ফোকাস I সচেতন সৌন্দর্য-অভ্যাস
আপনি কি পরিবেশসচেতন? কিংবা যিনি জীবনসঙ্গী হতে চলেছেন, তিনি? জানেন তো, এই সচেতনতা খুব জরুরি। কেবল পৃথিবী বা তার পরিবেশ বাঁচানোর জন্য নয়, নিজের জন্যও। সব ক্ষেত্রের জন্যই কথাটা ভীষণভাবে সত্যি। এমনকি, সৌন্দর্যবর্ধনের জন্য ভেষজ ব্যবহারের ধারণাও এই কনসেপ্ট থেকে এসেছে। কারণ, সুন্দর হওয়া যেমন জরুরি, তার চেয়ে বেশি জরুরি একই সঙ্গে নিজেকে ভালো রাখাও। আজকাল বেশির ভাগ নারীই কিন্তু বাহ্যিক সৌন্দর্যের পাশাপাশি অভ্যন্তরীণ সৌন্দর্যের ওপর জোর দেওয়ার পক্ষপাতী। আর এ সবকিছুর জন্যই প্রয়োজন ভেষজ উপাদান। কারণ, একমাত্র প্রাকৃতিক উপাদানের মাধ্যমেই অভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক সৌন্দর্য বাড়ানো যায়, পাশাপাশি পরিবেশের ভারসাম্যও অটুট থাকে। এ ধরনের পণ্য দেহে কোনো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া সৃষ্টি না করে পুষ্টি এবং অন্যান্য প্রয়োজনীয় খনিজ দিয়ে শরীরকে সমৃদ্ধ করে। গবেষকদের মতে, ভেষজ পণ্যে থাকা ভিটামিন, খনিজ, প্রয়োজনীয় ফ্যাটি অ্যাসিড, অ্যামিনো অ্যাসিড ও ময়শ্চারাইজিং এজেন্ট ত্বকের আর্দ্রতা ধরে রাখতে সাহায্য করে। বিভিন্ন হার্ব, ফলমূল ও উদ্ভিদের নির্যাসে উপস্থিত ফ্ল্যাভোনয়েড ত্বককে অক্সিডেটিভ স্ট্রেস থেকে রক্ষা করে। পাশাপাশি এতে উপস্থিত থাকা ভিটামিন এ, সি, ই এর মতো উপাদান ত্বকস্বাস্থ্যের উন্নতি ঘটায়।
সৌন্দর্যবিশ্বেও সচেতন নারীদের কথা চিন্তা করে ক্রমে বাড়ছে ভেষজ প্রসাধনীর সংখ্যা, সেই সঙ্গে জনপ্রিয়তা। তেল থেকে শুরু করে শ্যাম্পু, কন্ডিশনার, ত্বকের জন্য সাবান, ময়শ্চারাইজার, স্ক্রাব, ক্রিম, লোশন—কী নেই ভেষজ পণ্যের সম্ভারে। এ ধরনের প্রসাধনীর সবচেয়ে ভালো দিক হলো, এগুলো বিশুদ্ধভাবে ভেষজ উপাদান এবং নানা ধরনের গুল্ম ব্যবহারে তৈরি করা হয়; যা শরীরের ওপর কোনো প্রতিক্রিয়া করে না, বরং পরিপূরক অন্যান্য সহায়ক খনিজ দিয়ে শরীরকে উন্নত করে।
সৌন্দর্যবিশেষজ্ঞরাও বিশ্বাস করেন, বর্তমান বিশ্বে ভেষজ প্রসাধনী হলো সৌন্দর্যচর্চায় সবচেয়ে নিরাপদ ও কার্যকর ট্রেন্ড বা প্রবণতা। কারণ, এই পণ্যগুলো সব ক্ষতিকর সিনথেটিক রাসায়নিক থেকে মুক্ত। গবেষকদের কল্যাণে বেশির ভাগ কেমিক্যাল যে ত্বকের জন্য বিষাক্ত, তা এরই মধ্যে প্রমাণিত হয়েছে। আর ভেষজ পণ্য তৈরিতে ব্যবহৃত হয় উদ্ভিদের বিভিন্ন অংশ ও নির্যাস। যেখানে ভিটামিন এবং নানা রকম খনিজের প্রাকৃতিক পুষ্টি থাকে, যা ত্বককে অনেক বেশি স্বাস্থ্যকর ও উজ্জ্বল রাখতে সক্ষম। তাই বলা হয়, বাজারে অন্যান্য সৌন্দর্যপণ্যের তুলনায় প্রাকৃতিক প্রসাধনী ব্যবহার অনেক নিরাপদ ও কার্যকরী। প্রাকৃতিক উপাদান দিয়ে তৈরি বলে ত্বকের সঙ্গে সম্পর্কিত কোনো সমস্যা; যেমন ফুসকুড়ি বা চুলকানির উদ্রেক নিয়ে চিন্তা করার বিষয়ও থাকে না। অনেকে জানেন না যে বিএইচএ (BHA- Butylated Hydroxy-anisole) এবং বিএইচটি (BHT-Butylated Hydroxytoluene) হলো একরকম সিনথেটিক অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট, যা ময়শ্চারাইজার এবং বেশির ভাগ সৌন্দর্যপণ্যের রেঞ্জগুলোতে সংরক্ষণকারী হিসেবে ব্যবহৃত হয়। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে যা থেকে ত্বকে অ্যালার্জি সৃষ্টি হওয়ার ভয় থাকে। কিন্তু ভেষজ প্রসাধনীতে প্রাকৃতিক অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট থাকে, তাই কৃত্রিম রাসায়নিক ব্যবহারের প্রয়োজন পড়ে না।
প্রাকৃতিক প্রসাধনী সব ধরনের ত্বকের জন্য উপযুক্ত। এমনকি সংবেদনশীল ত্বকেও এটি ব্যবহারে ত্বকের অবনতি সম্পর্কে চিন্তা করার কারণ নেই। আপনি যদি পরিবেশসচেতন হন, তাহলে জেনে রাখুন, বেশির ভাগ কৃত্রিম প্রসাধনী প্রাথমিকভাবে প্রাণীদের ওপর পরীক্ষা করা হয় এটি নিশ্চিত করার জন্য যে, সেগুলো মানুষের জন্য নিরাপদ ও কার্যকর। যেখানে প্রাকৃতিক প্রসাধনীতে তা পরীক্ষা করার প্রয়োজন হয় না। সৌন্দর্যচর্চায় অবশ্য প্রাকৃতিক উপাদান শত শত বছর ধরে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। তবে ইদানীং সিনথেটিক উপাদান বা রাসায়নিক পদার্থ সম্পর্কে ভোক্তাদের উদ্বেগের কারণে ফর্মুলেশন আরও বেশি জনপ্রিয় বা প্রচলিত হয়ে উঠছে। তা ছাড়া সবচেয়ে বড় কথা, পরিবেশদূষণের ক্রমবৃদ্ধির এ সময়ে এগুলোকে বলা হচ্ছে সবচেয়ে ত্বক-নিরাপদ পণ্য। যার প্রয়োগ সম্পূর্ণ নিরাপদ এবং অন্যান্য পণ্যের তুলনায় তাদের কোনো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নেই। আপনার বয়স বা ত্বকের রং যা-ই হোক না কেন, সুস্থ ও উজ্জ্বল ত্বকের চাবিকাঠি এটি। প্রাকৃতিক ভিটামিন ও অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট সমৃদ্ধ ত্বকবান্ধব এ পণ্য সময়ের সঙ্গে ত্বককে স্বাস্থ্যোজ্জ্বল ও তরুণ করে তোলে কোনো ধরনের ক্ষতির আশঙ্কা ছাড়াই। কেবল ত্বকের ধরন বুঝে নিয়ে কোন উপাদানটি উপযুক্ত, সেটি নির্বাচনই যথেষ্ট।
সাধারণত বেশির ভাগ সৌন্দর্যপণ্যে ব্যবহৃত হয় অ্যালোভেরা, আমলকী, নিম, রোজমেরি, তুলসী, হলুদ, মেহেদি, চন্দন, পেঁপে, কমলা, গোলাপ ইত্যাদি। প্রচুর ভিটামিন ও পুষ্টিগুণ ছাড়াও এ ভেষজ পণ্যগুলোতে রয়েছে প্রাকৃতিক সুগন্ধি। ভেষজ এসব সুগন্ধি কেবল ত্বক শিথিল করে না, মনকেও শান্ত করে। একদম গভীর থেকে নিরাময়ে সহায়তা করে; যেহেতু এই পণ্যগুলো কোনো কৃত্রিম বা বিষাক্ত গন্ধমুক্ত, তাই ব্যবহারে কোনো বাধা নেই। চিকিৎসকদের মতে, সুগন্ধি পণ্যের কৃত্রিম গন্ধ থেকে মারাত্মক মাথাব্যথা হতে পারে এবং ত্বকে নানা রকম প্রতিক্রিয়া হওয়ার ভয় থাকে। যেহেতু প্রাকৃতিক পণ্য কোনো কৃত্রিম সুগন্ধ বহন করে না, তাই এগুলো নিরাপদ বলাই বাহুল্য। সিনথেটিক বিউটি প্রোডাক্ট শুধু ত্বকে জ্বালাপোড়া সৃষ্টি করে না, বরং নানা ধরনের দীর্ঘস্থায়ী ত্বক সমস্যাও সৃষ্টি করতে পারে। এগুলো ত্বকের লোমকূপগুলো বন্ধ করে দিতে পারে। বাড়াতে পারে অতিরিক্ত শুষ্কতা বা তৈলাক্ততা। প্রাকৃতিক প্রসাধনীগুলো নিয়ে এসব চিন্তার দরকার পড়ে না। এগুলো তৈরিতে প্যারাবেনের মতো প্রিজারভেটিভ ব্যবহার করা হয় না। তাই কোনো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াও নেই। আরও সুবিধা হলো, এ ধরনের প্রাকৃতিক প্রসাধনী মোটেই এত ব্যয়বহুল নয়; বরং খুব কম খরচে সহজলভ্য। হাতের কাছেই পাওয়া যায়।
সুতরাং নতুন জীবনের শুরুতে সৌন্দর্যসঙ্গী করে নিন তাকে। আর যারা বর হতে যাচ্ছেন, তাদের বলছি গায়েহলুদ বা বিয়ের প্রসাধনীর ডালাটা এবার বরং ভেষজ সৌন্দর্যপণ্য দিয়েই সাজিয়ে ফেলুন না। তাতে একসঙ্গে অনেক কাজ হবে। কনে তার সর্বোচ্চ সৌন্দর্য সুবিধা পাবে, পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার কোনো ভয় থাকবে না, খরচ কম এবং সর্বোপরি আপনি যে একজন পরিবেশসচেতন মমতাময়ী মানুষ, সেটিও প্রমাণিত হবে খুব সহজে।
রত্না রহিমা
ছবি: মমতাজের সৌজন্যে