skip to Main Content

মনোজাল I বিউটি বায়াস

সৌন্দর্য ও সাফল্য আসলেই কি পরস্পর সম্পর্কিত? গভীরে খোঁজ করেছেন রত্না রহিমা

বইয়ের প্রচ্ছদ দেখে এর ভেতরটা বিচার করা উচিত নয়, কথাটি বহুল প্রচলিত। তবে মানুষের চেহারার ক্ষেত্রে বিষয়টি প্রযোজ্য হয় না বেশির ভাগ সময়। কথায় আছে, প্রথমে দর্শনদারি, পরে গুণবিচারি। একদম খাঁটি কথা! গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে, একজন মানুষ দেখতে সুন্দর হলে তার সঙ্গে যোগাযোগে একরকম আনন্দ অনভূত হয়। জরিপ বলে, আকর্ষণীয় চেহারা বা সমাজের প্রত্যাশিত বিউটি স্ট্যান্ডার্ডের সঙ্গে যাদের মুখাবয়ব খাপ খায়, তারা অন্যদের তুলনায় অর্থাৎ গড় চেহারাধারীদের চেয়ে অনেক বেশি সফল হন। যদিও সৌন্দর্যের এই পক্ষপাত বা লুকিজম নিয়ে খুব বেশি আলোচনা হয় না আমাদের সমাজে। তবে বিভিন্ন পর্যায়ে এই চর্চা খুব ভালোভাবে বিদ্যমান। সুন্দর, সুদর্শন বা আকর্ষণীয় বলে সুবিধাপ্রাপ্ত মানুষের সংখ্যা হিসাব করলে গুনে শেষ করা যাবে না। দুর্ভাগ্যবশত যার অর্থ হলো, যদি বাহ্যিক লুক বা চেহারা সমাজের সৌন্দর্যের মানদণ্ডের সঙ্গে খাপ না খায়, তাহলে নানান নেতিবাচক অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হতে হয়। সেগুলোর মধ্যে পদোন্নতি, বোনাস, এমনকি স্বপ্নের চাকরিতে নিয়োগ পাওয়ার সুযোগটিও হাতছাড়া হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে শতকরা ৯২ ভাগ। এমন প্রমাণ ভূরি ভূরি। যা প্রমাণ করে, আকর্ষণীয় ব্যক্তিদের কর্মক্ষেত্রে সফল হওয়ার সম্ভাবনা বেশি।
২০১৯ সালে, ফোর্বস রিপোর্ট অনুযায়ী প্রচলিত বিউটি স্ট্যান্ডার্ডের মাপকাঠিতে যারা সুন্দর হিসেবে বিবেচিত, তারা অন্যদের তুলনায় ১০% থেকে ১৫% বেশি বেতনের সুবিধা পান। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, সুদর্শন প্রার্থীদের নিয়োগ, সাক্ষাৎকার বা পদোন্নতির সম্ভাবনা সব সময় বেশি থাকে। আবার এমনও প্রমাণ রয়েছে, কম আকর্ষণীয় ব্যক্তিদের চাকরিচ্যুত হওয়ার আশঙ্কা বেশি যেমন থাকে, তেমনি তাদের প্রথম বা ওপরের স্থানে নিয়োগের সম্ভাবনাও কম থাকে। এই পক্ষপাত ক্যারিয়ার শুরুর অনেক আগে থেকে হয়। ফোর্বসের একই প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, শারীরিকভাবে আকর্ষণীয় শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চতর গ্রেড পাওয়ার ক্ষেত্রেও অন্যদের তুলনায় এগিয়ে থাকেন। কারণ, যেকোনো কারণেই হোক, তাদের বিবেকবান ও বুদ্ধিমান বলে বিবেচনা করা হয়। যদিও আসল সত্যিটা অন্য রকম। এমনকি স্কুলেও, সুদর্শন শিশুদের একইভাবে দেখা হয়। হ্যালো এফেক্ট বলে একধরনের তত্ত্ব পর্যন্ত রয়েছে, যার অর্থ হলো সুদর্শন ব্যক্তিদের সামাজিক, সুস্থ, সফল, সৎ ও প্রতিভাবান হিসেবে বিচার করা হয়।
আমেরিকান লেখিকা, প্রযোজক, পরিচালক এবং ট্রান্স রাইটস অ্যাকটিভিস্ট জ্যানেট মক ২০১৭ সালে অ্যালুরে লেখা একটি প্রবন্ধে বিষয়টির চমৎকার বর্ণনা দিয়েছেন। তার মতে, সমাজের চোখে আপনি সুস্থ ও সুন্দর হিসেবে চিহ্নিত হলে তা থেকে নানাভাবে উপকৃত হবেন। এটি একেবারেই মনগড়া কথা নয়। যদিও প্রভাবশালী সুবিধাপ্রাপ্ত ব্যক্তিরা তাদের এই বিশেষাধিকার নিয়ে আলোচনা করতে চান না। জ্যানেট মক বিশ্বাস করেন, এই ব্যবস্থা ও শ্রেণিবিন্যাস ভেঙে ফেলতে হলে তাদেরকে অবশ্যই এই বিশেষাধিকার স্বীকার করতে হবে। সৎ হতে হবে এবং সুন্দর বলে তিনি যে তার চেহারা থেকে উপকৃত হচ্ছেন, তা স্বীকার করার মানসিকতা থাকতে হবে। কারণ, এটা বোঝা খুবই গুরুত্বপূর্ণ, যেখানে সৌন্দর্যের পক্ষপাতিত্ব আছে, সেখানে অনেক বেশি বৈষম্য ঘটতে পারে।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, এটি কি আসলে জীববিজ্ঞানের ওপর নির্ভর করে? গবেষকেরা মনে করেন, সবকিছুরই একটা জৈবিক ব্যাখ্যা থাকতে পারে, যা সম্ভাব্যভাবে মানবজাতির বেঁচে থাকার সঙ্গে যুক্ত। জৈবিকভাবে, প্রাণিজগতে, প্রায়শই তাদের পছন্দসই জিনের কারণে সঙ্গী নির্বাচন করা হয়; যা প্রজাতিকে বেঁচে থাকার এবং সমৃদ্ধ হওয়ার ক্ষেত্রে সুযোগ করে দেওয়ার জন্য পাঠানো হয়। শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট ফর মাইন্ড অ্যান্ড বায়োলজি প্রকাশিত ২০১৬ সালের গবেষণা অনুসারে, আকর্ষণীয়তাকে ব্যক্তিত্ব, বুদ্ধিমত্তা, বিশ্বাসযোগ্যতা, পেশাদার দক্ষতা বা উৎপাদনশীলতার একটি চিহ্ন হিসেবে ধরা হয়। মনোবিজ্ঞানীরা যাকে মানুষের একধরনের জৈবিক প্রবৃত্তি বলে ঘোষণা করেছেন। তাদের মতে, তাই আমরা যখন সঙ্গী খুঁজছি বা নিয়োগ দিচ্ছি, তখন এই প্রাচীন প্রবৃত্তি মানুষ হিসেবে আমাদের মধ্যে একরকম অবচেতন পক্ষপাত তৈরি করে। বিশেষ করে নিয়োগকারীরা যখন তাদের কোম্পানির প্রতিনিধিত্ব করার জন্য সেরা চেহারার কর্মচারীদের চান, তার ব্যাখ্যা হিসেবে এই থিওরি উপযুক্ত বলে ধরা যায়। ঠিক যেমন প্রাণীরা তাদের প্রজাতিকে সমৃদ্ধ করতে চায়, তেমনিভাবে মালিকেরা তাদের প্রতিষ্ঠানগুলোকে সাফল্যমণ্ডিত দেখার অভিপ্রায় রাখেন। ফলে কর্মীদের চেহারার সৌন্দর্যকে অগ্রাধিকার দেন তারা। এ ক্ষেত্রে যৌনতাকেও একটি মানদণ্ড হিসেবে বিবেচনা করা হয়। যেমন ২০২০ সালে স্লেটার এবং গর্ডন প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী, লকডাউনের সময় এক-তৃতীয়াংশের বেশি (৩৪ শতাংশ) নারী কর্মীকে বেশি বেশি মেকআপ পরতে কিংবা তাদের হেয়ারস্টাইল উন্নত করতে বলা হয়েছিল। যেখানে ২৭ শতাংশকে বলা হয়েছিল আরও উত্তেজক পোশাক পরতে। তাদের মধ্যে ৪১ শতাংশ বলেছেন, তাদের বস অনুরোধটিকে ন্যায্যতা দিয়েছেন এই বলে যে এটি তাদের ব্যবসাকে লাভজনক করে তুলতে সাহায্য করতে পারে। তা ছাড়া টিমে থাকার জন্য সুন্দর দেখানোকেও বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছিল। একইভাবে, ৩৮ শতাংশ বলেছেন, তাদের বলা হয়েছিল, উত্তেজক পোশাক পরলে তারা ক্লায়েন্টের কাছে আরও আকর্ষণীয় হয়ে উঠবেন। এ ক্ষেত্রে আসলে সেই একই থিওরি কাজ করেছে বলা যায়।
উদাহরণ দেওয়া যাক। ওয়ারউইক বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ক্রিস্টোফার ওয়ারহার্স্ট এবং স্ট্র্যাথক্লাইড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ডেনিস নিকসন কর্মসংস্থান বিশেষজ্ঞ। দ্য কনভারসেশনের জন্য সাম্প্রতিক একটি প্রবন্ধে তারা লিখেছেন, কোম্পানিগুলো মনে করে, কর্মীদের চেহারার প্রতি আরও মনোযোগ দেওয়া তাদের আরও প্রতিযোগিতামূলক করে তুলবে। অন্যদিকে সরকারি খাতের সংস্থাগুলো মনে করে, এটি গ্রাহকদের কাছে তাদের আরও পছন্দের করে তুলবে। ফলস্বরূপ, তারা কর্মীদের কেমন দেখানো, কেমন পোশাক পরা ও কথা বলা উচিত, সেদিকে অনেক বেশি নির্দেশমূলক হয়ে ওঠে; যা অত্যন্ত সমস্যাযুক্ত। বিশেষ করে কর্মস্থলে পদোন্নতি এবং বেতনের ক্ষেত্রে চেহারার সৌন্দর্য কেবল একটি সমস্যাই নয়; বরং এটি অনেক বেশি বৈষম্য ও হয়রানির পথ তৈরির কৌশল।
অনেকে ভাবতে পারেন, পুরো ব্যাপারটি বেআইনি কি না। মোটেই না। ভয়াবহ বাস্তবতা হচ্ছে, এটি আইন বিরুদ্ধ কোনো কাজ নয়। এখানে এমন অনেক বিখ্যাত কোম্পানির উদাহরণ টানা যায়, যারা একসময় মূলত চেহারার ওপর ভিত্তি করে কর্মী নিয়োগ দিত। মোদ্দাকথা, সৌন্দর্যের পক্ষপাতিত্ব সর্বদা বিদ্যমান ছিল, আছে এবং থাকবে। এই বৈষম্য পরিবর্তন করা বর্তমানের আধুনিক সমাজেও কোম্পানিগুলোর পক্ষে কঠিন। গবেষকেরা যদিও এটিকে একটি বিচারহীন সংস্কৃতি বলে মনে করেন, কিন্তু করার আসলে কিছুই নেই! ওই যে কথায় আছে না, সুন্দর মুখের জয়জয়কার সর্বত্র।

মডেল: মাইশা
মেকওভার: পারসোনা
ছবি: ক্যানভাস

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top