ইভেন্ট I ত্রয়োবিংশ ঢাকা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব
১১ থেকে ১৯ জানুয়ারি ২০২৫। রাজধানীতে অনুষ্ঠিত হয়ে গেল ঢাকা ইন্টারন্যাশনাল ফিল্ম ফেস্টিভ্যালের ২৩তম আয়োজন। কেমন ছিল? জানাচ্ছেন লেখক ও চলচ্চিত্র সমালোচক বিধান রিবেরু
বাংলাদেশে এমনিতেই সাংস্কৃতিক উৎসব ও আয়োজন কমে আসছে দিন দিন। নানা কারণেই কমে আসছে। বাংলাদেশে যারা থাকেন তারা জানেন, পদে পদে প্রতিবন্ধকতা কাকে বলে। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজকেরা দিনরাত যখন লালনের গানটাই গাইতে থাকেন—‘সত্য কাজে কেউ নয় রাজি’—তখন এই ঢাকা নগরীতে, বলতে গেলে আহমেদ মুজতবা জামালের একক প্রচেষ্টায়, তার চৌকস দলের দক্ষতায় প্রতিবছর একটি করে সফল আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব উদ্যাপিত হচ্ছে।
১৯৭৭ সালে প্রতিষ্ঠিত রেইনবো ফিল্ম সোসাইটি এই উৎসবের আয়োজন করে আসছে ১৯৯২ সাল থেকে। মাঝে কয়েকটি আয়োজন দ্বিবার্ষিক হলেও বাকি সময় উৎসবটি বার্ষিক থেকেছে। তারই ধারাবাহিকতায় ২০২৫ সালের প্রারম্ভে ত্রয়োবিংশ ঢাকা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব হয়ে গেল। আর প্রতিবারের মতো এবারও মানুষ সাড়া দিয়েছে সিনেমার জাদুতে। রাজনৈতিক অস্থিরতা ও দ্রব্যমূল্য নিয়ে মানুষের নাভিশ্বাস দশার ভেতরেও যে উৎসবে মানুষ চলচ্চিত্র দেখতে এসেছে, সেটাই তো বড় পাওয়া। বাংলাদেশের মতো দরিদ্র দেশে, যেখানে চলচ্চিত্র কেন্দ্র নেই, ভালো প্রক্ষেপণ ব্যবস্থা নেই, সেখানে এমন মাপের উৎসব করা অনেকটা উজানের বিপরীতে নৌকা বাওয়ার মতোই। উৎসব আয়োজনের মতো কষ্টকর কাজের ভেতর আবার কত যে প্রতিকূলতা এসে সামনে পড়ে, তার কোনো ইয়ত্তা নেই। তারপরও আয়োজকেরা বদ্ধপরিকর, উৎসব বন্ধ করা যাবে না।
এবারের উৎসবটি শুরু হয় ১১ জানুয়ারি, জাতীয় জাদুঘর মিলনায়তনে, জলের গান দিয়ে। জলের মতোই সময় বয়ে যায়। ৯টা দিন দেখতে দেখতে শেষ হয় একদিন। এর ভেতর দেশি-বিদেশি চলচ্চিত্র দেখে মানুষের কী উচ্ছ্বাস! বিরক্তিও দেখেছি। অসূয়া দেখেছি। আবার সবকিছু ছাপিয়ে উৎসাহ ও উদ্দীপনাও দেখেছি। বিশেষ করে বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের প্রতি মানুষের আগ্রহ ছিল দেখার মতো। প্রতিদিন সন্ধ্যার শোতে বাংলাদেশের ছবি দেখার জন্য ছিল উপচে পড়া ভিড়। বিশেষ করে বলতে হয়—‘বলী’, ‘প্রিয় মালতী’, ‘ফাতিমা’ ও ‘নীলপদ্ম’-এর কথা। এসব ছবি ছাড়াও আরও একটি বিষয়ে চলচ্চিত্রপ্রেমীদের ছিল ব্যাপক আগ্রহ, সেটি হলো রুশ চলচ্চিত্র নির্মাতা আলেক্সেই ফেদোরচেনকোর রেট্রোস্পেকটিভে থাকা ছয়টি চলচ্চিত্র। চলচ্চিত্র বোদ্ধারা এই ছবিগুলো দেখে বেশ প্রশংসা করেছেন। শুধু তা-ই নয়, পরিচালক স্বয়ং ঢাকায় অবস্থান করছিলেন উৎসব চলাকালে। তিনি বুঝেছেন, ঢাকার চলচ্চিত্র বোদ্ধারা তার ছবির সঠিক কদর করতে পেরেছেন।
এ বছর ১০টি ভিন্ন ভিন্ন বিভাগে ৭৫টি দেশের ছোট ও বড় মিলিয়ে মোট ২০৩টি চলচ্চিত্র দেখানো হয় ঢাকার ৫টি ভেন্যুতে। উৎসবে সরাসরি অংশগ্রহণ করেন ৪৪ জন ভিনদেশি প্রতিনিধি। এ ছাড়া চীন ও বাংলাদেশের ৫০ বছরের কূটনৈতিক সম্পর্ক উদ্যাপন করা হয়। সে জন্য এবার উৎসবের ওয়াইড অ্যাঙ্গেল সেকশনের ফোকাস ছিল চীনা চলচ্চিত্রের ওপর। উদ্বোধনী সিনেমা হিসেবেও ছিল একটি চীনা চলচ্চিত্র; চিউ ঝ্যাং নির্মিত ‘মুন ম্যান’। এর পাশাপাশি জাতীয় জাদুঘরের প্রধান মিলনায়তন করিডরে আয়োজন করা হয় চীনা চলচ্চিত্রের পোস্টার প্রদর্শনীর।
চলচ্চিত্র উৎসব মানে কেবল চলচ্চিত্র প্রদর্শন নয়; যেকোনো আন্তর্জাতিক উৎসবের মতো ঢাকা উৎসবেও থাকে অনেক সমান্তরাল আয়োজন। যেমন উৎসবের ভেতর ১২ ও ১৩ জানুয়ারি, দুই দিনব্যাপী একাদশবারের মতো অনুষ্ঠিত হয় ‘সিনেমায় নারী’ শীর্ষক সম্মেলন। ঢাকা ক্লাবে সম্মেলনের প্রথম দিন প্রধান অতিথি ছিলেন সেন্ট্রাল উইমেন্স ইউনিভার্সিটির উপাচার্য ড. পারভীন হাসান। বিশেষ অতিথির বক্তব্য দেন ফারাহ কবির ও ঝ্যাং ইউডি। অনুষ্ঠানের সভাপতিত্ব করেন ঢাকা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবের চেয়ারপারসন প্রফেসর কিশওয়ার কামাল।
দুদিনের সম্মেলনে প্রবন্ধ পাঠ করেন চীনা লেখক ও নির্মাতা ঝ্যাং ইউডি, বাংলাদেশের সংগঠক নাঈমা চৌধুরী এবং ইরানের প্রযোজক ও পরিবেশক মেহনাজ তাফাগি। এ ছাড়া এই সম্মেলনে আলোচক ছিলেন চীনের রেইনবো ফং, বাংলাদেশের লিসা গাজী, ফারাহ কবির, ড. তৌফিক এলাহী, চৈতালী সোমাদ্দার, ড. রাশেদা রওনাক খান ও সাদিয়া খালিদ ঋতি।
তৃতীয়বারের মতো ১৭ ও ১৮ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত হয় মাস্টারক্লাস। গতবার মাজিদ মাজিদি ও অঞ্জন দত্তের মতো মানুষ মাস্টারক্লাসে এসেছিলেন। এবার প্রথম দিন মাস্টারক্লাস নেন বাংলাদেশের প্রখ্যাত সিনেমাটোগ্রাফার রাশেদ জামান। তার বক্তৃতার শিরোনাম ছিল ‘সিনেমাটোগ্রাফি: জার্নি অব আ ভিজুয়াল স্টোরিটেলার’। দ্বিতীয় দিনের মাস্টারক্লাসে প্রথম কথা বলেন সার্বিয়ার চলচ্চিত্রবিষয়ক শিক্ষক ও নির্মাতা ড্র্যাগান মিলিনকোভিচ ফিমন। তিনি কথা বলেন বিদ্যালয়ে চলচ্চিত্র অধ্যয়নের গুরুত্ব নিয়ে। তারপর কথা বলেন চীনের নির্মাতা ও লেখক ঝ্যাং ইউডি। তিনি সিনেমা নির্মাণের প্রক্রিয়া নিয়ে কথা বলেন। শেষ সেশনে কথা বলেন অগি হোফার্ট। তিনি নরওয়ের চলচ্চিত্র পরিবেশক; কথা বলেন আন্তর্জাতিক বাজারে চলচ্চিত্রকে কীভাবে বাণিজ্যিকভাবে প্রদর্শন ও পরিবেশন করা যায়, সেটি নিয়ে।
এবারের উৎসবে আরও একটি সমান্তরাল আয়োজন ছিল। আলিয়ঁস ফ্রঁসেজে চিত্রকলা প্রদর্শনী। ৯ জানুয়ারি শুরু হয় বিশেষ দলীয় চিত্রকলা প্রদর্শনী, ‘পার্সপেকটিভ—আ কনটেম্পরারি গ্রুপ আর্ট এক্সিবিশন’। উদ্বোধন করেন আলিয়ঁস ফ্রঁসেজ দো ঢাকার ডিরেক্টর ফ্রাঁসোয়া গ্রুজ। এ ছাড়া শুভেচ্ছা বক্তব্য দেন উৎসব পরিচালক আহমেদ মুজতবা জামাল এবং প্রদর্শনীর তত্ত্বাবধায়ক চিত্রশিল্পী লুতফা মাহমুদা। বাংলাদেশের বরেণ্য চিত্রশিল্পীদের চিত্রকর্ম এই প্রদর্শনীতে স্থান পায়। প্রদর্শনী চলে ১৭ জানুয়ারি পর্যন্ত।
৯ দিনব্যাপী এই বিপুল যজ্ঞের প্রস্তুতি আসলে চলে বছরজুড়েই। ছবি দেখে বাছাই করা থেকে শুরু করে উৎসবের বিভিন্ন খুঁটিনাটি দেখভালের জন্য নিরন্তর কাজ করে যায় উৎসব টিম। তবে সমর্থন ছাড়া এই উৎসব আয়োজন করা প্রায় অসম্ভব কাজ। সরকারিভাবে উৎসবকে নানাভাবে সহায়তা দেওয়া হয়; এগিয়ে আসে বিভিন্ন দেশের দূতাবাস ও তাদের সংস্কৃতিবিষয়ক শাখা। আর উৎসবের প্রাণ হলো দর্শক। তারা না এলে উৎসবের আমেজে ভাটা পড়ে। আলাদা করে গণমাধ্যমের কথা না বললেই নয়। মিডিয়া যথাসাধ্য চেষ্টা করে বাংলাদেশের বৃহৎ এই চলচ্চিত্র উৎসবের খবর দেশ ও বিদেশে ছড়িয়ে দিতে। সাংবাদিকেরাও উৎসবের প্রতিটা দিন খবর সংগ্রহ করতে ব্যস্ত থাকেন। সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টাতেই একটি উৎসব সফলভাবে শেষ হয়।
তো চলুন দেখে নিই, ত্রয়োবিংশশতম ঢাকা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে পুরস্কারপ্রাপ্ত চলচ্চিত্র ও কলাকুশলীদের নাম।
পুরস্কার বিজয়ীদের তালিকা
চিলড্রেন ফিল্ম সেকশনের বাদল রহমান অ্যাওয়ার্ডটি পেয়েছে মাইকেল লুকাচেভস্কি পরিচালিত রাশিয়ান সিনেমা ‘হয়্যার দ্য হোয়াইট ক্রেনস ড্যান্স’। স্পেশাল অডিয়েন্স অ্যাওয়ার্ড পেয়েছে জোসেলিতো আলতারেজোস নির্মিত ফিলিপাইনের সিনেমা ‘দ্য গার্ডিয়ান অব অনার’। বেস্ট অডিয়েন্স অ্যাওয়ার্ড সৃজিত মুখার্জি পরিচালিত ভারতীয় সিনেমা ‘পদাতিক’। উইমেন ফিল্মমেকার সেকশনে স্পেশাল মেনশন অ্যাওয়ার্ড পেয়েছে ক্লাভদিয়া করশুনোভা পরিচালিত মলদোভা ও রাশিয়ার যৌথ প্রযোজনার সিনেমা ‘নট জাস্ট অ্যানি ডে’। একই সেকশনের বেস্ট শর্ট ফিল্ম অ্যাওয়ার্ড পেয়েছে মারিয়া বোবেভা নির্মিত বুলগেরিয়ার সিনেমা ‘স্কারলেট’। বেস্ট ফিচার ফিল্ম অ্যাওয়ার্ডপ্রাপ্ত সিনেমাটি ছিল সারাহ মালেগোল নির্মিত ফ্রান্সের সিনেমা ‘কুম্ভ, হুইচ কামস ফ্রম সাইলেন্স’। বেস্ট ডিরেক্টর অ্যাওয়ার্ডপ্রাপ্ত সিনেমা ‘আওয়ার ওন শ্যাডো’; পরিচালক অগুস্তিনা সানচেজ গ্যাভিয়ার। এটি আর্জেন্টিনা ও জার্মানির যৌথ প্রযোজিত সিনেমা। স্পিরিচুয়াল ফিল্ম সেকশনের বেস্ট শর্ট ফিল্ম অ্যাওয়ার্ডটি পায় লুইস ক্যাম্পস পরিচালিত পর্তুগিজ সিনেমা ‘মন্টে ক্লেরিগো’। একই বিভাগের স্পেশাল মেনশন অ্যাওয়ার্ড পায় অভিলাষ শর্মা নির্মিত ভারতীয় সিনেমা ‘ইন দ্য নেম অব ফায়ার’ এবং বেস্ট ফিচার ফিল্ম অ্যাওয়ার্ড জিতে নেয় ইভান সসনিন পরিচালিত রাশিয়ান সিনেমা ‘দ্য অ্যালিয়েন’।
বাংলাদেশ প্যানোরামার ট্যালেন্ট সেকশনে ৩টি সিনেমা পুরস্কৃত হয়। সেকেন্ড রানারআপ সিনেমাটি মোবারক হোসেন নির্মিত ‘পৈতৃক ভিটা’। ফার্স্ট রানারআপ সিনেমাটি আসিফ ইউ হামিদ পরিচালিত ‘ফুলেরা পোশাক পরে না’। ফিপ্রেসি জুরির মাধ্যমে প্রদত্ত বেস্ট ফিল্ম অ্যাওয়ার্ড পায় চলচ্চিত্র পরিচালক মনন মুনতাকা নির্মিত ‘আ লেজি নুন’। বাংলাদেশ প্যানোরামা সেকশনে পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রে ফিপ্রেসি জুরির মাধ্যমে প্রদত্ত বেস্ট ফিল্ম অ্যাওয়ার্ড পায় চলচ্চিত্র পরিচালক শঙ্খ দাশগুপ্ত নির্মিত ‘প্রিয় মালতী’।
এশিয়ান ফিল্ম কম্পিটিশন সেকশনের বেস্ট স্ক্রিপ্টরাইটার অ্যাওয়ার্ড পান তাকাতো নিশি ও নোরিকো ইয়ুয়াসা; তাদের সিনেমা ‘পারফর্মিং কায়োরু’স ফিউনারেল’-এর জন্য। এটি জাপানি সিনেমা। এই সেকশনের বেস্ট সিনেমাটোগ্রাফি অ্যাওয়ার্ড পান সিনেমাটোগ্রাফার দিলসাত কানান; সিনেমার নাম ‘হোয়েন দ্য ওয়ালনাট লিভস টার্ন ইয়েলো’, পরিচালক মেহমেত আলি কনার। এটি তুর্কি সিনেমা। বেস্ট অ্যাকট্রেস অ্যাওয়ার্ড পান দিমান জান্দি, তার অভিনীত ইরানি ও তাজিকিস্তান প্রযোজিত ‘মেলোডজ’ সিনেমার জন্য। সিনেমাটির পরিচালক বেহরুজ সেবত রাসুল। বেস্ট অ্যাক্টর অ্যাওয়ার্ডটি জিতে নেন রায়ান সারলাক, তার অভিনীত ইরানি সিনেমার নাম ‘সামার টাইম’। সিনেমাটি পরিচালনা করেন বিখ্যাত ইরানি চলচ্চিত্র পরিচালক ও সিনেমাটোগ্রাফার মাহমুদ কালারি। এই বিভাগে মাহমুদ কালারি বেস্ট ডিরেক্টর হিসেবে স্পেশাল মেনশন অ্যাওয়ার্ড পান একই সিনেমার জন্য। এ ছাড়া চীনা চলচ্চিত্র পরিচালক হাওফেং শু ও চাওফেং শু বেস্ট ডিরেক্টর অ্যাওয়ার্ডটি পান তাদের সিনেমা ‘হান্ড্রেড ইয়ার্ডস’-এর জন্য। এশিয়ান ফিল্ম কম্পিটিশন সেকশনের বেস্ট ফিল্ম অ্যাওয়ার্ড জিতে নেয় শকির খলিকভ পরিচালিত উজবেকিস্তানি সিনেমা ‘সানডে’।
সমাপনী সিনেমা হিসেবে প্রদর্শিত হয় ইকবাল এইচ চৌধুরী পরিচালিত সিনেমা ‘বলী’। এটিই ছিল ‘বলী’র বাংলাদেশ প্রিমিয়ার।
ছবি: সংগ্রহ