skip to Main Content

মনোযতন I ভ্রান্তে বিভ্রান্তি

স্টেরিওটাইপ মেন্টাল ইলনেস বা ভ্রান্ত ধারণার চাপে মানসিক স্বাস্থ্যের তথৈবচ অবস্থা! অথচ সযত্ন ও বিশেষজ্ঞ পরামর্শে মিলতে পারে সমাধান

ধরা যাক, ব্যক্তিগত নানা বিষয়ে হতাশায় দিন কাটছে আপনার। মন হরদম মেঘলা আকাশের মতো ভারাক্রান্ত। বিষণ্নতার অতল গহ্বরে ডুবে ডুবে নিজেকেই অচেনা লাগে। আপনার প্রয়োজন আশ্রয়। হৃদয় খুলে কথা বলার মতো কোনো বিশ্বস্ত কাঁধ খুঁজছেন। অথচ আশপাশে শকুনের চোখ! কেউ ঠিক আপনাকে বুঝতে পারছে না। আপনি রাতের আঁধারে হয়তো চিৎকার করে কাঁদেন। কখনো নিজের ওপর, আবার কখনো পরিস্থিতির ওপর রাগে ফেটে পড়েন। ভাগ্যকে দোষারোপ করেন। আপনার এসব বিষণ্নতা, রাগ, চিৎকার ইত্যাদি বোঝার মতো কেউ নেই পাশে। কাছের মানুষগুলো হয়তো ভাবছে, আপনি পাগল; কিংবা আপনাকে মাঝেমধ্যে ভূতে ধরে—এমনই আন্দাজ তাদের! অথবা আপনি স্বাভাবিক মানুষ নন; বরং বাড়তি মনোযোগ পাওয়ার জন্য অভিনয় করেন। এই যে মানসিক স্বাস্থ্যের বিষয়গুলো ঠিকঠাক বুঝতে না পারা এবং এ বিষয়ে ভুল ধারণা পোষণ করা—এটিই মানসিক স্বাস্থ্যবিষয়ক স্টেরিওটাইপ, স্টিগমা বা ভ্রান্ত ধারণা। সমাজের প্রচলিত বিভিন্ন ভুল ধারণা ব্যক্তির বিশ্বাসে পরিণত হয়। কখনো কখনো ব্যক্তি নিজেও অন্যদের বিশ্বাস ও ভুল ধারণায় প্রভাবিত হন।
ডিজঅ্যাবলড চাইল্ড ফাউন্ডেশনের প্রজেক্ট কো-অর্ডিনেটর এবং সাইকোলজিস্ট ও ট্রেইনার নাঈমা ইসলাম অন্তরা জানান, স্টেরিওটাইপ মেন্টাল ইলনেস হলো মানসিক স্বাস্থ্যবিষয়ক একরকম ভুল ধারণা পোষণ করা। একে স্টিগমাও বলে। আমাদের চিন্তা-চেতনা, বিশ্বাস নিজেদের ভেতর ও সমাজের মানুষের কাছে জানার সংকীর্ণতাকে প্রকাশ করে।
অনেকে মনে করেন, মানসিকভাবে অসুস্থতা মানেই ভায়োলেন্স তথা সহিংসতা। কারও কারও ধারণা, মানসিকভাবে অসুস্থ থাকলেই সে ব্যক্তি দুর্বল। কিন্তু এমন ধারণা ঠিক নয়। কেননা মানসিকভাবে অসুস্থ হলে কেউ কখনো দুর্বল প্রকৃতির হয় না। তার ইচ্ছাশক্তি, কাজ করার আগ্রহ কম—সেসব বোঝায় না। অনেকে মানসিক অসুস্থতা সত্ত্বেও কর্মক্ষেত্রে ভালো করেন। মানসিকভাবে অসুস্থ থাকা মানেই অন্য ব্যক্তিদের চেয়ে তিনি দুর্বল কিংবা এ ধরনের অসুস্থতা খুব কম মানুষের হয়—উভয় ধারণাই একধরনের স্টিগমা। ৯০ শতাংশ মানুষেরই কোনো না কোনো মানসিক অসুস্থতা থাকতে পারে। কেননা, রাগ-দুঃখ, ক্ষোভ, অস্থিরতা—এগুলো আমাদের খুব সাধারণ উপসর্গ। এগুলো জীবনের অংশ। এই ধরনের অনুভূতি প্রত্যেক মানুষেরই হতে পারে। যে কেউ জীবনের কোনো না কোনো সময় মানসিক অসুস্থতার মধ্য দিয়ে যেতে পারেন, এমনটা বলছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা।
মানসিক অসুস্থতা আরোগ্যসাধ্য নয় কিংবা মানসিকভাবে অসুস্থ হলে তা কখনো ঠিক হয় না, এমন ধারণাও ভুল। মানসিক অসুস্থতা রিকভার করা যায়। সিজোফ্রেনিয়া, বাইপোলার ডিজিজ হলেও তা থেকে সুস্থ হওয়া সম্ভব। ওষুধ কিংবা কাউন্সেলিং, হেলদি লাইফস্টাইলের মাধ্যমে পুরোপুরি সুস্থ হওয়ার নজির কম নয়। যারা মনে করেন, মানসিক অসুস্থতা কখনো ভালো হয় না, তারা ভুল ধারণা মনে গেঁথে রাখেন বলেও জানান নাঈমা।
মানসিকভাবে অসুস্থ ব্যক্তিদের নিয়ে অনেকে নেতিবাচক ধারণা পোষণ করেন। তাকে বা তাদেরকে লজ্জা দিয়ে কথা বলেন। চারপাশ থেকে পাওয়া এমন আচরণ আক্রান্ত ব্যক্তির আত্মমর্যাদাবোধ কমিয়ে দেয়। তিনি যেন অন্য কারও কাছে সাহায্য না চাইতে পারেন, সে বিষয়ে তাকে অপরাধবোধে ভোগায়। মোটকথা, বিভিন্ন বৈষম্যের দোলাচলে জীবন কাটে তার। চাকরি, ব্যবসা, শিক্ষা—সব ক্ষেত্রে বাধাপ্রাপ্ত হন।
জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের মনোরোগবিদ্যা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. হেলাল উদ্দীন আহমেদ জানান, শিশুদের মধ্যে স্টেরিওটাইপ বিহেভিয়ার, স্টেরিওটাইপ পার্সোনালিটি ইত্যাদি দেখা যায়। একই কাজ বা কথার পুনরাবৃত্তি করতে থাকা, অকারণে হাত নাড়ানো, হাততালি দেওয়া, পা নাড়ানো ইত্যাদি স্টেরিওটাইপ বিহেভিয়ার। এ ধরনের সবকিছুর জন্যই কাউন্সেলিং, সিবিটি রয়েছে।
অসুস্থতার ধরন
মানসিক অসুস্থতার মধ্যে সাইকোটিক ডিজঅর্ডার (সিজোফ্রোনিয়া, বাইপোলার মুড ডিজঅর্ডার), নিউরোটিক ডিজঅর্ডার (ডিপ্রেশন, অ্যাংজাইটি ইত্যাদি) আছে। রাগ, দুঃখ, হতাশা—এসব ১৪ দিন বা তার বেশি সময় ধরে স্থায়ী হলে তাকে ডিজঅর্ডার বলা হয়। এর কম সময়ে সেরে গেলে সেগুলো খুব সাধারণ বিষয়। যেকোনো মানুষই রাগ, ক্ষোভ, বিষণ্নতাসহ এ ধরনের মানসিক অবস্থার মধ্য দিয়ে যেতে পারেন।
ভ্রান্ত ধারণা বনাম করণীয়
 মানসিক রোগীকে পরিবার ও সমাজ থেকে আলাদা রাখা: অনেকে মনে করেন মানসিকভাবে অসুস্থ ব্যক্তিকে পরিবার ও সমাজ থেকে আলাদা রাখা জরুরি। অথচ আদতে এমন ভাবনা ঠিক নয়। তাদের বাড়িতে রেখেও চিকিৎসা দিয়ে সুস্থ করে তোলা যায়। কেবল গুরুতর অসুস্থতার ক্ষেত্রে হাসপাতালে ভর্তি করাতে হয়।
 শিশুদের মানসিক রোগ নেই: এমন ধারণার বিপরীতে সত্য হলো, শিশুদেরও মানসিক রোগ হয়। তাদেরও অ্যাংজাইটি, ডিপ্রেশন, ফোবিয়া, অ্যাকটিভিটি ডিজঅর্ডার, কনভার্সন ডিজঅর্ডার, অবসেসিভ-কম্পালসিভ ডিজঅর্ডার, পোস্ট-ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিজঅর্ডার, সিজোফ্রেনিয়া প্রভৃতি হতে পারে। সাধারণত মানসিক রোগের প্রাথমিক লক্ষণ ১৪ বছর বয়সের আগেই দেখা দেয়। কখনো কখনো কারও কারও লক্ষণগুলো ২৪ বছর বয়সের আগেও হতে পারে। সঠিক চিকিৎসা পেলে বিকাশজনিত বিভিন্ন সমস্যা থেকে শিশুরা রক্ষা পেতে পারে।
 মানসিক রোগ কখনো সারে না: আধুনিক সময়ে এসেও অনেকে মনে করেন, এ ধরনের রোগের চিকিৎসা নেই। অথচ, সঠিক চিকিৎসা নিলে এ রোগ ভালো হয়, এমনটাই জানাচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা। মানসিক রোগে আক্রান্তরাও লেখাপড়া, স্বাভাবিক জীবনযাপন এবং সামাজিক বিভিন্ন কর্মসূচিতে অংশ নিতে পারেন।
 মানসিক রোগ মানুষের বানানো বিষয়: শরীরের অসুখ হলে মানুষ যতটা ব্যতিব্যস্ত হন, মনের অসুখ হলে হন না; বরং পাত্তাই দেন না অনেকে। তারা মনে করেন, মানসিক রোগের ভিত্তি নেই। এগুলো মানুষের বানানো বিষয়। কাজে আগ্রহ না পাওয়া, বিষণ্নতায় ভোগা, অতিরিক্ত মুড সুইং—এগুলো নানাভাবে প্রকাশ পায়। এসব মনোরোগ কোনোভাবেই বানানো বিষয় নয়। কাছের কিংবা পরিবারের কেউ মানসিকভাবে বিষণ্নতায় ভুগলে তাকে অভয় দেওয়া জরুরি। যেন তারা আত্মহত্যাপ্রবণ না হন, সে বিষয়ে খেয়াল রাখা আবশ্যক।
 মানসিকভাবে আক্রান্তরা বিপজ্জনক: ভুলে ভরা চিন্তাভাবনার কারণে অনেকে মনে করেন, মানসিকভাবে আক্রান্তরা বিপজ্জনক ও ভয়ংকর হয়ে থাকেন। অথচ এর যথাযোগ্য ভিত্তি নেই। তাদের মধ্যে বিভিন্ন ধরনের বিষণ্নতা, উদ্বেগ কাজ করে। দিনের পর দিন বিষণ্নতায় ভুগলে বাইপোলার ডিজঅর্ডার এবং সিজোফ্রেনিয়ার মতো সমস্যা তৈরি হতে পারে। তবে তারা সব সময় অন্যের জন্য বিপজ্জনক হবেন, এমন ধারণা ভুল। কেননা, বিপজ্জনক তো আপাতদৃষ্টে সুস্থ-স্বাভাবিক মানুষের পক্ষেও হওয়া সম্ভব!
 দুর্বল ব্যক্তিত্ব কিংবা নিজের দোষই কারণ: সমাজে প্রচলিত বিভিন্ন ভুল ধারণার মধ্যে একটি হলো দুর্বল ব্যক্তিত্ব কিংবা নিজের দোষে মানসিক রোগ হয়। অথচ সত্য হলো, মানসিক রোগের পেছনে জৈবিক ও পরিবেশগত উপাদান দায়ী। মানসিক আঘাত, বিভিন্ন ধরনের নির্যাতন থেকে ট্রমা, নেতিবাচক অভিজ্ঞতা, পারিবারিক কলহ ইত্যাদি নানা কারণে একজন ব্যক্তি মানসিক সমস্যার মধ্য দিয়ে যেতে পারেন।
 বন্ধুবান্ধব থাকলে সাইকোথেরাপিস্টের প্রয়োজন নেই: অনেকের ধারণা, মানসিক রোগের সমাধান বন্ধুবান্ধবের পক্ষেই দেওয়া সম্ভব। এর জন্য কাউন্সিলর, সাইকোথেরাপিস্ট কিংবা সাইকিয়াট্রিস্টের প্রয়োজন নেই। বন্ধুবান্ধব মানসিকভাবে ভালো রাখতে সহযোগিতা করে, এ কথা সত্য। কিন্তু সাইকোথেরাপিস্ট ও সাইকিয়াট্রিস্ট সমস্যাগুলোকে নিখুঁতভাবে চিহ্নিত করে মনোবৈজ্ঞানিক কৌশল প্রয়োগের মাধ্যমে তার সঠিক চিকিৎসা করেন। তাই দেরি না করে সাইকোলজিস্ট, সাইকোথেরাপিস্ট কিংবা সাইকিয়াট্রিস্টের সাহায্য নেওয়া চাই।
সুস্থতার পথ
সচেতনতাই মূল দাওয়াই। নিজস্ব, পারিবারিক সচেতনতার পাশাপাশি জনসচেতনতা দরকার। মানসিক অসুস্থতা ও মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে যত বেশি পাবলিক প্রোগ্রাম, আলোচনা হবে, মানুষ তত বেশি ধারণা পাবেন। ভ্রান্ত ধারণাগুলো তত দূর হবে। এ জন্য ক্যাম্পেইন করা যায়। ইনক্লুসিভ ল্যাঙ্গুয়েজ ব্যবহার করলে স্টিগমা কমবে। যেমন মানসিকভাবে অসুস্থ ব্যক্তিকে পাগল না বলে সাইকিয়াট্রিক প্যাশেন্ট বলা যেতে পারে। কাউকে পাগল বলে সম্বোধন করা স্টেরিওটাইপ মেন্টালিটি। কমিউনিকেশন প্রোগ্রামের মাধ্যমে বিষয়গুলো সমাধান করা যায়। সরকারি, বেসরকারি এনজিও, আইএনজিওসহ সবাই একত্রে যদি এ বিষয়গুলো নিয়ে কাজ করে, তাহলে ভ্রান্ত ধারণা কমবে। সচেতনতা বাড়বে।
এ ক্ষেত্রে আক্রান্ত ব্যক্তির নিজের ও তার পরিবারের সদস্যদের গুরুত্বপূর্ণ কিছু করণীয় রয়েছে:
 সাইকিয়াট্রিস্টের দ্বারস্থ হওয়া চাই। মানসিক স্বাস্থ্যের চিকিৎসা নিতে কুণ্ঠাবোধ করা অনুচিত। পরিবারের সদস্যদের উচিত মানসিক রোগে আক্রান্ত সদস্যদের প্রতি সহনশীল ও সমব্যথী হওয়া।
 আবেগ নিজের মধ্যে চেপে না রেখে প্রকাশ করতে হবে। অন্যের নেতিবাচক ধারণার মাধ্যমে প্রভাবিত হওয়া মানা।
 নিয়মিত ব্যায়াম করা শ্রেয়। সুষম খাবার গ্রহণ, ইতিবাচক চিন্তা, মেডিটেশন একজন ব্যক্তিকে ভালো রাখতে সাহায্য করে।
 মানসিক স্বাস্থ্যবিষয়ক বিভিন্ন সাপোর্ট গ্রুপে অংশ নেওয়া শ্রেয়। সেখানে দেওয়া বিভিন্নজনের পরামর্শ, একই মানসিকতার ব্যক্তিদের সঙ্গে খোলাখুলি আলোচনা কার্যকর হতে পারে।

 রিক্তা রিচি
ছবি: ইন্টারনেট

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top