মনোজাল I সৌন্দর্যের মনোবিজ্ঞান
কোনো নির্দিষ্ট সংজ্ঞায় ফেলার উপায় নেই। নির্ধারণ করা যাবে না সুস্পষ্ট বৈশিষ্ট্যগুলো। তাহলে সৌন্দর্যের ধারণাকে প্রভাবিত করার কারণগুলো কী, খোঁজ করা দরকার তো
কথায় আছে, আগে দর্শনদারি পরে গুণবিচারি। আমরা এমন এক পৃথিবীতে বাস করি, যেখানে প্রথম দর্শন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, আর সৌন্দর্যের ধারণাটিও সেখান থেকে সৃষ্টি হয়। আমরা স্বাভাবিকভাবে আকর্ষণীয় মুখের প্রতি আকৃষ্ট হই এবং সৌন্দর্য সম্পর্কে আমাদের ধারণা প্রায়শই সামাজিক মিথস্ক্রিয়া, সম্পর্ক এমনকি প্রফেশনাল সুযোগগুলোতেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। কিন্তু ঠিক কী কারণে একটি মুখ আমাদের কাছে সুন্দর মনে হয়? এটি কি সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত, নাকি সৌন্দর্য সম্পর্কে ধারণা গঠনে মনোবিজ্ঞানও মৌলিক ভূমিকা রাখে? আচ্ছা, কাউকে যদি জিজ্ঞেস করা হয় তার কাছে সুন্দর মুখের সংজ্ঞা কী? ভাবনাচিন্তা শুরু হবে নিশ্চয়ই।
বিষয়বস্তু
সৌন্দর্য মনোবিজ্ঞানের একটি মৌলিক দিক হলো এর আত্মমুখিতা। একজন ব্যক্তি যা সুন্দর মনে করেন, অন্যজন তা না-ও মনে করতে পারেন। এই আত্মমুখিতা সাংস্কৃতিক, সামাজিক, ব্যক্তিগত পছন্দসহ বিভিন্ন কারণে প্রভাবিত হয়। সৌন্দর্যের সাংস্কৃতিক রীতিনীতি এবং মিডিয়া চিত্রায়ণ প্রায়শই আমাদের মনোভাবকে প্রভাবিত করে। বলা হয়, সে কারণেই সৌন্দর্যের মান বিভিন্ন সংস্কৃতি ও সময়কালজুড়ে উল্লেখযোগ্যভাবে পরিবর্তিত হয়।
ফেস সিমেট্রি বা মুখের প্রতিসাম্য
গবেষণায় দেখা গেছে, সাধারণ মানুষ প্রতিসাম্য বৈশিষ্ট্যযুক্ত মুখগুলোকে আকর্ষণীয় মনে করে। এই পছন্দের পেছনে তত্ত্বটি আবার বিবর্তনীয় মনোবিজ্ঞানে নিহিত। প্রতিসাম্যকে সুস্বাস্থ্য ও জেনেটিক ফিটনেসের লক্ষণ হিসেবে বিবেচনা করা হয়; যা এ ধরনের মুখের প্রতি আকৃষ্ট হওয়া জৈবিকভাবে সুবিধাজনক করে তোলে। তবে মনে রাখা গুরুত্বপূর্ণ, নিখুঁত প্রতিসাম্য বিরল এবং প্রতিসাম্য থেকে সামান্য বিচ্যুতিও অনেকের কাছে আকর্ষণীয় হিসেবে বিবেচিত হতে পারে।
গোল্ডেন রেশিও
মুখের অনুপাত এবং গোল্ডেন রেশিও ধারণাটি সৌন্দর্য মনোবিজ্ঞানে গবেষকদের দীর্ঘকাল ধরে মুগ্ধ করে আসছে। গোল্ডেন রেশিও যা প্রায়শই গাণিতিক মান ফাইয়ের মাধ্যমে নির্ণয় করা হয়। যার মান নিখুঁত অনুপাতের প্রতিনিধিত্ব করে বলে ধারণা। কিছু গবেষণায় দেখা গেছে, গোল্ডেন রেশিওর সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ মুখগুলোকে অনেক বেশি সুন্দর মনে করা হয়। তবে বিষয়টি বিতর্কিত; কারণ, ব্যক্তিগত পছন্দ এবং সাংস্কৃতিক কারণগুলো বেশির ভাগ ক্ষেত্রে সৌন্দর্য সম্পর্কে আমাদের ধারণা গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
তারুণ্যের বৈশিষ্ট্য
মুখের সৌন্দর্য সম্পর্কে মানুষের ধারণাকে উল্লেখযোগ্যভাবে প্রভাবিত করে এমন আরেকটি দিক হলো চেহারায় তারুণ্য বা যৌবনের উপস্থিতি। মসৃণ ত্বক, বলিরেখার অভাব এবং যৌবনের সঙ্গে সম্পর্কিত বৈশিষ্ট্যগুলোকে সাধারণত আকর্ষণীয় গণ্য করা হয়। তবে গবেষকেরা মনে করেন, এই পছন্দও বিবর্তনীয় মনোবিজ্ঞানের সঙ্গে যুক্ত হতে পারে। যেখানে যৌবন উর্বরতা এবং প্রজনন স্বাস্থ্যের সঙ্গে সম্পর্কিত মনে করা হয়। আবার তারুণ্যময় চেহারা বজায় রাখার জন্য সামাজিক চাপও এই মনোভাবের পেছনে অবদান রাখতে পারে।
সাংস্কৃতিক প্রভাব
কেবল জীববিজ্ঞান ও বিবর্তনের ওপর ভিত্তি করে নয়; সংস্কৃতিও সৌন্দর্যের মান গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। এক সংস্কৃতিতে যা সুন্দর বলে বিবেচিত হয়, অন্য সংস্কৃতি তার চেয়ে একেবারে আলাদা হতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, কিছু সংস্কৃতিতে সৌন্দর্যের মানপাল্লায় গায়ের রং কোনো ব্যাপার নয়; অন্যদিকে আমাদের এই উপমহাদেশে সুন্দর মুখের সংজ্ঞায় ফর্সা মুখের অবস্থান তালিকায় সবার আগে থাকে। তাই বিশ্বব্যাপী সৌন্দর্যের বিভিন্ন ধারণা উপলব্ধি করার জন্য এই সাংস্কৃতিক পার্থক্যগুলো বোঝা চাই।
আবেগের প্রকাশ
মুখের অভিব্যক্তি আবেগ প্রকাশের সবচেয়ে শক্তিশালী হাতিয়ার। এই আবেগ সৌন্দর্য সম্পর্কে ধারণাকেও প্রভাবিত করে। যেমন একটি হাসিমুখ অনেকের কাছে আকর্ষণীয় মনে হয়। কারণ, এটি ইতিবাচকতা ও সহজলভ্যতার ইঙ্গিত দেয়। উপরন্তু, সামাজিক মিথস্ক্রিয়ার জন্য মুখের আবেগগুলো পড়ার এবং ব্যাখ্যা করার ক্ষমতা থাকা অপরিহার্য। এ কারণেই মুখের অভিব্যক্তির একটি সুষম সমন্বয় কারও কাছে একজন ব্যক্তির সামগ্রিক সৌন্দর্যে উল্লেখযোগ্যভাবে অবদান রাখে।
ব্যক্তিগত পছন্দ আর বৈচিত্র্য
যদিও সুন্দর বলে বিবেচিত হওয়ার ক্ষেত্রে সাধারণ প্রবণতা রয়েছে, কিন্তু সেখানেও দেখা যায়, ব্যক্তিগত পছন্দগুলো ব্যাপকভাবে পরিবর্তিত হয়। কিছু ব্যক্তি একজনের এমন কোনো বৈশিষ্ট্যের প্রতি আকৃষ্ট হতে পারে, যা মূলধারার সৌন্দর্য মানদণ্ডের অংশ নয়। তারপরও এই ব্যক্তিগত পছন্দগুলোকে সম্মান করা জরুরি এবং অবশ্যই বিচার বা সমালোচনা করা ঠিক নয়।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের প্রভাব
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের উত্থান সৌন্দর্য মানদণ্ডের ওপর গভীর প্রভাব ফেলেছে। ফিল্টার, ফটো এডিটিং এবং কিউরেটেড ছবি অবাস্তব সৌন্দর্য ধারণার জন্ম দিয়েছে। নিজের শরীরের খুঁতগুলো নিয়ে অসন্তুষ্টি এবং ক্ষেত্রবিশেষে আত্মসম্মানের সমস্যাও দেখা দিতে শুরু করেছে; যা রীতিমতো ভয়ংকর। এই প্রভাবগুলো সম্পর্কে সচেতন থাকা এবং খাঁটি সৌন্দর্যকে অগ্রাধিকার দেওয়ার ব্যাপারে সচেতন থাকার কথা বলেছেন মনোবিজ্ঞানীরা। কারণ, নিজস্ব সৌন্দর্য সম্পর্কে ধারণা আত্মসম্মান এবং সামগ্রিক সুস্থতার ক্ষেত্রেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এটি মনে রাখা গুরুত্বপূর্ণ, সৌন্দর্য কেবল বাহ্যিক চেহারার ওপর নির্ভর করে না; এর মধ্যে উদারতা, বুদ্ধিমত্তা ও আত্মবিশ্বাসের মতো গুণাবলিও অন্তর্ভুক্ত থাকে।
আসলে এককথায় বলতে গেলে, সৌন্দর্য মনোবিজ্ঞানে একটি মুখকে কী সুন্দর করে তোলে, তার কোনো নির্দিষ্ট উত্তর নেই। এটি জীববিজ্ঞান, সংস্কৃতি, ব্যক্তিগত পছন্দ এবং সামাজিক প্রভাবের একটি জটিল পারস্পরিক ক্রিয়া। তবে এটুকু বলা যায়, সৌন্দর্য কেবল আমরা অন্যকে কীভাবে দেখি তা নয়; বরং কীভাবে নিজেদের ও অন্যদের উপলব্ধি আর মূল্যায়ন করি, সেটিকেও সংজ্ঞায়িত করে।
রত্না রহিমা
মডেল: মাহেলেকা
মেকওভার: পারসোনা
ছবি: কৌশিক ইকবাল