নখদর্পণ I স্বাস্থ্যসূচক
দেহের রোগবালাইয়ের খবর থাকবে নখের ডগায়। সমঝদারদের জন্য কিন্তু ইশারাই যথেষ্ট
মানবদেহ প্রায়ই আকস্মিকভাবে ভেতরের অবস্থার জানান দেয়। দেহের অভ্যন্তরীণ অনেক সমস্যাই ফুটে ওঠে বাহ্যিক অঙ্গপ্রত্যঙ্গে। নখ সেগুলোর একটি। শুধু নখের পরিবর্তিত অবস্থা বাতলে দিতে পারে দেহের ভেতরে জমতে থাকা সব জটিলতা।
ভঙ্গুর নখ
অতিরিক্ত হাত ধোয়া, ডিশ ওয়াশিং লিকুইড এবং হ্যান্ড ওয়াশের ঘন ঘন ব্যবহার খুব সহজে ক্ষতি করে নখের। যাদের বারবার হাত ধোয়ার অভ্যাস, তাদের প্রায়ই এই সমস্যায় পড়তে দেখা যায়। অনেক দিন ধরে পুষ্টিহীনতায় ভোগা নারীদেরও এই সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়।
যাদের থাইরয়েডের সমস্যা রয়েছে, মূলত যারা হাইপারথাইরয়েডিজমের শিকার, তাদের নখ অপেক্ষাকৃত বেশি ভঙ্গুর হয়। থাইরয়েডের আধিক্য ঘর্মগ্রন্থিগুলোকে অকেজো করে ফেলে বলে শরীর অল্প পরিশ্রমেই নেতিয়ে যায়। এর সঙ্গে শরীরের সব জায়গায় নিউট্রিশন সঠিকভাবে পৌঁছাতে পারে না, আরও বিশদভাবে বললে নখ পর্যন্ত পর্যাপ্ত পুষ্টি পৌঁছায় না বলে তা ধীরে ধীরে ভঙ্গুর হয়ে যায়।
নখের ভঙ্গুরতার সমস্যায় ভুক্তভোগী হলে ডাক্তারের পরামর্শ নিতে হবে দ্রুত। সাধারণত ভিটামিন ডেফিশিয়েন্সি দূর করার মাধ্যমে সহজে এই সমস্যা থেকে মুক্তি সম্ভব।
হলুদাভ নখ
হাইপোথাইরয়েডিজম, সোরায়সিস, ডায়াবেটিসের মতো সমস্যার বহিঃপ্রকাশ হতে পারে হলুদাভ নখ। এ ছাড়া অতিরিক্ত চিনিযুক্ত খাবার গ্রহণ শরীরে প্রোটিন গ্লাইকেশিনের প্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করে, যা কোলাজেন ভেঙে দেয় এবং এর সরাসরি প্রভাব পড়ে ত্বক ও নখে।
ব্লাড সুগার লেভেল কন্ট্রোলের বাইরে চলে গেলে এটাই সময় প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়ার।
তবে হলুদ নখটি যদি ক্রমশ পুরু হতে শুরু করে, তা আবার অন্য সমস্যার কথা বলে। নখ যদি একই সঙ্গে পুরু ও হলুদ হয়, তবে ডার্মাটোলজিস্টের শরণাপন্ন হওয়া চাই দ্রুত। নখের ভেতরে ময়লা জমে শুরু হলে হতে পারে ইনফেকশন। দ্রুত সমাধান না করলে হিতে বিপরীত হয়ে হারানো লাগতে পারে নখও।
থেঁতো নখ
নখ দেখলে যদি মনে হয় থেঁতলে গেছে কিংবা কোনো কারণে নখের ভেতরে ছোট ছোট গর্তের সৃষ্টি হয়, তবে এর অন্তর্নিহিত কারণ হতে পারে বিষণ্নতা। এ ছাড়া ত্বকের কোনো প্রদাহ থেকে শুরু হতে পারে এই সমস্যার। সোরায়সিসের মাত্রা বেশি হলে নখের রং পরিবর্তন হয়, নখ এলোমেলোভাবে বেড়ে উঠতে পারে। নেইল বেড থেকে নখ উঠে আসার আশঙ্কা বেড়ে যায় ৫০ শতাংশ পর্যন্ত।
সোরায়সিসজনিত নখের সমস্যার সমাধান মিলবে ডার্মাটোলজিস্টদের কাছে। এ ছাড়া পেডিকিউর আর মেনিকিউরে নখ ফাইলিং, ক্লিপিং করার মাধ্যমে নখের স্বাভাবিক সৌন্দর্য আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনা যেতে পারে।
ভার্টিক্যাল রিজেস
এই সমস্যাকে অনেকে না বুঝে অগ্রাহ্য করেন। এ ছাড়া বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে নখে এমন উল্লম্ব রেখা দেখা যায় বলে অনেকে ধরে নেন। একে অনেকে ব্যান্ডও বলে থাকেন। এজিং প্রক্রিয়ায় মানব শরীরে কোলাজেনের পরিমাণ কমতে থাকে এবং ডেড সেল সরে গিয়ে নতুন সেল তৈরির প্রক্রিয়াটিও গতি হারায়। এর প্রভাব দেখা যায় নখে।
শরীরে আয়রনের পরিমাণ কমে গেলে বিষণ্নতা, উদ্বেগ, ওজনের তারতম্য, প্রস্রাবে ইনফেকশনের মতো সমস্যার সূত্রপাত হতে পারে। এ থেকেও নখে ভার্টিক্যাল রিজেস দেখা দিতে পারে।
হরাইজন্টাল রিজেস
নখের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে চলমান আড়াআড়ি রেখা এগুলো। বিউ’স লাইন বলেও পরিচিত অনেকের কাছে। এগুলোও দেহের অভ্যন্তরীণ সমস্যাগুলোর বহিঃপ্রকাশ। কেমোথেরাপি, কিডনি, ডায়াবেটিসের মতো সমস্যার কারণে নখে এই অবস্থা হতে পারে। শরীরে জিংকের ঘাটতি দেখা দিলে বিউ’স লাইন উঁকি দিতে পারে। আমাদের নখ প্রতিনিয়তই বৃদ্ধি পায়, আর তুলনায় যদি জিংকের ক্রমাগত ঘাটতি হতে থাকে, তবে নখের ক্ষতিগ্রস্ত ভাব ফুটে ওঠে।
জিংকসমৃদ্ধ খাবারের পাশাপাশি নিয়মিত মাল্টিভিটামিন সেবন করার মাধ্যমে এই সমস্যা থেকে পরিত্রাণ পাওয়া সম্ভব।
গাঢ় রেখা
কালো, বাদামি, লাল রেখা নখে থাকলে বুঝতে হবে কোনো রোগের লুকায়িত সংকেত। সাধারণত বাহ্যিক কোনো প্রেশারের কারণে নখে এই ধরনের গাঢ় রেখা দেখা দিতে পারে। নখের নিচে থাকা ব্লাড ভেসেলে চাপ পড়লেও এমনটা হতে দেখা যায়। মাঝে মাঝে সোরায়সিস বা এন্ডোকার্ডিটিসের জন্যও নখে এই রকম রেখা দেখা যায়।
স্কিন ক্যানসারের সবচেয়ে ভয়ানক ধরন মেলানোমা। এর প্রভাবেও নখে এরূপ রেখার আবির্ভাব হতে পারে। তবে মেলানোমার কারণে হওয়া নখের এই কালো দাগের প্রধান কারণ মেলানিন বাড়া। এই দাগগুলো মেলানোমার কারণে হয় বলে দেখতে এত পুরু হয় না। মেলানোমা যেহেতু একটু সিরিয়াস কন্ডিশন, তাই এতে হেলাফেলা না করাই শ্রেয়। দ্রুত ডাক্তারের শরণাপন্ন হওয়া চাই।
বিদিশা শরাফ
ছবি: সংগ্রহ