এডিটর’স কলাম I শান্ত স্নিগ্ধতা
প্রকৃতি নিজ শৃঙ্খলাতেই ঋতুভেদে বৈচিত্র্যময় মাধুর্য ছড়িয়ে রাখে। তা উপভোগ করার জন্য ব্যক্তিমানুষের দেহ-মনে সুস্থতা থাকা চাই। অন্যথায় সকলই বৃথা!
‘এখানে আকাশ নীল—নীলাভ আকাশ জুড়ে সজিনার ফুল/ ফুটে থাকে হিম শাদা—রং তার আশ্বিনের আলোর মতন;/ আকন্দফুলের কালো ভীমরুল এইখানে করে গুঞ্জরণ।’ রূপসী বাংলার কবি জীবনানন্দ দাশ লিখে গেছেন শরৎ বন্দনায়। এ এমনই এক ঋতু, যখন স্বচ্ছ নীল আকাশে পেঁজা তুলোর মতো ভেসে বেড়ায় মেঘ। কখনো কখনো এক টুকরো অত্যুজ্জ্বল হীরকখণ্ডের অবয়ব নিয়ে। প্রশান্ত বাতাসে স্নিগ্ধ হাওয়ার কোমল পরশ ছড়িয়ে পড়ে। যত দূর চোখ যায়, শুভ্রতার চিত্রমালা। আকাশ ভেদ করে উঁকি দেয় সূর্যের শিখা। নদী-নালা, খাল-বিল কিংবা হাওর-ঝিলে শুভ্র নীলের বিস্তার। পাহাড়ের বুকে হেলান দিয়ে যেন মেঘে মেঘে চলে গল্পের মাতম।
দুই
শরতের সকাল মানুষের মনে দারুণ এক আনন্দ-অনুভূতির দোলা দিয়ে যায়। আদিগন্ত সাদা ও নীলের চাদর পেরিয়ে যখন উঁকি দেয় দিনের প্রথম মিষ্টি আলো, গ্রামবাংলার অসংখ্য ধানি জমিতে ছড়িয়ে পড়ে সূর্যের রশ্মি। দূর্বা ঘাসের ওপর রুপালি মুক্তার বিন্দুর মতো ঝিকমিক করে সতেজ শিশির। সদ্য সমাপ্ত বর্ষার নিবিড় ঘনঘটা সরে গিয়ে, আকাশ হয়ে ওঠে নির্মল। শিশিরভেজা ধান, শিউলি ফুল আর মৃদু রোদের পুকুরে প্রতিমাতুল্য হাসি ছড়িয়ে দুলতে থাকে লাল ও সাদা শাপলা ফুল। নীলাকাশ মাতিয়ে, উড়ন্ত সফেদ মেঘমালার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে, আহ্লাদিত সবুজ মাঠের ওপর উড়ে যায় টিয়া, শালিক, ময়না পাখির ঝাঁক। নদীমাতৃক বাংলার নদীগুলো বর্ষার মতো এ ঋতুতেও থাকে জলে পূর্ণ। দুই কূলে সবুজ বনরাজি আর শুভ্র কাশফুলে যেন স্বর্গরাজ্য হয়ে ওঠে এই ভূমি। আর ফুলের কথা? শুধু কাশবনই নয়, গোটা প্রকৃতিই সেজে ওঠে বর্ণিল ফুলে ফুলে। শাপলা, শালুক ও পদ্ম যেমন নাচে জলে; বাড়িতে-বাইরে, পথে-প্রান্তরে নেচে নেচে সুবাস ছড়ায় কামিনী, মালতী, মল্লিকা, মাধবী, ছাতিম, বরই, দোলনচাঁপা, বেলি, জুঁই, কেয়া, শিউলি, জবা, জারুল, নয়নতারা, ধুতরা, ঝিঙে, জয়ন্তীসহ কত-না ফুল।
তিন
উৎসবপ্রিয় মানুষে ভরা এ জনপদে শরৎ বয়ে আনে উদ্যাপনের বিবিধ উপলক্ষ। বাঙালি হিন্দুদের শারদীয় দুর্গোৎসব তো বটেই; পাশাপাশি সর্বসাধারণের পিঠা, পায়েস ও নানা আহার-উৎসবে মাতোয়ারা হওয়ার মৌসুম এটি। কেননা, কৃষিপ্রধান এই দেশে শরৎ শুভ্র আনন্দ ছড়িয়ে দেয় কৃষকের মনে। বর্ষা শেষে পানি নেমে যায় ফসলের মাঠ থেকে। আবারও চাষের প্রেরণা খুঁজে পান জমিনের শিল্পীরা। হেমন্তী ধানের বীজ বোনে, চারা রোপণ করেন তারা। মনে পোষেন সম্ভাবনার স্বপ্নগুলো।
চার
সৃজনশীলতার জন্য শরৎ এক দারুণ ঋতু। অগুনতি চিত্রশিল্প যেমন আঁকা হয়েছে একে ঘিরে, লেখাও হয়েছে অসংখ্য। বাংলা সাহিত্যে উঁকি দিলে এর ভূরি ভূরি উদাহরণ মেলে। যেমন বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এ ঋতুর বন্দনায় লিখে গেছেন, ‘শরৎ তোমার অরুণ আলোর অঞ্জলি/ ছড়িয়ে গেল ছাড়িয়ে মোহন অঙুলি।/ শরৎ তোমার শিশির-ধোয়া কুন্তলে/ বনের পথে লুটিয়ে পড়া অঞ্চলে।/ আজ প্রভাতের হৃদয় ওঠে চঞ্চলি।’ এমন দিনে পদ্মায় নৌকা ভ্রমণকালে শরতের ময়ূরকণ্ঠী নীল নির্মল আকাশে শিমুল তুলার মতো দলে দলে শুভ্র মেঘের ছুটে বেড়ানো দেখে তিনি আরও লিখেছেন, ‘অমল ধবল পালে লেগেছে মন্দ মধুর হাওয়া/ দেখি নাই কভু দেখি নাই এমন তরণি বাওয়া।’ জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম লিখেছেন, ‘এসো শারদ প্রাতের পথিক এসো শিউলি বিছানো পথে/ এসো ধুইয়া চরণ শিশিরে এসো অরুণ-কিরণ রথে।/ দলি শাপলা শালুক শতদল এসো রাঙায়ে তোমার পদতল/ নীল লাল ঝরায়ে ঢলঢল এসো অরণ্য পর্বতে।’ তারও আগে, মহাকবি কালিদাস তার ‘ঋতুসংহার’ কাব্যে লিখেছেন, ‘কাশফুলের মতো যার পরিধান, প্রফুল্ল পদ্মের মতো যার মুখ, উন্মত্ত হাঁসের ডাকের মতো রমণীয় যার নূপুরের শব্দ, পাকা শালি ধানের মতো সুন্দর যার ক্ষীণ দেহলতা, অপরূপ যার আকৃতি সেই নববধূর মতো শরৎকাল আসে।’ কবি বিনয় মজুমদারের ভাষ্যে, ‘শরতের দ্বিপ্রহরে,/ সুধীর সমীর-পরে/ জল-ঝরা শাদা শাদা মেঘ উড়ে যায়;/ ভাবি, এক দৃষ্টে চেয়ে—/ যদি ঊর্ধ্ব পথ বেয়ে/ শুভ্র অনাসক্ত প্রাণ অভ্র ভেদি ধায়!’ আধুনিক সাহিত্যের অন্যতম প্রধান কণ্ঠস্বর আল মাহমুদ তার কবিতায় লিখেছেন, ‘ঋতুর অতীত আমি। কে জিজ্ঞাসে এটা কোন মাস?/ বাতাসে গড়িয়ে পড়ে বিদায়ের বিষণ্ন নির্যাস।/ শ্রবণেরও শক্তি নেই। কিন্তু ভাবি কোলাহল আছে/ প্রতিটা বাড়ির রন্ধ্রে, ইটে ইটে, আনাচে-কানাচে।/ এটা কি শরৎ সন্ধ্যা? বাংলাদেশ? কাশফুলে ছেয়ে গেছে চর?/ উদাম আকাশে তবে এখনও কি মাথার ওপর?/ এমন নির্গন্ধ বায়ু কোনকালে ছিল কি এদেশে?/ আমার পঙ্ক্তি শুনে, কারা হাসে? প্রেতের আদেশে/ মনে হয় মরে গেছে শরতের সন্ধ্যার শহর।/ আর কোন স্মৃতি নেই, ভীতি নেই, নীতি নেই কাঁপে থরথর।/ অস্তিত্বের কাঠামোখানি, হাড়গোড় রক্তের নহর।/ এভাবেই কাব্য হয় তর্কে তর্কে কেঁপে ওঠে/ কবির অধর।’ অন্যদিকে, চলচ্চিত্রে, বিশেষত সত্যজিৎ রায়ের ‘পথের পাঁচালী’তে কাশফুলের মাঠ পেরিয়ে অপু-দুর্গার রেলগাড়ি দেখতে যাওয়ার দৃশ্যের হাত ধরে বিশ্বজুড়ে গ্রামবাংলার শরতের চিত্র ছড়িয়ে পড়েছে নথি রূপে।
পাঁচ
প্রকৃতি নিজ শৃঙ্খলাতেই ঋতুভেদে বৈচিত্র্যময় মাধুর্য ছড়িয়ে রাখে। তা উপভোগ করার জন্য ব্যক্তিমানুষের দেহ-মনে সুস্থতা থাকা চাই। অন্যথায় সকলই বৃথা!
জীবন সুন্দর হোক সবার।