন সবার জন্য মোটেই প্রয়োজনীয় নয়; বরং এতে করে র্যাশ, ব্রেক আউট, মাত্রাতিরিক্ত শুষ্কতা, চুলকানি, জ্বালাপোড়া বাড়াতে পারে। নষ্ট হয়ে যেতে পারে ত্বকের সুরক্ষা দেয়াল। অত্যধিক ত্বকচর্চা পণ্য ব্যবহারে কিংবা ভুল পণ্য বেছে নেওয়ার কারণে। আর এই ঝুঁকি বেড়েই চলছে প্রতিনিয়ত। মূল কারণ, নেটজুড়ে যাচাই-বাছাই ছাড়া সব তথ্যের ছড়াছড়ি। এ ক্ষেত্রে সহজ সমাধান হচ্ছে ত্বকের দিকে সূক্ষ্ম নজর রাখা। ত্বক যদি কিছু পছন্দ না করে, তার পষ্ট জানান দেয় প্রতিক্রিয়ার মাধ্যমে। দেখায় নানা ধরনের লক্ষণ ও উপসর্গ। তাই সংবেদনশীলতা সুস্পষ্ট হলেই বুঝতে হবে, ত্বক রূপরুটিনে ভালো সাড়া দিচ্ছে না। বন্ধ করে দিতে হবে; করতে হবে রদবদল।
উপাদানে উভয়সংকট
হাতের নাগালের সৌন্দর্যপণ্যগুলোতে থাকা শক্তিশালী নানা উপাদানের প্রলোভনও বিপদ ডেকে আনতে পারে। যার যথেচ্ছ ব্যবহারে দেখা দিতে পারে ভয়ংকর সব পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া। সম্প্রতি উপাদানের তালিকা দেখে বিউটি প্রোডাক্ট কেনার প্রবণতা বেড়েছে। এই স্বচ্ছতা নিঃসন্দেহে ইতিবাচক। কিন্তু উপাদানগুলো নিয়ে অপর্যাপ্ত জ্ঞান ত্বকে অযাচিত প্রভাব ফেলতে পারে। পণ্যে থাকা একাধিক উপাদানের সুবিধা ও অসুবিধা জানা ছাড়াও পরস্পরের ওপর প্রতিক্রিয়া সম্পর্কেও স্বচ্ছ জ্ঞান থাকা জরুরি। রেটিনলের কথাই ধরা যাক। ভিটামিন এ থেকে প্রাপ্ত এই জনপ্রিয় উপাদান কাজ করে ত্বকের কোষ স্তরে, পুনরুৎপাদনকে ত্বরান্বিত করতে। রূপচর্চায় ব্যবহৃত বিভিন্ন উপাদানের মধ্যে সবচেয়ে পুরোনোগুলোর একটি এটি। ঠিকঠাক কার্যকারিতা লাভে কৌশল অবলম্বন করতে হয় এটি ব্যবহারে। বেশি এবং যাচ্ছেতাই ব্যবহারে বাড়ে স্পর্শকাতরতা; ফলাফল—শুষ্কতা, চুলকানি, র্যাশ, ব্রেকআউট, পিগমেন্টেশন আর ত্বকের সুরক্ষা দেয়ালের কার্যকারিতায় বাধা। এ ছাড়া জ্ঞান বাড়াতে হবে মেলানিলসমৃদ্ধ ত্বক এবং তার ব্যতিক্রমী চাহিদা নিয়ে। একদম বেসিক সম্পর্কে বুঝে বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে সিদ্ধান্ত নিতে সহায়তা করবে। কারণ, বাজারের সবচেয়ে জনপ্রিয় পণ্য অথবা উপাদানটিও মাঝেমধ্যে ত্বকে মানায় না। ত্বকের ধরন ও চাহিদার হেরফেরে এমনটা হতে পারে।
কনটেন্ট নাকি বিশেষজ্ঞ মত
অতিরিক্ত জটিল স্কিন কেয়ার রুটিন সমস্যাযুক্ত ত্বকের বিদ্যমান অসুবিধা আরও বাড়ায়। অত্যধিক এক্সফোলিয়েশন, বেমানান সব উপাদানের একসঙ্গে ব্যবহার আর ভূরি ভূরি পণ্যের প্রয়োগ, তা-ও আবার পর্যাপ্ত আর্দ্রতার প্রলেপ আর সানস্ক্রিনের সুরক্ষা ছাড়া—ত্বকের স্বাস্থ্যোজ্জ্বল ভাব নষ্ট করে দেয়, বয়স্ক ভাব বাড়ায়। সোশ্যাল মিডিয়ার আবির্ভাবের আগে এমন কথা শুধু ত্বক বিশেষজ্ঞদের মুখে শোনা যেত। আর মিলত সৌন্দর্য নিয়ে লেখেন এমন লেখকদের বক্তব্যে। বছরব্যাপী গবেষণা আর অভিজ্ঞ নীতিনির্ধারকদের উপদেশের ভিত্তিতে দেওয়া হতো সেসব তথ্য আর পরামর্শ। কিন্তু সোশ্যাল মিডিয়ার উপস্থিতিতে সেই সীমানা নির্ধারণ এখন দুঃসাধ্য। এই পরিস্থিতি স্কিন এক্সপার্ট এবং বিউটি রাইটারদের দায়িত্ব আরও বাড়ায়। কনটেন্ট সঠিকভাবে যাচাই করে সঠিকটা ক্রেতা অব্দি পৌঁছে দেওয়ার ক্ষেত্রে। ক্রেতাদেরও দায়িত্বশীলতার সঙ্গে কনটেন্ট বাছাই করা জরুরি। সময় ব্যয় করতে হবে স্কিন কেয়ার এক্সপার্ট, প্রফেশনাল এবং তথ্যভিত্তিক গবেষণার মতো বিশ্বস্ত সব সূত্রে।
আদর্শ কোনটা
ত্বকের চাহিদা নির্ভর করে নানাবিধ বিষয়বস্তুর ওপর; যেমন বয়স, স্বাস্থ্য, জীবনযাত্রা, ধরন, জেনেটিক, হরমোন, পারিপার্শ্বিক পরিবেশ। এ ক্ষেত্রে কোনো ওয়ান-সাইজ-ফিটস-অল ফর্মুলা নেই। সবার আগে সময় নিয়ে বুঝতে হবে ত্বককে। জানতে হবে চাহিদা। কেননা তারুণ্যের তেলতেলে ত্বক বয়স বাড়তেই শুষ্ক হওয়া শুরু করে। তখন সাধারণ ক্লিনজারে আর কাজ হয় না। জরুরত পড়ে বিশেষায়িত পণ্যের। ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে হবে। চলতে হবে নিয়মানুবর্তিতা মেনে। চাহিদা বুঝে তৈরি করে নিতে হবে রূপরুটিন, অতিরিক্ত জটিলতা এড়িয়ে। তালিকায় মাস্ট—মাইল্ড, পিএইচ ব্যালেন্সড ক্লিনজার, ত্বক বুঝে লাইটওয়েট ময়শ্চারাইজার আর ব্রডস্পেকট্রাম সানস্ক্রিন, অন্তত এসপিএফ ৩০ সমেত। আর অ্যাকনে, পিগমেন্টেশনের মতো বিশেষ ত্বক সমস্যায় বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে পরামর্শ মেনে সেট করতে হবে রূপরুটিন।
জাহেরা শিরীন
মডেল: শ্রাবণী
মেকওভার: পারসোনা
ছবি: কৌশিক ইকবাল