ফিচার I জার্সির কথকতা
বিশ্বকাপে বলের লড়াইয়ের সমান্তরালে চলবে জার্সির লড়াইও। তারই ইতিবৃত্ত প্রদীপ দেবনাথের লেখায়।
দরজায় কড়া নাড়ছে ফিফা বিশ্বকাপ ফুটবল ২০১৮। সবকিছু ভুলে সারা বিশ্বের সব আকর্ষণ এখন রাশিয়ায়। ক্লাবের ব্যস্ততা ভুলে মেসি, রোনালদো আর নেইমাররা এবার মাঠে নামবেন দেশের হয়ে। সবকিছু ছাপিয়ে হলুদ, আকাশি নীল কিংবা লাল- এ রংগুলো মাঠের সঙ্গে সঙ্গে মিশে থাকবে গ্যালারিজুড়ে। খেলোয়াড়দের পাশাপাশি দর্শকেরাও পরবে তাদের জাতীয় গর্বের জার্সি। আর এ জার্সি ঘিরে এরই মধ্যে জমে উঠেছে শতকোটি ডলারের বৈশ্বিক বাণিজ্য। বিশ্বের জার্সি প্রস্তুতকারী নামি ব্র্যান্ডগুলো প্রতিবারের মতো এবারও প্রতিযোগিতায় নেমেছিল- কারা এবার তাদের লোগো বুকের বাম পাশে নিয়ে মাঠে নামবে।
বিশ্বের নানা ব্র্যান্ডের মধ্যে বরাবরের মতো এবারও এগিয়ে থাকছে ক্রীড়াসামগ্রী প্রস্তুতকারী জার্মান প্রতিষ্ঠান অ্যাডিডাস। এবারের বিশ্বকাপের ৩২ দলের মধ্যে ১২টি দলই অ্যাডিডাসের জার্সি পরে মাঠে নামবে। এদের মধ্যে আছে বর্তমান বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন জার্মানি। এ ছাড়া অ্যাডিডাসের দলে আরও আছে দুবারের বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন লিওনেল মেসির আর্জেন্টিনা ও ২০১০ সালের চ্যাম্পিয়ন স্পেন। এখানেই শেষ নয়, আছে বেলজিয়াম, মিসর, মরক্কো, জাপান, ইরান, কলম্বিয়া, মেক্সিকো, সুইডেন ও স্বাগতিক রাশিয়া। এর আগে ২০১৪ সালে এদের মধ্যে ৯টি দেশের পৃষ্ঠপোষক ছিল জার্মান প্রতিষ্ঠানটি। ২০১০ সালে দক্ষিণ আফ্রিকা বিশ্বকাপে ১২টি এবং আশ্চর্যজনকভাবে ২০০৬ সালের জার্মানি বিশ্বকাপে মাত্র ৬টি দেশ অ্যাডিডাসের জার্সি পরে খেলে।
বেশির ভাগ ফুটবল ভক্তের জন্য অবশ্য ফিফা বিশ্বকাপ আর অ্যাডিডাস সমার্থক হয়ে আছে। তিন দাগের এই প্রতীকটি ১৯৭৪ সাল থেকে আছে ফুটবল বিশ্বকাপের সঙ্গে। তবে, সেটা শুধু জার্সি দিয়ে নয়, বরং বল, রেফারি ও স্বেচ্ছাসেবকদের পোশাক এবং ভেন্যুতে অফিশিয়াল সামগ্রীতে থাকে অ্যাডিডাসের প্রতীক। এবারের বিশ্বকাপে অ্যাডিডাসের পরেই রয়েছে তাদের সব সময়ের প্রতিদ্বন্দ্বী মার্কিন প্রতিষ্ঠান নাইকি। রাশিয়ায় ১০টি দেশ নাইকির তৈরি জার্সি পরে মাঠে নামবে। পাঁচবারের বিশ্বজয়ী ব্রাজিল, ১৯৬৬ সালের চ্যাম্পিয়ন ইংল্যান্ড, ১৯৯৮-এর চ্যাম্পিয়ন ফ্রান্স ছাড়াও আছে অস্ট্রেলিয়া, ক্রোয়েশিয়া, নাইজেরিয়া, পোল্যান্ড, সৌদি আরব, দক্ষিণ কোরিয়া ও পর্তুগাল। তবে, নাইকির জন্য সবচেয়ে বড় ক্ষতি হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র, চিলি ও হল্যান্ডের কোয়ালিফাই না করা। তা না হলে এবার হয়তো অ্যাডিডাসকে ছাড়িয়ে তারা। বিগত দুটো বিশ্বকাপেও তাদের দলসংখ্যা ছিল ১০টি। আর ২০০৬ সালে ছিল ৮টি।
রাশিয়া বিশ্বকাপে সবচেয়ে হতাশ করেছে বিশ্বখ্যাত প্রতিষ্ঠান পিউমা। লাফানো বাঘটি অবশ্য সব সময়ই ভরসা করত পাঁচবারের বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন ইতালির ওপর, যারা কিনা পিউমার সবচেয়ে বেশি বিক্রীত জাতীয় দলের জার্সি। এ ছাড়া তাদের পৃষ্ঠপোষকতা নেওয়া আফ্রিকান দলগুলোও এবার বাছাই পর্বের বৈতরণি পার হতে ব্যর্থ হয়। ফলে উরুগুয়ে ও সুইজারল্যান্ড ছাড়া আর কেউ নেই এবার পিউমার পক্ষে। অথচ বিশ্বকাপের ইতিহাস বলছে, অ্যাডিডাস ও নাইকির সঙ্গে সমান তালে লড়েছে তারা বাজার দখলের জন্য। ২০০৬ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত যথাক্রমে ১২, ৭ এবং ৮টি দেশের স্পন্সর ছিল এই জার্মান প্রতিষ্ঠান।
রাশিয়া বিশ্বকাপে উত্তর আমেরিকার কোস্টারিকা এবং নবাগত পানামা সঙ্গে আছে নিউ ব্যালেন্স এবং আমব্রো পৃষ্ঠপোষকতা করছে পেরু ও সার্বিয়ার।
এদের বাইরে রাশিয়ার বিশ্বকাপে দেখা যাবে আরও কয়েকটি প্রতিষ্ঠানকে। প্রথমবার বিশ্বকাপে খেলা আইসল্যান্ড পরবে ইতালিয়ান কোম্পানি এয়িরার জার্সি। ডেনমার্ক পরবে হামেল এবং তিউনিসিয়াা স্পন্সর ফ্রান্সের উহলস্পোর্ট। সেনেগাল মাঠে নামবে রোমাই-এর জার্সি গায়ে। যদিও শোনা যাচ্ছে তেরাঙ্গার সিংহরা রোমাই-এর ওপর অখুশি। বিশ্বকাপের আগে দলটি আমব্রোর সঙ্গে বছরে তিন মিলিয়ন ডলারের চুক্তি করছে বলেও খবর বাতাসে ভাসছে। আর তা হলে দুই হীরের প্রতীকের জার্সিধারীর সংখ্যা হবে তিন।
ফিফা বিশ্বকাপে অংশগ্রহণকারী দেশগুলোর জার্সির পৃষ্ঠপোষকতা অনেক বড় বাণিজ্য। আর এ বাণিজ্যে বড় দেশগুলোর পৃষ্ঠপোষকতার জন্য কাঁড়ি কাঁড়ি অর্থ নিয়ে মাঠে নামে ক্রীড়াসামগ্রী প্রতিষ্ঠানগুলো। জয়ীরা খেলোয়াড়দের জার্সিতে বুকের বাম পাশে তাদের প্রতীক দেখানোর পাশাপাশি অন্যান্য সামগ্রীতে নিজেদের লোগো ব্যবহারের স্বত্ব পায়। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো এর মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানটি ওই দলের রেপ্লিকা জার্সি এবং অন্যান্য ফুটবল ভক্তদের কাছে বিক্রির স্বত্ব পায়। ১৯৭৪ সালের বিশ্বকাপে শুরু হওয়া এ স্পন্সরশিপের বাজারমূল্য বর্তমানে শতকোটি ডলার।
অ্যাডিডাস হচ্ছে প্রথম ব্র্যান্ড, যারা এ বাণিজ্যের প্রচলন করে। ১৯৭৪ সালের বিশ্বকাপে অংশ নেওয়া ১৬টি দেশের মধ্যে ১০টি দেশই অ্যাডিডাসের জার্সি গায়ে মাঠে নেমেছিল। সেই থেকেই জার্মান প্রতিষ্ঠানটি এ ক্ষেত্রে আধিপত্য দেখিয়ে আসছে। ১৯৭৪ সালের জার্মানি বিশ্বকাপ থেকে ১৯৯০ সালের ইতালি বিশ্বকাপ পর্যন্ত প্রতিষ্ঠানটি অর্ধেকের বেশি অংশগ্রহণকারী দেশের জার্সিতে পৃষ্ঠপোষকতা করেছে। যদিও সময় গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে নাইকি ও পিউমার মতো ব্র্যান্ডগুলো অ্যাডিডাসের বড় প্রতিযোগী হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে।
ফিফা বিশ্বকাপে এখন পর্যন্ত ১২৭ দেশের জার্সি এবং অন্যান্য সামগ্রীর স্পন্সর করেছে অ্যাডিডাস। তাদের সবচেয়ে কাছে থাকা নাইকি পৃষ্ঠপোষক ৫০টি দলের। এরপর আছে পিউমা; ৪৪টি দলের সঙ্গে। ১৯৭৪ সাল থেকে শুরু করে ২০১৬ সালের ব্রাজিল বিশ্বকাপ বাদে সব আসরে আমব্রো মোট ২২টি দেশের জার্সির পৃষ্ঠপোষকতা করেছে। যেখানে তাদের শুরুটা ছিল ইংল্যান্ড ও স্কটল্যান্ডকে দিয়ে। এরপর রয়েছে ইতালিয়ান ব্র্যান্ড লোটো; এরা মোট ৯টি দেশের পৃষ্ঠপোষকতা করেছে। লে কক স্পোর্টিফ ৭, হামেল, জোমা ও রিবক ৪, কাপ্পা, ম্যারাথন, টপার ও উহল স্পোর্ট ৩টি করে দলের সঙ্গে ছিল। এ ছাড়া দুটি করে দলের স্পন্সর করেছে অ্যাডমিরাল, নিউ ব্যালেন্স এবং রেপিডো। আর একটি করে দলের পৃষ্ঠপোষকতা করেছে আবা স্পোর্ট, অ্যাসিক্স, অ্যাতলেটিকো, ব্রুকস স্পোর্ট, বার্ডা স্পোর্ট, এরিমা, এরা, লেগা, লিভাইস, মিটরে, পেনাল্টি, রাইয়ানা, শামিল, সনিটেক্স এবং উইকেন্ড। এখন পর্যন্ত ১৩টি দল কোনো ধরনের প্রতীক ছাড়াই তাদের জার্সি গায়ে মাঠে নেমেছে।
সবচেয়ে বেশি দলের পৃষ্ঠপোষকতা থাকায় স্বভাবতই বিশ্বকাপ জয়ী দলগুলোর স্পন্সরশিপে এগিয়ে রয়েছে অ্যাডিডাস। সর্বোচ্চ ৫টি বিশ্বকাপজয়ী দলের জার্সিতে ছিল অ্যাডিডাস। এরা হলো ২০১৪ সালে জার্মানি, ২০১০ সালে স্পেন, ১৯৯৮ সালে ফ্রান্স, ১৯৯০ সালে পশ্চিম জার্মানি এবং ১৯৭৮ সালে আর্জেন্টিনা। স্পন্সর-বাণিজ্য শুরুর পর কোনো ধরনের প্রতীক ছাড়াই বিশ্বকাপ ঘরে নিয়েছে ১৯৭৪ সালে পশ্চিম জার্মানি এবং ১৯৮২ সালে ইতালি। আশ্চর্যজনকভাবে নাইকি মাত্র একবার ২০০২ সালে ব্রাজিলের মাধ্যমে এ গৌরব অর্জন করে। এর আগে ব্রাজিল ১৯৯৪ সালে আমব্রোর জার্সি গায়ে বিশ্বকাপ জয় করে। ২০০৬ সালে ইতালি পিউমার এবং আর্জেন্টিনা ১৯৮৬ সালে লে কক স্পোর্তিফের জার্সিতে বিশ্বকাপ জয় করে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, এবারের বিশ্বকাপ জিতবে কারা?
এখন পর্যন্ত সর্বোচ্চ ৬টি প্রতিষ্ঠানের লোগো ব্যবহার করে শীর্ষে রয়েছে মেক্সিকো। ৫টি লোগো ব্যবহার করে তাদের পরেই আছে বেলজিয়াম। আর ব্রাজিল ব্যবহার করেছে নাইকি, টপার, আমব্রো ও অ্যাডিডাসের মতো ৪টি ব্র্যান্ড।
এবার দেখা যাক, শতকোটি ডলার মূল্যের এ বাণিজ্যের শুরুটা হয় কীভাবে। সে জন্য আমাদের ফিরতে হবে ১৯৭৪ সালের আগে। এর সঙ্গে রয়েছেন বেন প্যাট্রিক; এই নামটা পরিচিত নয় সবার কাছে। বেন প্যাট্রিক ছিলেন নিটওয়্যার নির্মাতাপ্রতিষ্ঠান অ্যাডমিরালের চেয়ারম্যান। তখনকার ইংলিশ ক্লাব লিডস ইউনাইটেডের ম্যানেজার ছিলেন ডন রভি; তিনি পরে ইংল্যান্ড জাতীয় দলের ম্যানেজার হন। তাঁর কাছেই প্রথমবারের মতো অর্থের বিনিময়ে দলের জার্সিতে নিজের প্রতিষ্ঠানের লোগো ব্যবহারের প্রস্তাব দেন প্যাট্রিক। সেই সঙ্গে সমর্থকদের জার্সিতেও নিজ প্রতিষ্ঠানের প্রতীক ব্যবহারের অনুমতি চান তিনি।
১৯৭০ সালে লিডস ইউনাইটেডের সঙ্গে এ ব্যাপারে একটি চুক্তি সম্পন্ন করেন প্যাট্রিক। চুক্তি অনুযায়ী ক্লাবটির ট্রাকস্যুট তৈরি করে দেয় অ্যাডমিরাল। পরে ১৯৭৩ সালে ১৫ হাজার পাউন্ডের বিনিময়ে ইংল্যান্ড দলের স্বত্ব পায় অ্যাডমিরাল। মূলত এটিই ছিল কোনো জার্সিতে বাণিজ্যিকভাবে কোনো প্রতিষ্ঠানের প্রতীক ব্যবহারের সূচনা।
দলগুলোর মতোই ভক্তরা একই ধরনের জার্সি পরায় আমি বাণিজ্যের একটি সুযোগ দেখেছিলাম। ২০১৪ সালে ব্রিটিশ গণমাধ্যম দি টেলিগ্রাফকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে এমনটি বলেছিলেন প্যাট্রিক। তিনি আরও বলেন, সদ্যই আমরা বিশ্বকাপ জয় করায় এবং রঙিন টেলিভিশনের আবির্ভাব আমাদের রঙিন জার্সির প্রতি আকৃষ্ট করেছিল।
এরপরের ইতিহাস আরও লম্বা। ব্রিটিশ পার্লামেন্টে এ নিয়ে তুমুল বিতর্ক হয় এবং ব্রিটিশ গণমাধ্যম বিবিসি এফএ কাপের ফাইনাল সম্প্রচার না বাতিল করার হুমকি দেয়। কেননা চ্যানেলটির তখন বিজ্ঞাপন প্রচার নিষিদ্ধ ছিল। তাই তারা অন্য কোনো প্রতিষ্ঠানের লোগো বিনা ব্যবসায়িক স্বার্থে প্রচার করতে রাজি ছিল না। পরে শুধু জার্সির পেছনে লোগো ব্যবহারের শর্তে এফএ কাপের ফাইনাল প্রচার করে বিবিসি।
এরপরই জার্সির বাণিজ্যের শুরু। অ্যাডমিরালের পরপরই আমব্রো এ বাণিজ্যে প্রবেশ করে। এরপর একে একে আসতে থাকতে অ্যাডিডাস, পিউমা আর নাইকির মতো প্রতিষ্ঠানগুলো।
অবাক করা বিষয়, বর্তমানে এ বাণিজ্য এতটাই সম্প্রসারিত হয়েছে যে ১৯৭৪ সালে মাত্র ১৫ হাজার পাউন্ডের বিনিময়ে অ্যাডমিরাল নেয় ইংলিশ দলের জার্সির স্বত্ব। অথচ ২০১৮ সালে এসে নাইকিকে একই কারণে গুনতে হয় ২৫ মিলিয়ন পাউন্ড। আর তখনকার ৫ পাউন্ডের একটি জার্সি এখন বিক্রি হয় ৯০ পাউন্ডে।
এখন ক্লাব আর জাতীয় দলের জার্সির স্বত্বমূল্য দলগুলোর আয়ের বড় উৎস। এখন জার্সি শুধু খেলার মধ্যেই থেমে নেই, এটি এখন বৈশ্বিক ফ্যাশনেরও অনুষঙ্গ।
ছবি: সংগ্রহ