আমি বাদী, আমি বিবাদী I কফি কালচার
‘দোস্ত, let’s meet at North-end’. ‘ডিনারের পর চল গ্লোরিয়া জিনসে বসে আড্ডা দিই।’ ‘have you checked out this new place, crème del e crème? Their coffee is good.’ এই নতুন ক্যাফে কালচার দেখে আমি খুব অবাক হই না। তবে বিষয়টা আমাকে ভাবায় বৈকি। প্রথমত কবে থেকে আমরা এত কফি খাওয়া শুরু করলাম? সারা জীবন কড়া জ্বাল দেওয়া দুধ-চা খেয়েছি, এখন ‘চা টাইম’-এ গিয়ে দেখি পরিচিত দুধ চা’টাই নাই। তা বেশ ক’বছর হলো বিভিন্ন অফিসে মিটিংয়ে গেলে জিজ্ঞাসা করে, ‘স্যারকে কি গ্রিন টি দেব?’ আমি আঁতকে উঠি ওই বিস্বাদ পানীয়র কথা ভেবে। তারপর, বয়স আর পারিপার্শ্বিকতার চাপে মিউমিউ করে আমিও বলি, ‘জি না, গ্রিন টির দরকার নেই, শুধু লিকার দেবেন, চিনি ছাড়া।’ সেও বিস্বাদ কম নয়, তারপরও মুখ হাসি হাসি করে গিলে নিই। এর মধ্যেও নানা রকম আছে আবার। আরেকটু জাতে উঠে গেলে চায়েরও রকমভেদ আছে। ধরুন, বহুদিন বাদে কোনো পুরোনো বন্ধুর সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। বন্ধু জোর করে নিয়ে গেল তার ফাইভ স্টার অফিসে। জিজ্ঞাসা করলো, ‘বল, কী নিবি?’ আপনি বন্ধুর আধুনিক অফিসের ঠান্ডা রুমের নরম সোফায় ডুবতে ডুবতে অপ্রস্তুত অবস্থাতেই বললেন, ‘এই অসময়ে আর কী নেব, দে, একটু চা দে।’ আপনি অবাক হয়ে দেখলেন, বন্ধু আরদালিকে ডেকে বললো, ‘আমাদের জন্য এক কেটলি গরম পানি আর দুটো কাপ দাও।’ আপনি ভাবছেন, ‘চাইলাম চা, আর অর্ডার হলো পানি? কী জানি হবে হয়তো। আধুনিক অফিস বলে কথা, এরা বোধ হয় গরম পানিকেই আজকাল চা বলছে।’ ঠিক তখনই আপনাকে আবারও অবাক করে দিয়ে আপনার বন্ধু কোত্থেকে যেন বের করলো এক আধুনিক খোয়াজ খিজিরের সিন্দুক। এরই মধ্যে আবার গরম পানি আর কাপও চলে এসেছে। বন্ধু সেই সিন্দুক খুলতেই বেরিয়ে এলো থরে থরে সাজানো পৃথিবীর নানা পদের চায়ের প্যাকেট। ‘নে, পছন্দমতো তুলে নে, কোনটা খাবি।’ বন্ধু তো বলে খালাস, কিন্তু আপনি ভাবছেন, এর কোনোটাই তো আপনি চেনেন না। এখন নেবেন কী? শেষ পর্যন্ত সেই আধুনিক বন্ধুটাই উদ্ধারকর্তা। নিজেই বাক্স থেকে একটা হালকা হলুদ প্যাকেট উঠিয়ে দিয়ে বললো, ‘নে, তুই বরং আর্ল গ্রে’টাই ট্রাই কর।’ ট্রান্সপারেন্ট কাপে সেই টি-ব্যাগ ছাড়তেই আস্তে আস্তে গরম পানির রং হয়ে উঠলো হালকা সোনালি, আর নাকে এসে ঠেকলো মিষ্টি এক সুবাস। আপনিও সেই নরম সোফায় বসে পায়ের উপর পা তুলে গরম গরম আর্ল গ্রে’র কাপে চুমুক দিয়ে বলে উঠলেন, ‘আহ্, নট ব্যাড।’ এভাবে রোজই নানান জায়গায় নানান মানুষের কারণে আমাদের উত্তরণ ঘটছে লিকার চা থেকে আর্ল গ্রেতে, অথবা পরিচয় হচ্ছে ক্যাপাচিনো, লাতে কিংবা মোকাচিনোর সঙ্গে।
আজকের বাংলাদেশের জনগোষ্ঠীর একটা বিশাল অংশই তরুণ-তরুণী, তাদের তো সৃষ্টিসুখের উল্লাস করবার মতো জায়গা চাই। যেখানে তারা কথা বলবে, ঝগড়া করবে, হাসতে হাসতে একজন আরেকজনের উপর গড়িয়ে পড়বে। আজকের ঢাকা শহরের ক্যাফেগুলো বোধ হয় ওই তরুণ-তরুণীদের সেই জায়গার অভাব পূরণ করছে। দুটো ক্যাপাচিনো অর্ডার করে দুজন হয়তো কাটিয়ে দিল দুই ঘণ্টা একটা প্রেজেন্টেশনের পেছনে, কিংবা হয়তো কফির কাপেই ওই ক্যাফেতে বসে হয়ে গেল নেক্সট স্টার্ট আপের প্ল্যান। আবার সাত দিনে সাত কাপ লাতে দিয়েই হয়তো হয়ে গেল বন্ধুত্ব থেকে প্রণয়। আর আজকালকার ক্যাফেগুলোতেও বসে থাকবার কোনো সময়সীমা বেঁধে দেওয়া নেই, চাইলেই বসে থাকা যায় অনন্তকাল আর এঁকে ফেলা যায় ভবিষ্যতের স্বপ্ন কিংবা পরিকল্পনা। আধুনিক সমাজে, এই সোশ্যাল মিডিয়ায় ভার্চ্যুয়াল বন্ধুত্বের যুগে, ক্যাফেগুলোই বোধ হয় মুখোমুখি বসবার শ্রেয়তর আশ্রয়। তবু দেখা যাক, অপরিচিত দুজন মানুষের মধ্যে চোখের ভাষায় হৃদয়ের আদান-প্রদান হোক, অনেক দিন পর হঠাৎ দেখা বন্ধুকে জড়িয়ে ধরে জিজ্ঞাসা করা হোক, ‘বন্ধু, কী খবর বল, কত দিন দেখা হয়নি’। আজ এই তরুণোত্তর বয়সেও হঠাৎ কোনো ক্যাফেতে ঢুকে চারদিকে উজ্জ্বল তরুণ মুখগুলোর হাসি দেখলে, হঠাৎ কোনো টেবিল থেকে চিৎকার শুনলে যেন এই যুগের নব্য মধুর ক্যানটিনেরই দেখা মেলে। এক কোণে কোনো একটা টেবিলে বসে এক কাপ ক্যাপাচিনো অর্ডার করে, এই তরুণদের দেখি আর প্রার্থনা করি- এই হাসি, এই উত্তেজনা, এই প্রাণশক্তি যেন কখনো মিলিয়ে না যায়।
কিন্তু মধুর ক্যানটিন কিংবা মগবাজারের কফি হাউস তো আগেও ছিল, তাহলে এত বছর পরে এসে হঠাৎ এই ক্যাফেগুলোর এত বাড়বাড়ন্ত কেন? মনে প্রশ্ন জাগে। তিনটা কারণ আমার কাছে জরুরি বলে মনে হয়। প্রথমত তরুণ-তরুণীরা সংখ্যায় এখন অনেক বেশি এবং খোলা মাঠের সংখ্যা অনেক কমে গেছে। তাই ক্যাফের কদর অনেক বেড়েছে। দ্বিতীয়ত, আজকের এই ইন্টারনেট আর ক্যাবল টিভি সমৃদ্ধ বিশ্বায়নের জমানায়, সমস্ত পৃথিবীর তরুণ সম্প্রদায়ের জীবনযাপনের ধরন সবার জানা। তাই পশ্চিমের তরুণ সমাজের ক্যাফে ঘিরে যে লাইফস্টাইল তৈরি হয়েছে, সেই হাওয়া ঢাকায় এসেও লেগেছে। পশ্চিমা জীবনযাপনের প্রতিচ্ছবি যেন আজকের ঢাকার ক্যাফে কালচার। তা বিশ্বায়নের যুগে ওরা যদি আমাদের চা’কে নিতে পারে, তাহলে আমাদেরই-বা ক্যাপাচিনো নিতে সমস্যা কোথায়? তৃতীয়ত, বাংলাদেশ তো আর সেই আটপৌরে গরিব, নুন আনতে পান্তা ফুরায় অবস্থায় নেই। আমাদের অর্থনীতির উন্নতি ঘটেছে, শিক্ষার হার বেড়েছে, নারীর ক্ষমতায়ন হয়েছে। আর তার সঙ্গে আমাদের রুচিরও উত্তরণ ঘটেছে। সারা পৃথিবীর সঙ্গে তাল মিলিয়ে আমাদের জীবনযাপনেও পরিবর্তন ঘটেছে। আজকের এসব ঝাঁ-চকচকে, শীতাতপনিয়ন্ত্রিত, দারুণ ডিজাইনে তৈরি তরুণ-তরুণীদের কলকাকলিতে ভরা ক্যাফেগুলো বোধ হয় সেই কথাই বলছে।
সৈয়দ গাউসুল আলম শাওন
লেখক: ম্যানেজিং পার্টনার অ্যান্ড কান্ট্রি হেড, গ্রে বাংলাদেশ
gousulalamshaon@gmail.com
ইলাস্ট্রেশন: দিদারুল আলম দিপু