skip to Main Content

প্রাগৈতিহাসিক I সিন্ধু সন্ধান

সিন্ধু সভ্যতা বা হরপ্পা সভ্যতার মূল নিহিত খ্রিস্টপূর্ব ৬০০০ অব্দের মেহেরগড় সভ্যতার ভেতর। পাঞ্জাব ও সিন্ধু অঞ্চলের সিন্ধু নদ উপত্যকায় খ্রিস্টপূর্ব ২৬০০ অব্দ নাগাদ সিন্ধু সভ্যতার সেরা দুই শহর হরপ্পা ও মহেঞ্জোদারো গড়ে ওঠে। এই সভ্যতায় লিখনব্যবস্থা, নগরকেন্দ্র, সামাজিক ও অর্থনৈতিক বৈচিত্র্যের অস্তিত্ব ছিল। কৃষি উৎপাদন ও নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা ছিল প্রাচীনতম জটিল সমাজ ও শহরগুলোর উত্থানের অন্যতম মৌলিক কারণ। কেমন ছিল খাদ্যাভ্যাস?

সিন্ধু সভ্যতা বা হরপ্পা সভ্যতা ছিল ব্রোঞ্জ যুগের অন্যতম প্রাচীন জটিল সমাজ। ব্রোঞ্জ যুগ হলো মানবসভ্যতার প্রাগৈতিহাসিককালের তিনটি প্রধান পুরাতাত্ত্বিক ভাগের (প্রস্তর যুগ, ব্রোঞ্জ যুগ ও লৌহ যুগ) দ্বিতীয় ভাগ। খ্রিস্টপূর্ব ৩৩০০-১৩০০ অব্দের মধ্যে এটি ছিল প্রাচীন বিশ্বের সভ্যতার তিনটি প্রাথমিক স্তরের মধ্যে সবচেয়ে বিস্তৃত। সিন্ধু এলাকা ছিল প্রাচীন মিসর বা মেসোপটেমিয়ার চেয়ে বড়। বর্তমানের উত্তর-পূর্ব আফগানিস্তান থেকে পাকিস্তান এবং উত্তর-পশ্চিম ভারত পর্যন্ত বিস্তৃত। সিন্ধু নদের বৃহত্তম শহরগুলোর মধ্যে একটি হরপ্পা, যার অবস্থান ছিল বর্তমান পাকিস্তানে।
প্রাচীন মিসরীয়দের পিরামিড এবং প্রথম উল্লেখযোগ্য শহরগুলো নির্মাণের সময়েই সিন্ধু সমাজের বিকাশ শুরু হয়। খ্রিস্টপূর্ব ২৬০০-১৯০০ অব্দের মধ্যে এর জনসংখ্যা ছিল প্রায় ৪০ হাজার। সে সময় তারা সাবধানে পরিকল্পিত নগর গড়ে তুলতে থাকেন। সিন্ধু নগরগুলো তাদের নগর-পরিকল্পনা, পাকা ইটের ঘর, বিস্তৃত নিষ্কাশন ব্যবস্থা, পানি সরবরাহ ব্যবস্থা এবং বৃহৎ অনাবাসিক ভবনের জন্য প্রসিদ্ধ। সিন্ধু বসতি স্থাপনের বিস্তৃত অঞ্চলটি ভৌগোলিক ও সাংস্কৃতিকভাবে পরিবর্তনশীল ছিল, যা সিন্ধু সমাজে জীবিকা নির্বাহের পদ্ধতিকে বৈচিত্র্যপূর্ণ করে তুলেছিল।
খাদ্য সমাচার
সিন্ধু সভ্যতার খাবার ও রন্ধনপ্রণালি দক্ষিণ এশিয়ার আধুনিক ‘কারি’ জাতীয় খাবারের ভিত্তি স্থাপন করেছিল। হরপ্পাবাসী তাদের খাদ্যতালিকায় শস্য, ডাল, শাকসবজি, ফলমূল ও পশুজাত দ্রব্য; সেই সঙ্গে বিভিন্ন ধরনের মসলা এবং নানা রকম খাবার অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন। সেই সময়ের মসলা এখনো দক্ষিণ এশিয়ায় ব্যবহৃত হয়। সাম্প্রতিক গবেষণা থেকে জানা যায়, ওই সভ্যতার খাদ্যাভ্যাস ও কৃষিকাজ মূলত গবাদিপশু পালনের ওপর কেন্দ্রীভূত ছিল; যাতে সংগত দিত গম ও বার্লি। শীতকালীন বৃষ্টিপাত এ দুটি শস্য আবাদে সহায়ক ছিল। ডালের মধ্যে হরপ্পাবাসী মসুর ডাল, ছোলা, মটর, মুগ ডাল এবং কালো ছোলা (উড়ো ডাল) চাষ করতেন বলে জানা যায়। তাদের প্রধান শস্যের মধ্যে ছিল গম ও বার্লি; তবে কিছু অঞ্চলে, বিশেষ করে গুজরাটে বজরা চাষ করা হতো। তারা রুটি তৈরিতে গম ও বার্লি ব্যবহার এবং সেই সঙ্গে এ দুটি খাদ্যশস্য পানিতে মিশিয়ে গ্রুয়েল বা পোরিজ হিসেবেও রান্না করতেন।
এই অঞ্চলে চাল যদিও একটি আধুনিক ও প্রধান খাদ্যশস্য; তবে সিন্ধু যুগে প্রধান শস্য হিসেবে এর অবস্থান খুব একটা স্পষ্ট নয়। গবেষকদের ধারণা, সেই সভ্যতার শেষকাল পর্যন্ত ধান চাষ ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েনি; বরং এই শস্য চাষের বিকাশ ঘটেছিল চীনে এবং সে যুগের শেষ দিকেই সেখান থেকে এই অঞ্চলে এর আবির্ভাব ঘটে।
এ সময়কালে পশুখাদ্য হিসেবে বন্য ধান চাষ করা হতো বলে প্রমাণ পাওয়া যায়। তবে কিছু কিছু অঞ্চলে যথেষ্ট পরিমাণে চালের ব্যবহারের সন্ধান পেয়েছেন গবেষকেরা, যা প্রমাণ করে, এটি গম বা বার্লির চেয়ে সেসব জায়গায় বেশি পছন্দের ছিল। এ প্রসঙ্গে সিউল ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির প্রত্নতত্ত্ব বিজ্ঞানের সহকারী অধ্যাপক ড. জেনিফার বেটস উল্লেখ করেছেন, ‘প্রাচীন দক্ষিণ এশিয়ায় আমরা সম্পূর্ণ পৃথক গৃহজাত প্রক্রিয়ার প্রমাণ পেয়েছি, সম্ভবত বন্য খাদ্য শস্য ওরিজা নিভারাকে কেন্দ্র করে। এর ফলে খ্রিস্টপূর্ব ২০০০ অব্দে সত্যিকারের চীনা ধান, ওরিজা স্যাটিভা জাপোনিকা আসার আগে স্থানীয় ওরিজা স্যাটিভা ইন্ডিকা ধান চাষ স্থানীয়ভাবে বিকাশ লাভ করে।’
বিশ্বাস করা হয়, হরপ্পাবাসী খেজুর, জুজুব, আঙুর, ডুমুর এবং সম্ভবত আমসহ বিভিন্ন ধরনের স্থানীয় ফল খেতেন। চাষ করা সবজির মধ্যে ছিল বিভিন্ন ধরনের ব্রাসিকা, বাদামি রঙের সরিষার শাক, ঢ্যাঁড়স ও কেপার। নানা জাতের ভেষজ আর মসলাও সম্ভবত চাষ করা হতো; যদিও এসবের পেছনে তথ্যউপাত্তের অভাব রয়েছে। ভেষজ ও মসলার মধ্যে ধনে, আখ, রসুন, হলুদ, আদা, জিরা ও দারুচিনির উল্লেখ মেলে। আদা, রসুন ও হলুদ বিবেচিত হতো রান্নার মূল উপাদান হিসেবে।
হরপ্পাবাসী মাংসের জন্য গবাদি পশুপাখি পালন করতেন; বিশেষত মুরগি, মহিষ, ভেড়া ও ছাগল। শিকার করতেন বুনো পাখি, হরিণ ও বন্য শূকর প্রভৃতি। তাদের খাদ্যতালিকায় স্থানীয় নদী, হ্রদ ও সমুদ্রের মাছ এবং শেলফিশ অন্তর্ভুক্ত ছিল। তাজা মাছ খেতেন। তবে অনেক দূরের অভ্যন্তরীণ অঞ্চলের সামুদ্রিক মাছ নিয়ে আসার ক্ষেত্রে সময়ক্ষেপণ হতো বলে সেগুলো শুকনো বা লবণাক্ত করে খাওয়ার চল ছিল।
রান্নার তেল হিসেবে তিলের পাশাপাশি সম্ভবত তিসির তেলও ব্যবহার করা হতো। সম্প্রতি সিন্ধু প্রত্নস্থল খননের মাধ্যমে সে সময়কার রান্নায় ব্যবহৃত তন্দুরি-ধাঁচের চুলা আবিষ্কৃত হয়েছে। এটি এমন এক অসাধারণ আবিষ্কার, যা ব্রোঞ্জ যুগে আধুনিক ভারতীয় খাবারের শিকড়ের জানান দেয়। তন্দুরি চুলা টিক্কার মতো অনেক জনপ্রিয় খাবার এবং ঐতিহ্যবাহী নান তৈরিতে ব্যবহৃত হয়।
কৃষি পদ্ধতি
২০১৬ সালে কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের এক পাবলিক রিলিজে সিন্ধু সভ্যতা সম্পর্কে নতুন প্রত্নতাত্ত্বিক আবিষ্কারের বিষয়টি নিশ্চিত করা হয়। এই গবেষণাপত্র থেকে জানা যায়, সিন্ধু জনগোষ্ঠী ঋতুভিত্তিক নানাবিধ ফসলের জন্য জটিল কৌশলগুলো কীভাবে প্রয়োগ করেছিল। তা ছাড়া বিভিন্ন পানি ব্যবস্থাপনা-সম্পর্কিত গুরুত্বপূর্ণ সচেতনতা সম্পর্কেও জানা যায়। অন্যান্য সভ্যতা ঋতুভিত্তিক ফসল চাষ শুরুর আগেই সিন্ধু সভ্যতার জনগণ গ্রীষ্মকালে ধান, বাজরা ও শিম এবং শীতকালে গম, বার্লি ও ডাল চাষের চল শুরু করেছিল। রেডিওকার্বন ডেটিং হচ্ছে তেজস্ক্রিয় আইসোটোপ কার্বন-১৪ এর ক্ষয় পরিমাপ করে জৈব পদার্থের বয়স নির্ধারণের জন্য ব্যবহৃত একটি পদ্ধতি। এই পদ্ধতির মাধ্যমে এমনকি খ্রিস্টপূর্ব ২৫৮০ অব্দে অশ্বগ্রাম ফসল এবং খ্রিস্টপূর্ব ২৪৩০-২১৪০ অব্দে সেখানে ধান চাষের অস্তিত্বের প্রমাণ পাওয়া যায়। এই কৃষি পদ্ধতিগুলো শুধু খাদ্যতালিকায় বৈচিত্র্য বৃদ্ধিই করেনি; বরং সারা বছর ধরে শ্রম সংগঠিত করার এবং খাদ্য সরবরাহের সুযোগও এনে দিয়েছিল। এ ধরনের ফসল প্রাচীন নগর শহর প্রতিষ্ঠায় সহায়তা করেছিল; কেননা, আঞ্চলিক চাষিদের উৎপাদিত পণ্য বাণিজ্যের জন্য বিভিন্ন বাজারে পরিবহন করা হতো।
প্রাক্-বৈদিক ভারতবর্ষে (খ্রিস্টপূর্ব ১৫০০ অব্দের আগে) আয়ুর্বেদের সূক্ষ্ম জ্ঞানের এক ঝলক দেখা যায়, যার মধ্যে রয়েছে ঋতুভিত্তিক খাদ্যাভ্যাসের প্রতি আকর্ষণ; সেই সঙ্গে বিভিন্ন ধরনের শস্য ও ডাল, যেমন উড়াদ ডালের ব্যবহার সে সময় বাড়ে। ঋতুকালীন খাদ্যাভ্যাসের ধারণা, যাকে ঋতুচর্যও বলা হয়, প্রাচীন আয়ুর্বেদ গ্রন্থ চরক সংহিতায় খ্রিস্টপূর্ব ২০০ অব্দেই উল্লেখ করা হয়েছে।
আজও আয়ুর্বেদের ধ্রুপদি গ্রন্থগুলো অধ্যয়ন করলে কিংবা আধুনিক আয়ুর্বেদিক রান্নার বইয়ে চোখ বোলালে সিন্ধু বা হরপ্পা সভ্যতার অবদান বোঝা যায়। যুক্তরাষ্ট্রের ডেনভার থেকে শুরু করে অস্ট্রেলিয়ার ডারউইন কিংবা ভারতের মুম্বাই থেকে যুক্তরাজ্যের বার্মিংহাম—যেকোনো জায়গাতেই তরকারি বা তন্দুরি খাবার খেতে বসে আমরা আজও প্রাচীন সিন্ধু সভ্যতার খাদ্য উপাদান ও রান্নার পদ্ধতিগুলো অনুভব করতে পারি।

 ফুয়াদ রূহানী খান
ছবি ও চিত্রকর্ম: ইন্টারনেট

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top