পাতে পরিমিতি I ব্রেন বুস্টিং ডায়েট
মানবদেহের সবচেয়ে জটিল, কর্মক্ষম ও বেশি শক্তি ব্যবহারকারী অঙ্গ মস্তিষ্ক। এটি প্রতি সেকেন্ডে লাখ লাখ তথ্য বিশ্লেষণ, স্মৃতি গঠন, আবেগ নিয়ন্ত্রণ এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণে সাহায্য করে। মস্তিষ্কের যত্নে সঠিক খাবার গ্রহণ তাই জরুরি। রইল পুষ্টিবিদ নিশাত শারমিন নিশির পরামর্শ
আমরা যা বলি, ভাবি বা করি—সবকিছুর নিয়ন্ত্রণের কেন্দ্রে থাকে মস্তিষ্ক। শরীরের অন্যান্য অঙ্গ; যেমন কিডনি, হৃদ্যন্ত্র, হাড় বা চোখের যত্ন নেওয়া যেমন জরুরি, মস্তিষ্কের ক্ষেত্রেও করা চাই সমান কিংবা কখনো কখনো অধিক গুরুত্বারোপ। মস্তিষ্কে সঠিক পুষ্টির জোগান নিশ্চিত করা চাই নিয়মিত।
জীবনে কোনো মানসিক চাপ নেই—এমন মানুষ বিরল। ব্যস্ত জীবন, অতিরিক্ত স্ক্রিন টাইম, স্ট্রেস, অনিয়মিত ঘুম—সব মিলিয়ে আমাদের ব্রেন প্রায় সব সময় নানাভাবে স্ট্রেসফুল থাকে। এসব দৈনন্দিন চাপের কারণে ধীরে ধীরে ক্ষতিগ্রস্ত হতে থাকে মগজের কোষগুলো। ফলে আমাদের স্মৃতিশক্তির পাশাপাশি কমতে থাকে মনোযোগ। এমন জটিল সমস্যা থেকে মুক্তি পেতে এবং ব্রেনের সেল ফাংশন ভালো রাখতে প্রতিদিনের খাদ্যতালিকায় কিছু উপযুক্ত খাবার রাখা আবশ্যক।
চেনা খাবারে সমাধান
ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিড
গবেষণায় দেখা গেছে, নিয়মিত ওমেগা-৩ জাতীয় খাবার গ্রহণ করলে আলঝেইমার ও স্মৃতিভ্রংশের ঝুঁকি অনেকটা কমে যায়। শিশুর মস্তিষ্কের বিকাশেও এ ধরনের খাবার অপরিহার্য। স্যামন ফিশ, সার্ডিন ফিশ, ম্যাকেরেল ফিশ, আখরোট, ফ্ল্যাক্সসিড, চিয়া সিড প্রভৃতিতে মস্তিষ্কের গঠনশীল এই পুষ্টি উপাদানগুলো পাওয়া যায়। বিজ্ঞান বলে, মানব মস্তিষ্কের প্রায় ৬০ শতাংশই ফ্যাট দিয়ে তৈরি। এর মধ্যে ওমেগা-৩ একটি অপরিহার্য উপাদান, যা স্নায়ুকোষের গঠন ও কার্যক্ষমতা বজায় রাখে এবং কোষগুলোর মধ্যে সংকেত আদান-প্রদান সহজ করে দেয়।
ভিটামিন বি
ডিম, দুধ, বাদাম, কলিজা, সবুজ শাক, দই, মুরগির মাংস থেকে পাওয়া যায় বি ভিটামিন; বিশেষ করে বি৬, বি১২ ও ফলেট—এই তিন ভিটামিন মস্তিষ্কে নিউরোট্রান্সমিটার উৎপাদনে সহায়ক। এগুলোই আমাদের আবেগ, ঘুম, মনোযোগ ও স্মৃতি গঠনের মূল নিয়ামক। অনেকে কখনো কখনো নির্দিষ্ট কোনো কারণ ছাড়াই সারা দিন বেশ ক্লান্তি অনুভব করেন; বিশেষ কোনো ঘটনা ছাড়াই থাকেন মনমরা। সাধারণত দেহে ভিটামিন বি কমপ্লেক্স ঘাটতির কারণে এমন আপদ হানা দেয়। তাই মানসিক স্থিতির জন্য প্রতিদিন খাদ্যতালিকায় ভিটামিন বি সমৃদ্ধ খাবার রাখা জরুরি।
অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট
ভিটামিন সি, ভিটামিন ই, বিটা-ক্যারোটিন সমৃদ্ধ খাবারে থাকে অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট। ফল, সবজি, বাদাম ও বীজজাতীয় খাবার নিয়মিত গ্রহণ করলে এর ঘাটতি থেকে সহজে মুক্তি মেলে। রোগ প্রতিরোধক্ষমতা বাড়ানোর পাশাপাশি কোষের ক্ষতি রোধ, ত্বকের স্বাস্থ্য রক্ষা, এমনকি মস্তিষ্কের কোষগুলোকে বুস্টআপ করতেও অ্যান্টিঅক্সিডেন্টের জুড়ি নেই। মানুষের বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে মস্তিষ্কের কোষ ক্ষয়প্রাপ্ত হয় এবং ফ্রি র্যাডিকেলস নামক ক্ষতিকর উপাদান স্নায়ুকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। এই ক্ষয় রোধে অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট সহায়ক। তাই বয়সের সঙ্গে লড়াইয়ে খাদ্যতালিকায় রাখা চাই ব্লুবেরি, স্ট্রবেরি, আঙুর, কাঁঠাল, ডার্ক চকলেট ইত্যাদি। বিশেষ করে, ব্লুবেরিতে থাকা অ্যান্থোসায়ানিন নিউরনের সংকেত প্রেরণের শক্তি বাড়ায়। অবশ্য বাংলাদেশে এ ধরনের ব্লুবেরি সহজলভ্য নয়; সে ক্ষেত্রে অতি পরিচিত দেশি ফল; যেমন আমলকী বা জামও এ কাজে সমান কার্যকর।
পানি
শরীরের জন্য সবচেয়ে সহজলভ্য অথচ গুরুত্বপূর্ণ পুষ্টি উপাদান পানি। খাবারের অভাবে শরীর শুকিয়ে যায়, নানা রকম অসুখ উঁকি দেয়, দুর্বলতা প্রকট হয়ে ওঠে। শরীরের জন্য খাবার যতটা গুরুত্বপূর্ণ, পানিও ততটাই। পর্যাপ্ত পানি পান মস্তিষ্কের জন্য একান্ত আবশ্যক। পানিশূন্যতা দেখা দিলে মস্তিষ্ক সঠিকভাবে কাজ করার ক্ষমতা হারায়। সামান্য ডিহাইড্রেশনও অনেক সময় আমাদের মনোযোগ ও স্মৃতিশক্তি কমিয়ে দিতে পারে। তাই দিনে ৮ থেকে ১০ গ্লাস পানি পান করা প্রয়োজন। তবে শরীরের ওজন ও ঘামভেদে এর পরিমাণ ভিন্ন হতে পারে। কোনো কোনো সময়ে সাদা পানি বা প্লেন ওয়াটার পানের ইচ্ছা না করলে বিকল্প হিসেবে ফলের রস, ডাবের পানি, লেন্টিল সুপ, ডিটক্স ওয়াটার ইত্যাদি পান করতে পারেন।
ভেষজ বৈভব
ব্রেনের সবচেয়ে বড় বিষয় হলো, এটি আমাদের জীবনের পরিচালক। উর্বর মস্তিষ্ক স্মৃতিশক্তির আধার। স্মৃতিশক্তি বাড়াতে ডায়েটে রাখা চাই কিছু প্রাকৃতিক মসলা ও ভেষজ উপাদান।
হলুদ
আমাদের দেশীয় খাবারে হলুদের ব্যবহার প্রচুর। মানবদেহে রোগ প্রতিরোধক্ষমতা বাড়ানোর পাশাপাশি এই মসলায় থাকা কারকিউমিন উপাদান মস্তিষ্কের প্রদাহ কমায়, স্মৃতিশক্তি বাড়ায়।
তুলসী
কাশির সমস্যা সমাধানে এর যেন জুড়ি নেই! তবে আয়ুর্বেদের মতে, এটি স্মৃতিশক্তি ও একাগ্রতা বাড়াতেও সহায়ক। তাই সকাল অথবা বিকেলে এক কাপ ধোঁয়া ওঠা তুলসী চা রাখা যেতে পারে ডায়েটে।
দারুচিনি ও আদা
কারি রান্নায় এই দুই খাদ্য উপাদানের ব্যবহার থাকেই। তবে তা শুধু স্বাদ নয়; অ্যান্টি-ইনফ্ল্যামেটরি উপাদান হিসেবেও কাজ করে। ব্রেন বুস্টার হিসেবে দারুচিনি ও আদা বেশ কার্যকরী।
দেহ-মনের সংযোগ
খারাপ কিংবা ভালো—মনে যেকোনো অনুভূতির বার্তা মস্তিষ্কই ছড়িয়ে দেয়। মগজের সঠিক যত্ন নিশ্চিতে তাই শরীরের পাশাপাশি মনও ভালো রাখা চাই। কিছু হরমোন রয়েছে; যেগুলো আমাদের দেহে ভালো লাগার অনুভূতি তৈরিতে সহায়ক। যেমন সেরোটোনিন, ডোপামিন, এন্ডোরফিন; এগুলোকে বলে হ্যাপি হরমোন। দেহে এমন হরমোন বৃদ্ধিতে সাহায্য করে যেসব খাবার, সেগুলো রাখা চাই ব্রেন বুস্টিং ডায়েটে।
ডার্ক চকলেট
বয়স যা-ই হোক, চকলেট খেতে কে না ভালোবাসে! তবে সুগারবিহীন, শুধু ডার্ক চকলেটই ব্রেন বুস্টিংয়ে কার্যকরী ভূমিকা রাখে। মন ভালো করার পাশাপাশি কমায় স্ট্রেস হরমোন।
কলা
একে বলা হয় সুপার ফুড। আমাদের দেশে সারা বছর কলা পাওয়া যায়। ট্রিপটোফ্যান ও ভিটামিন বি৬ সমৃদ্ধ এই ফল মানবদেহে সেরোটোনিন তৈরিতে সহায়ক।
ডিমের কুসুম
এতে থাকে কোলিন নামক এক উপাদান, যা মস্তিষ্কের নিউরোট্রান্সমিশনে ভূমিকা রাখে। তাই প্রতিদিন অন্তত একটি ডিম খাওয়া ভালো।
গ্রিন টি
আমাদের দেশে দুধ-চা খুব জনপ্রিয়। তবে আজকাল গ্রিন টিও বেশ জায়গা করে নিয়েছে। এতে থাকা এল-থ্রিওনিন মানসিক প্রশান্তি এনে দিতে সাহায্য করে।
লাল সংকেত
খাবার শুধু আমাদের সুস্থই রাখে না, বিপদও ডেকে আনে! এমন কিছু খাবারকে আমরা নিয়মিত খাদ্যতালিকায় হরদম রেখে দিই, যেগুলো ব্রেন ফাংশন ধীরে ধীরে নষ্ট করে দিতে পারে। তাই সেগুলো শনাক্ত করে বর্জনই শ্রেয়।
অতিরিক্ত চিনি ও সোডা ড্রিংকস আমাদের ব্রেনের ক্ষতির জন্য যথেষ্ট। তাই আজই সরিয়ে ফেলুন ডায়েট লিস্ট থেকে।
প্রসেসড খাবার যেমন সসেজ, বার্গার, প্যাকেটজাত স্ন্যাকস যথেষ্ট অস্বাস্থ্যকর।
কার্ডিয়াক ইস্যু তো অবশ্যই, এমনকি মস্তিষ্কের সুস্থতা রক্ষায়ও মার্জারিন, হাইড্রোজেনেটেড অয়েল ও ট্রান্স ফ্যাট বাধা দেয়।
অতিরিক্ত ক্যাফেইন ও অ্যালকোহল মস্তিষ্কের নিউরনের কার্যক্ষমতা কমিয়ে দিয়ে স্মৃতিভ্রংশের ঝুঁকি বাড়ায়।
যাপনে দায়ভার
মস্তিষ্কের কোষগুলো সতেজ রাখতে খাবারের পাশাপাশি জীবনযাপনেও কিছু অভ্যাস গড়ে তোলা শ্রেয়।
নিয়মিত ঘুম: প্রতিরাতে ৭ থেকে ৮ ঘণ্টা ঘুম স্মৃতিশক্তি ও মনোযোগ ঠিক রাখতে সহায়ক।
মেডিটেশন ও ব্রিদিং এক্সারসাইজ: সুস্থতার জন্য প্রতিদিন ব্যায়াম জরুরি। সে ক্ষেত্রে স্ট্রেস কমাতে ও ব্রেন শান্ত রাখতে সকালে অথবা ঘুমাতে যাওয়ার আগে মেডিটেশন ও ব্রিদিং এক্সারসাইজ করা যেতে পারে।
ব্রেন এক্সারসাইজ: যেমন পাজল, দাবা, নতুন ভাষা শেখা ইত্যাদির অভ্যাস করা মঙ্গল। নতুন কিছু শেখা বা পড়ার চর্চা নিউরনে নতুন সংযোগ তৈরির পাশাপাশি ব্রেন বুস্ট করে।
শুধু শরীর ফিট রাখলেই চলবে না, চাই মস্তিষ্কের ফিটনেসও। সে জন্য খাবার হওয়া চাই ব্রেন ফ্রেন্ডলি। প্রতিদিনের পাতে একটু সচেতনতা আর সামান্য পরিবর্তনই জীবনকে করে দিতে পারে স্মার্ট, ফোকাসড ও আনন্দময়।
লেখক: প্রধান পুষ্টিবিদ ও বিভাগীয় প্রধান, পপুলার মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, ঢাকা
ছবি: ইন্টারনেট
