skip to Main Content

সুলুকসন্ধান I ডিম কীভাবে পাতে এলো

রান্নাঘরের চিরচেনা উপাদান ডিম। কিন্তু এই সহজলভ্য খাবার কি আদৌ এত সহজে এসেছে আমাদের পাতে? সহস্র বছরের ইতিহাস পেরিয়ে, নানা সংস্কৃতি, বিশ্বাস আর বৈজ্ঞানিক প্রশ্নের ভেতর দিয়ে এটি আজ জায়গা করে নিয়েছে প্রাত্যহিক খাদ্যতালিকায়। সেই যাত্রাপথের তথ্য বাতলেছেন সুবর্ণা মেহজাবীন

সকালের নাশতায় সেদ্ধ কিংবা পোচ ডিম, দুপুরে ভাতের সঙ্গে ডিম কারি, বিকেলে ডিম-টোস্ট আর রাতেও হালকা খাবার হিসেবে পাতে ডিমের উপস্থিতি। আমাদের প্রতিদিনের খাদ্যতালিকায় একটুখানি খেয়াল করলেই বোঝা যাবে, ডিম কেবল একটি খাদ্য উপাদান নয়; এ যেন খাদ্যজগতের এক নির্ভরযোগ্য নায়ক! কিন্তু কবে থেকে মানবজাতি ডিম খেতে শুরু করল? শুধুই পুষ্টিগুণের জন্য, নাকি এর পেছনে আছে ইতিহাস, সংস্কৃতি আর বিবর্তনের দীর্ঘ পথ?
এই প্রশ্নগুলোর উত্তর পেতে হলে আমাদের সময়চক্রে পিছিয়ে যেতে হবে হাজার হাজার বছর। এমনকি সেই সময়ে, যখন মানুষ ছিল শিকারি ও সংগ্রাহক। তখনো কৃষিযুগের সূচনা ঘটেনি। তবে প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের গভীর সম্পর্ক শুরু হয়েছিল অনেক আগে। খাদ্যাভ্যাসের সেই বিবর্তনে একটি বড় জায়গা দখল করে নিয়েছিল ডিম।
ইতিহাসের বাঁকে
প্রায় ৩৫ লাখ বছর আগে, বর্তমান তানজানিয়ার লায়েতোলিতে আগ্নেয় ছাইয়ের ওপর দিয়ে হেঁটে গিয়েছিল একদল আদিম মানব প্রজাতি—অস্ট্রালোপিথেকাস অ্যাফারেনসিস। তারা রেখে গিয়েছিল ৭০টি জীবাশ্ম পদচিহ্ন। ১৯৭৮ সালে ব্রিটিশ প্রত্নতাত্ত্বিক ও জীবাশ্মবিদ মেরি লিকির নেতৃত্বে আবিষ্কৃত এই অসাধারণ পদচিহ্নগুলোর কাছেই মিলেছিল আরেকটি দুর্লভ নিদর্শন—একগুচ্ছ পাখির ডিমের জীবাশ্ম। এগুলো ছিল ফ্র্যাঙ্কোলিন নামের একধরনের মুরগির, যারা গাছে বাস করলেও ডিম পাড়ে মাটিতে। সময়ের যন্ত্র ছাড়া নিশ্চিতভাবে বলা না গেলেও প্রত্নতাত্ত্বিকদের ধারণা, এই প্রাচীন মানব প্রজাতিরাই হয়তো লোভে পড়ে পাখির বাসা থেকে ডিম তুলে নিয়েছিল; সুস্বাদু আর পুষ্টিকর ডিম, যা তখনকার সময়েও ছিল এক দারুণ খাদ্য উৎস।
ডিম খাওয়ার ইতিহাস যতটা পুরোনো, পোষা মুরগির ডিম খাওয়ার ইতিহাস কিন্তু সেই তুলনায় বেশ নবীন! আজকের স্ক্র্যাম্বলড এগ যেটা সকালের নাশতায় খাচ্ছেন, সেটি খ্রিস্টপূর্ব যুগের ইউরোপবাসীর কাছে সম্পূর্ণ অপরিচিত ছিল। খ্রিস্টপূর্ব ৮০০ অব্দে ইতালিতে প্রথম মুরগি এলেও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার এই ‘জঙ্গলফাউল’ প্রাণী ও তার ডিমকে খাবার হিসেবে বিবেচনা করতে আরও কয়েক শতাব্দী সময় লেগে যায়।
উটপাখি উচাটন
প্রাচীনকালে মানুষের ডিম খাওয়ার অন্যতম সেরা প্রমাণ পাওয়া গেছে দক্ষিণ আফ্রিকায়। ডিপক্লুফ রক শেল্টারের মতো সাইটে ৬০ হাজার বছরের পুরোনো রান্নার চুলা আবিষ্কৃত হয়েছে, যেগুলোর চারপাশে ছড়িয়ে ছিল উটপাখির ডিমের অসংখ্য খোসা। একটি উটপাখির ডিম আকারে ১৮ থেকে ২৪টি মুরগির ডিমের সমান। আমেরিকান টেলিভিশন নেটওয়ার্ক ‘হিস্ট্রি চ্যানেল’-এর অফিশিয়াল অন্তর্জাল সংস্করণ ‘হিস্ট্রি ডট কম’-এ প্রকাশিত, ডেভ রুস রচিত ‘হিউম্যানস লং হিস্ট্রি অব ইটিং এগস’ শীর্ষক নিবন্ধে ইতালিয়ান প্রত্নতত্ত্ববিদ ও জীববিজ্ঞানী বিয়াত্রিচে দেমারকি বলেন, পাথর যুগের শিকারি-সংগ্রাহকদের কাছে এসব ডিম ছিল অত্যন্ত মূল্যবান। তার ভাষায়, ‘উটপাখির ডিম পুষ্টিকর, পরিষ্কার ও বহনযোগ্য। সে যুগে শিকার করা একটি হরিণ টেনে নিয়ে যাওয়ার তুলনায় কয়েকটি ডিম বহন করা অনেক সহজ ছিল।’
প্যালিওলিথিক বা প্রাচীন প্রস্তর যুগের অধিবাসীরা এই বিশাল পাখিকে তাড়িয়ে ডিম সংগ্রহ করতেন। ঝুঁকিপূর্ণ হলেও ডিমের পুষ্টি, বহনযোগ্যতা ও দীর্ঘ সময় ভোজনযোগ্য থাকার কারণে শিকারিদের কাছে তা ছিল অমূল্য। কাঁচা হোক কিংবা আগুনের পাশে ভাপানো—ডিম মানেই পুষ্টিতে ঠাসা এক খাদ্যভান্ডার। ডিম শুধু খাওয়ার জন্যই নয়; উটপাখির ডিমের খোসা ব্যবহৃত হতো পানি বহনে। এর শক্ত খোলস ছিল আদিম শিল্পীদের আঁকার ক্যানভাসও।
প্রজাতি বিলুপ্তির দায়
প্রায় ৬০ হাজার বছর আগে যখন মানুষ প্রথম অস্ট্রেলিয়ায় পৌঁছায়, তখন সেখানকার প্রাচীন মরুভূমিতে বিচরণ করত উটপাখির মতো বিশাল আকৃতির পাখি—জেনিওর্নিস নিউটোনি। থান্ডার বার্ড নামে অধিক পরিচিত এই পাখিগুলো। উড়তে না পারা এই পাখি ছিল সাত ফুট লম্বা; ওজনে প্রায় ৫০০ পাউন্ড। এর ডিম ছিল ভীষণ বড় ও আকর্ষণীয়, সে কথা বলাই বাহুল্য।
শুরুর দিকে অস্ট্রেলীয় অধিবাসীরা জেনিওর্নিস শিকার না করলেও তার ডিম লুটে নিয়ে খেতেন। আগুনে সেঁকা ডিমের খোসায় পাওয়া গেছে পোড়া দাগ; যা প্রাকৃতিক দাবানলের নয়, মানুষের আগুনে রোস্ট করার প্রমাণ। বিজ্ঞানীদের ধারণা, ডিম খেতে খেতে, প্রজননপ্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত হওয়ায় কয়েক হাজার বছরের মধ্যে জেনিওর্নিস পাখিটি বিলুপ্ত হয়ে যায়।
দেমারকি বলেন, ‘মানুষ আসার পরেই আগুনে পোড়া ডিমের খোসা দেখা যায়, আর প্রায় ৪৭ হাজার বছর আগে ওই পাখিগুলো সম্পূর্ণ অদৃশ্য হয়ে যায়—প্রত্নতাত্ত্বিক রেকর্ডে এর জোরালো প্রমাণ মিলেছে।’
আবাদ ও পাখি পালনের সূচনা
প্রায় ৭৫০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে চীন ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় বনমুরগি পোষার প্রবণতা শুরু হয়। মূলত গৃহপালিত মুরগির উদ্ভব ঘটেছে রেড জঙ্গলফাউল নামক বনমোরগ থেকে। চীন, ভারত, ইন্দোনেশিয়াসহ বিভিন্ন অঞ্চলে ধীরে ধীরে মানুষ মুরগি পালন শুরু করে এবং এগুলোর ডিম আহরণ করতে শেখে।
ধারণা করা হয়, খ্রিস্টপূর্ব ১৪০০ অব্দের দিকেই মিসর ও মেসোপটেমিয়ায় ডিম উৎপাদনের জন্য মুরগি পালন শুরু হয়। মিসরীয় অধিবাসীরা হ্যাচিং বা কৃত্রিমভাবে ডিম ফোটানোর পদ্ধতিও রপ্ত করেছিলেন। এই পদ্ধতিতে তারা উত্তপ্ত বালি ও কাঠের ছাই ব্যবহার করে ডিম উষ্ণ রাখতেন। প্রথম খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত প্রাচীন রোমান ইতিহাসবিদ প্লিনি দ্য এল্ডারের ‘ন্যাচারাল হিস্ট্রি’ গ্রন্থে এ বিষয়ের উল্লেখ রয়েছে।
ইউরোপে মুরগি, তবে খাবার নয়
খ্রিস্টপূর্ব ৯০০ অব্দের দিকে গ্রিস ও ইতালিতে বাণিজ্যপথে প্রথম মুরগি প্রবেশ করে। তবে আশ্চর্য হলেও সত্য, তখনকার ইউরোপীয় বাসিন্দারা মুরগিকে খাবার নয়; বরং ধর্মীয় আচার বা সামাজিক মর্যাদার প্রতীক হিসেবে দেখতেন। ইতালির বিভিন্ন সমাধি ও ধর্মীয় স্থানে পাওয়া গেছে প্রাচীন মুরগির কঙ্কাল, যা খাওয়া হয়নি, বরং আরাধনায় উৎসর্গীকৃত ছিল। প্রাচীন গ্রিস-ইতালিতে মুরগির উপস্থিতি অনেকটা দৈবচিহ্নের মতো—নতুন, অদ্ভুত ও রহস্যময়।
খ্রিস্টপূর্ব ৫০০ অব্দ নাগাদ, ইতালির তুসকানি অঞ্চলে মুরগির ডিম খাওয়ার চল শুরু হয়। সান কাসিয়ানো দেই বাগনি নামক স্থানের তাপ স্নানঘরে বহু ডিমের খোসা পাওয়া গেছে, যা তৎকালীন পুণ্যার্থীরা দেবতাদের উৎসর্গ করতেন। কেউ কেউ আবার এই ডিম স্নানজলে নিক্ষেপ করতেন, যেন অলৌকিক গুণে রোগমুক্তি ঘটে।
রোমানদের ডিমপ্রীতি
প্রাচীন রোমানরা শুধু মুরগির নয়, খেতেন পায়রা, তিতির, হাঁস, রাজহাঁস, কোয়েল, ময়ূর এমনকি উটপাখির ডিম। রোমে ওভিয়ারি নামে বিশেষ ডিম বিক্রেতারা থাকতেন। রোমানদের ডিমপ্রীতি এতই ব্যাপক ছিল, তারা খেলার মাঠে; যেমন ইংল্যান্ডের চেস্টার অ্যাম্ফিথিয়েটারে গ্ল্যাডিয়েটরদের যুদ্ধ দেখতে বসে ডিম খেতেন, ঠিক যেমন আমরা ফুটবল ম্যাচ দেখতে দেখতে স্ন্যাকস খাই।
প্রাচীন রোমান রান্নাঘরে ডিম ছিল এক অদ্বিতীয় উপাদান। আপিসিয়াস (‘দে রে কোকুইনারিয়া’ বা ‘অন দ্য সাবজেক্ট অব কুকিং’) শীর্ষক প্রাচীন রেসিপি বুকে প্রায় ৫০০ রেসিপি রয়েছে, যেগুলোর মধ্যে ডিমের উপস্থিতি খুবই সাধারণ। ডিম, দুধ, মধু ও গোলমরিচ মিশিয়ে তৈরি ‘ওভা স্পঞ্জিয়া এক্স লাকটে’ ছিল একধরনের স্যাভরি ওমলেট। আর ধনীদের ঘরে তৈরি হতো পাটিনা—ডিম, দুধ, মাছ বা মাংস দিয়ে তৈরি ফ্লানের মতো এক চমৎকার কাস্টার্ড। তাদের রাঁধুনিরা এমন ছাঁচ ব্যবহার করতেন, যেন কাস্টার্ড বেরিয়ে আসে মাছ বা শিকারের দৃশ্য আঁকা রূপে। কেননা, রোমানরা ছিলেন খাবারে রূপ ও রুচির প্রতি দারুণ সচেতন।
আমেরিকায় প্রসার
ষোলো শতকে ইউরোপীয় ঔপনিবেশিকদের মাধ্যমে মুরগি ও ডিমের ব্যাপক বিস্তার ঘটে দক্ষিণ ও উত্তর আমেরিকায়। ইউরোপ থেকে আগত অভিবাসীরা ডিম ও মুরগির সঙ্গে কৃষিকাজের ধারণাও নিয়ে আসেন পৃথিবীর ওই প্রান্তে। দ্রুততম সময়ে ডিম আমেরিকার প্রতিটি অঞ্চলে একটি মৌলিক খাদ্যে পরিণত হয়। বিশ শতকের মাঝামাঝি এসে ডিম উৎপাদনের জন্য বিশেষ প্রজাতির মুরগি পালন শুরু হয় এবং এর বাণিজ্যিক উৎপাদনের প্রচলন ঘটে।
প্রেক্ষাপটে দক্ষিণ এশিয়া
ভারতীয় উপমহাদেশে ডিম খাওয়ার ইতিহাসও বেশ পুরোনো। আয়ুর্বেদে ডিমের পুষ্টিগুণের উল্লেখ পাওয়া যায়। তবে বহুদিন পর্যন্ত এটি একটি বিতর্কিত খাদ্য হিসেবে বিবেচিত ছিল। সনাতন শাস্ত্রানুসারে ডিমকে ‘তামসিক’ খাদ্য হিসেবে গণ্য করা হতো এবং বহু মানুষ তা গ্রহণ করতেন না। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ধ্যানধারণার পরিবর্তন ঘটে। ভারত, বাংলাদেশ ও পাকিস্তানে ডিম ধীরে ধীরে খাদ্যতালিকায় জায়গা করে নেয়। আজকের দিনে আমাদের দেশে ডিম একটি প্রয়োজনীয় ও সহজলভ্য প্রোটিনের উৎস হিসেবে প্রতিদিনকার খাবারে স্থান পেয়েছে।
মুরগি ও মানুষের প্রথম বন্ধুত্ব
মুরগির সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক যতটা ঘনিষ্ঠ, ততটা পুরোনো নয়। আধুনিক মুরগি আসলে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার লাল বনমুরগির বংশধর। যদিও আগে ধারণা করা হতো, ১০ হাজার বছর আগেই মুরগি পোষ মানানো হয়; কিন্তু সাম্প্রতিক প্রত্নতাত্ত্বিক বিশ্লেষণে জানা যায়, প্রায় ৩৫০০ বছর আগে (খ্রিস্টপূর্ব ১৫০০ অব্দে) থাইল্যান্ডের বান নন ওয়াত অঞ্চলে ধানের চাষ শুরু হলে বনমুরগিরা খাদ্যের আশায় মানুষের কাছে আসে। এই ঘনিষ্ঠতা থেকে ধীরে ধীরে পোষ মানে মুরগি।
প্রথম দিকের মুরগিগুলো ছিল বছরের কয়েকবার ডিম দেওয়ার সক্ষমতাসম্পন্ন। তবে মুরগির এই ডিম দেওয়ার বৈশিষ্ট্যই ছিল মানুষের জন্য আশীর্বাদ। কারণ, অন্যান্য পাখির মতো বছরে একবার নয়, বরং মুরগি নিয়মিত ডিম দিতে পারে। এমনকি ডিম চুরি হলে নতুন করে আবারও ডিম পাড়ে। এই বৈশিষ্ট্যই মুরগিকে করে তুলেছে মানুষের জন্য একটি অবিচ্ছেদ্য খাদ্য সরবরাহকারী।
ডিমের জাদুবিদ্যা
ডিমের উপাদানগত বৈশিষ্ট্য প্রাচীন রাঁধুনিরাও জানতেন। এর সাদা অংশ গরম হলে জমে যায়—এ এক প্রাকৃতিক প্রোটিন থেরাপি। ডিমের কুসুম আবার চর্বি ও প্রোটিনের এমন মিশ্রণ, যাতে সহজে তৈরি করা যায় ইমালসন। প্রাচীন রোমানরা মেয়োনেজের আদি রূপ বানাতেন, যেখানে ডিম ও জলপাই তেল ধীরে ধীরে মিশিয়ে তৈরি হতো ঘন সস। পঞ্চম শতাব্দীর গ্রিক গ্রন্থে ডিমের ফেনা দিয়ে তৈরি গোলাকার খাদ্যের বিবরণ মেলে, যা সম্ভবত মেরিঞ্জের আদি রূপ।
সংস্কৃতিভেদে খাদ্যাভ্যাস ও কুসংস্কার
বিশ্বজুড়ে ডিম ঘিরে রয়েছে নানা রীতি ও কুসংস্কার। চীনের হাক্কা সম্প্রদায় মনে করে, সদ্যোজাত শিশুর পাশে ডিম রাখা শুভ। ইরানে নওরোজ উৎসবে ডিমকে নতুন জীবনের প্রতীক হিসেবে রঙিন করে সাজানো হয়। পশ্চিমা সংস্কৃতিতে ইস্টার সানডেতে ইস্টার এগ হিসেবে ডিম একটি কেন্দ্রীয় উপাদান।
বাংলাদেশে ডিম দীর্ঘদিন ধরে শুধু প্রোটিন হিসেবেই নয়; খাদ্যপছন্দের দিক থেকেও শ্রেণিবিন্যাসের পরিচায়ক ছিল। একসময় গ্রামবাংলায় ‘ফার্মের ডিম’ অনেকের কাছে নিম্নমানের খাদ্য হিসেবে বিবেচিত হতো। আবার অনেকে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে ডিম খাওয়াকে নিষিদ্ধ হিসেবে দেখেন। এই সাংস্কৃতিক ভেদাভেদ এখনো কিছুটা প্রচলিত থাকলেও, স্বাস্থ্য ও বিজ্ঞানভিত্তিক প্রচারের ফলে ডিম এখন প্রায় সকল শ্রেণির কাছে গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠেছে।
আধুনিক পুষ্টিচর্চায়
আমেরিকান খাদ্যবিজ্ঞানী হ্যারল্ড ম্যাকগি বলেন, ‘ডিমের ভেতরে রয়েছে এক সম্পূর্ণ জীব গঠনের উপাদান—প্রোটিন, চর্বি, কোষ ঝিল্লি তৈরির উপাদান, শক্তি উৎপাদনকারী যৌগ। ডিম প্রকৃতির এক বিস্ময়কর প্যাকেজ।’ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও বিভিন্ন পুষ্টিবিদ ডিমকে পূর্ণাঙ্গ প্রোটিন হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। এতে ৯টি অপরিহার্য অ্যামিনো অ্যাসিডের সমন্বয় থাকে, যা শরীরের গঠন ও মেরামতে অপরিহার্য। এ ছাড়া এতে থাকে ভিটামিন বি১২, ডি, আয়রন, ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিড, কোলিন প্রভৃতি; যা মস্তিষ্কের কার্যক্ষমতা, রক্তস্রোত এবং হাড়ের স্বাস্থ্য রক্ষায় সহায়ক।
গেল শতকের সত্তর ও আশির দশকে ডিমের কোলেস্টেরল নিয়ে স্বাস্থ্যবিষয়ক বিতর্ক তৈরি হয়েছিল। তবে আধুনিক গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে, ডিমের কোলেস্টেরল সরাসরি রক্তের কোলেস্টেরল বাড়ায় না; বরং সুষম খাদ্যাভ্যাস ও সক্রিয় জীবনধারা কোলেস্টেরলের নিয়ন্ত্রণে বেশি ভূমিকা রাখে। তাই ডিম এখন স্বাস্থ্যকর খাবার হিসেবে ব্যাপকভাবে গ্রহণযোগ্য।
প্রাণিজগতের বহুবিধ ডিম
বিশ্বজুড়ে মানুষ মুরগির পাশাপাশি হাঁস, টার্কি, কোয়েল, এমু, উটপাখির ডিমও খায়। প্রতিটি ডিমের পুষ্টিগুণ, স্বাদ ও রন্ধনপদ্ধতি আলাদা। যেমন জাপানে কোয়েলের ডিম সুশি তৈরিতে ব্যবহৃত হয়, ফ্রান্সে হাঁসের ডিম পেস্ট্রি তৈরির অপরিহার্য উপাদান এবং মধ্যপ্রাচ্যে এমুর ডিমকে বিশেষ অতিথি আপ্যায়নে ব্যবহার করা হয়। এ ছাড়া বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ডিম সংরক্ষণ ও প্রক্রিয়াজাতকরণের বিভিন্ন পদ্ধতি প্রচলিত। চীনের সেঞ্চুরি এগ বা পিদান একটি দৃষ্টান্তমূলক সংরক্ষণ পদ্ধতি, যেখানে ডিম লবণ, কাঠের ছাই ও কাদা দিয়ে মুড়িয়ে কয়েক মাস রেখে দেওয়া হয়। এর ফলে ডিমের স্বাদ, রং ও গন্ধ পরিবর্তিত হয়, যা অনেকের কাছে বিশেষ লোভনীয়।
অর্থনীতিতে অবদান
আজ ডিম শুধু একটি পুষ্টিকর খাদ্য নয়; এটি খাদ্যসংস্কৃতি, অর্থনীতি ও জনস্বাস্থ্যের সঙ্গে জড়িত। বিশ্বব্যাপী প্রতিবছর প্রায় ১ দশমিক ৬ ট্রিলিয়ন ডিম উৎপন্ন হয়। চীন একাই বিশ্বের মোট ডিম উৎপাদনের প্রায় ৪০ শতাংশ উৎপাদন করে থাকে। বাংলাদেশেও বছরে প্রায় ২ হাজার কোটি ডিম উৎপন্ন হয়। ডিম উৎপাদনে নারীর অংশগ্রহণ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। অনেক গ্রামীণ নারী ছোট পরিসরে হাঁস-মুরগি পালনের মাধ্যমে আয় করেন।
মানব সংস্কৃতির আলোয়
ডিমের ইতিহাস মানবসভ্যতার বিবর্তনের আঙিনায় একটি চমকপ্রদ অধ্যায়। শিকারি থেকে কৃষকের পথপরিক্রমায়, খাদ্যনিরাপত্তা থেকে ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক আচার-অনুষ্ঠানে এর উপস্থিতি মানুষের জীবনযাত্রায় এক অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে। রন্ধনশৈলীতে বহুমুখী ব্যবহার, পুষ্টিগুণের বৈচিত্র্য, সামাজিক ও অর্থনৈতিক ভূমিকা—সব মিলিয়ে ডিম আমাদের সঙ্গে হাজার বছরের এক নিখুঁত বন্ধনে যুক্ত।
ভবিষ্যতের পাতে
ডিম নিয়ে এই যে ইতিহাস, বিজ্ঞান, সংস্কৃতি, বিতর্ক আর বিপণনের কাহিনি—সব মিলিয়ে প্রশ্ন থেকে যায়, ডিমের ভবিষ্যৎ রূপ কেমন দাঁড়াবে। পরিবর্তিত খাদ্যনীতি, পরিবেশবান্ধব কৃষিপদ্ধতি, স্বাস্থ্যসচেতনতা ও সামাজিক গ্রহণযোগ্যতা মিলিয়ে এর ভবিষ্যৎ জটিল অথচ সম্ভাবনাময়। বিকল্প প্রোটিনের উৎস হিসেবে এখন গবেষণা চলছে ভেগান এগ বা উদ্ভিজ্জ উপাদান দিয়ে তৈরি ডিমের বিকল্প নিয়েও। এটি খাদ্যনিরাপত্তা, পরিবেশ সুরক্ষা এবং প্রাণিসম্পদ কল্যাণের ক্ষেত্রে নতুন পথ দেখাচ্ছে। তবু যত দিন না চূড়ান্ত কোনো পরিবর্তন আসে, প্রাতরাশে একটুখানি নুন আর মরিচ ছিটিয়ে ভাজা ডিমের আবেদন অমলিন থাকবে। সময়ের সঙ্গে ডিমের রূপ বদলালেও এর মৌলিক আবেদন, স্বাদ, পুষ্টি আর পরিচিতির জায়গা রয়ে যাবে অটুট।
আজকের দিনের একটি ছোট্ট ডিমের ভেতর লুকিয়ে আছে সেই প্রাচীন গল্প, যা যুগে যুগে মানুষের হাত ধরে এসে দাঁড়িয়েছে আমাদের খাবারের প্লেটের এক বিশেষ স্থানে। সেই ইতিহাসের চিরন্তন প্রবাহ নতুন করে বুঝতে শেখায়—ডিম শুধু খাবার নয়, বরং মানবসভ্যতার এক প্রাণবন্ত স্বাক্ষর।

ছবি: ইন্টারনেট

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top