skip to Main Content

ফিচার I খাদ্য বাছাইয়ে সোশ্যাল মিডিয়া

খাবার নির্বাচনে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম একটি আধিপত্যশীল শক্তি। ইনস্টাগ্রাম, টিকটক, ফেসবুকের মতো প্ল্যাটফর্মে ফুড, স্ন্যাকস, ডায়েট ট্রেন্ড নিয়ে প্রচুর পোস্ট ছড়িয়ে থাকে; যা আমাদের খাদ্যরুচির ওপর গভীর প্রভাব ফেলে। অনুসন্ধান করেছেন ফুয়াদ রূহানী খান

রন্ধনশৈলীতে সৃজনশীলতা উজ্জীবিত করা থেকে শুরু করে অস্বাস্থ্যকর খাবারের প্রতি আকর্ষণ জাগানো—সব ক্ষেত্রে খাবারসম্পর্কিত নিজ রুচিবোধ কিংবা পছন্দ তৈরিতে সোশ্যাল মিডিয়ার ভূমিকা জটিল ও ব্যাপক। এই প্ল্যাটফর্মগুলোর ক্ষেত্রে ‘উই ইট উইদ আওয়ার আইজ’ উক্তিটি বিশেষভাবে প্রযোজ্য। সুস্বাদু খাবার ও নাশতার উচ্চমানের ছবি ও ভিডিও ইনস্টাগ্রামের মতো প্ল্যাটফর্মে ব্যাপক শেয়ার হয়। নিখুঁতভাবে সাজানো রঙিন দৃষ্টিনন্দন খাবারগুলো মনোযোগ আকর্ষণ, ক্ষুধা জাগানো এবং এমনকি খাবারের পছন্দ নির্ধারণেও করে প্রভাব বিস্তার।
প্রভাব প্রক্রিয়া
সোশ্যাল মিডিয়ায় খাবারের পোস্ট দেখে ভোজনরসিকদের মনে তীব্র প্রতিক্রিয়া ঘটা সম্ভব। গবেষণায় ইঙ্গিত পাওয়া যায়, মুখরোচক খাবারের ছবি দেখলে মস্তিষ্কের রিওয়ার্ড সেন্টার সক্রিয় হয়। এর ফলে ক্ষুধা এবং আকস্মিকভাবে খাওয়ার প্রবণতা বেড়ে যায়। এই প্রভাবে উচ্চ ক্যালরিযুক্ত লোভনীয় খাবার; যেমন বার্গার, পিৎজা বা ডেজার্টে বিশেষভাবে আসক্তি লক্ষণীয়। তা ছাড়া সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম শুধু আমাদের যা চাই, তা-ই দেখায় না; বরং খাবার হিসেবে কোনটি আকর্ষণীয় হওয়া উচিত, তা-ও অনেকটা নির্ধারণ করে দেয়। ‘রেইনবো ব্যাগল’, ‘ডালগোনা কফি’ বা ‘ক্লাউড ব্রেড’ জাতীয় ভাইরাল খাবারের ট্রেন্ডগুলো দেখিয়ে দেয়, জনপ্রিয় কনটেন্টের প্রভাবে কত দ্রুত মানুষের খাদ্যপছন্দ বদলে যেতে পারে।
ইনফ্লুয়েন্সার উত্থান ও খাদ্য প্রবণতার বিস্তার
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ইনফ্লুয়েন্সাররা খাদ্যসংস্কৃতি গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। রেস্তোরাঁ রিভিউ করা, রেসিপি উপস্থাপন কিংবা খাদ্য চ্যালেঞ্জে অংশ নেওয়া—এমন খাদ্যসম্পর্কিত বিষয়ভিত্তিক কনটেন্ট নির্মাণে অনেকে দক্ষ। মিলিয়ন মিলিয়ন ফলোয়ারের মাধ্যমে এ ধরনের কনটেন্ট ক্রিয়েটররা তাদের দর্শকদের খাদ্যপছন্দে বিশাল প্রভাব ফেলতে সক্ষম।
ফাস্ট ফুড ইনফ্লুয়েন্সার: দ্বিধারী তলোয়ার
ফাস্ট ফুড ব্র্যান্ডগুলো পণ্য প্রচারণায় ইনফ্লুয়েন্সারদের সঙ্গে অংশীদারত্ব করছে। এই সহযোগিতাগুলো পণ্যের দৃশ্যমানতা ও বিক্রি বাড়াতে সহায়ক। তবে এই প্রক্রিয়ায়; বিশেষ করে তরুণদের মাঝে অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস প্রচারের বিষয়ে উদ্বেগও তৈরি হয়। অন্যদিকে, ইনফ্লুয়েন্সাররাও পুষ্টিকর রেসিপি, উদ্ভিদভিত্তিক ডায়েট কিংবা টেকসই খাদ্যচর্চা তুলে ধরে স্বাস্থ্যসম্মত আহারের অভ্যাস উৎসাহিত করতে পারেন। একজন ইনফ্লুয়েন্সারের প্রভাব মূলত নির্ভর করে তিনি কী ধরনের কনটেন্ট তৈরি ও বার্তা উপস্থাপন করেন, সেটির ওপর।
বিজ্ঞাপনের ভূমিকা
সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মগুলোতে টার্গেটেড বিজ্ঞাপনের ছড়াছড়ি। খাদ্যশিল্প একে কাজে লাগিয়ে ভোক্তাদের কাছে নতুন উপায়ে পৌঁছে যাচ্ছে। সোশ্যাল মিডিয়ায় বেশির ভাগ ক্ষেত্রে মানুষের কামনা ও আবেগের সঙ্গে খাপ খাইয়ে ডিজাইন করা, উচ্চ ক্যালরিযুক্ত ও কম পুষ্টিগুণসম্পন্ন খাদ্যপণ্য বা খাবারের বিজ্ঞাপন প্রচার করা হয়। এ ধরনের বিজ্ঞাপন যে কারও খাদ্য বাছাইকে নানাভাবে প্রভাবিত করতে পারে।
টার্গেটেড মেসেজিং
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম অ্যালগরিদম ব্যবহারকারীদের ব্যক্তিগত পছন্দ, অবস্থান ও ব্রাউজিং অভ্যাসের ওপর ভিত্তি করে ডেটা সংগ্রহ এবং সেই ভিত্তিতে তাদের জন্য বিজ্ঞাপন নির্ধারণ করে। যেমন ‘বেস্ট বার্গার নিয়ার মি’ সার্চ করলে ব্যবহারকারী স্থানীয় ফাস্ট ফুড চেইন বা খাবার ডেলিভারির বিজ্ঞাপন দেখতে পান।
ইমোশনাল অ্যাপিল
খাবারসম্পর্কিত বিজ্ঞাপনগুলো প্রায়ই নস্টালজিয়া এবং আনন্দ বা বিলাসিতার অনুভূতির মতো আবেগ কাজে লাগিয়ে ভোক্তার সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করে। এই কৌশলগুলো যৌক্তিক সিদ্ধান্তপ্রক্রিয়াকে কিছুটা দুর্বল করে তোলে; ফলে আকস্মিক কেনাকাটার প্রবণতা তৈরি হয়।
সাংস্কৃতিক আবেদন
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম খাবার ব্র্যান্ডগুলোর বার্তাকে সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপটের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেওয়ার সুযোগ দেয়। যেমন ছুটির মৌসুমে আরামদায়ক খাবারের প্রচার অথবা গ্রীষ্মকালে সতেজ পানীয়ের ওপর জোর দেওয়া। খাবারের বিজ্ঞাপনের সর্বব্যাপী উপস্থিতি ভোক্তাদের জন্য সত্যিকারের খাবারের বিষয়বস্তু এবং স্পনসর করা পোস্টের মধ্যে পার্থক্য নির্ণয় কঠিন করে তোলে। এটি পছন্দ ও প্রভাবের সীমারেখা আরও জটিল করে দেয়।
প্রযুক্তি ও খাদ্য বাছাই
বিজ্ঞাপন ছাড়াও প্রযুক্তি নিজে আমাদের খাদ্যের প্রতি আগ্রহের ধরনকে প্রভাবিত করতে সক্ষম। কনটেন্ট কিউরেট করতে অ্যালগরিদম থেকে শুরু করে ফুড ডেলিভারি অ্যাপের উত্থান পর্যন্ত প্রযুক্তি আমাদের খাদ্য সম্পর্কে চিন্তা করার এবং তা পাওয়ার পদ্ধতি পুনর্গঠন করেছে।
এলাহি অ্যালগরিদম
সোশ্যাল মিডিয়া অ্যালগরিদম চমকপ্রদ খাবারের ছবি বা ভাইরাল চ্যালেঞ্জের মতো অধিক এনগেজমেন্ট অর্জন করা কনটেন্টকে অগ্রাধিকার দেয়। ফলে, ব্যবহারকারীদের সামনে অতিরিক্ত পরিমাণে এমন কনটেন্ট আসে, যা বিলাসবহুল বা ট্রেন্ডি খাবারের ওপর কেন্দ্রীভূত। এটি খাওয়ার স্বাভাবিক বা কাম্য বিষয় সম্পর্কে আমাদের ধারণাকে পরিবর্তন করতে পারে। এই প্রভাবের ফলে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে খাবারের ছবি বা ভিডিওগুলো আমাদের খাদ্যাভ্যাস ও পছন্দের ওপর উল্লেখযোগ্য প্রভাব ফেলতে পারে; বিশেষ করে উচ্চ ক্যালরিযুক্ত ও চর্বিযুক্ত খাবারের ছবি বেশি পছন্দ ও শেয়ার হওয়ার কারণে এ ধরনের কনটেন্ট আরও বেশি প্রচারিত হয়। এটি আমাদের খাদ্যাভ্যাসকে প্রভাবিত করে এবং কখনো কখনো অস্বাস্থ্যকর খাবারের প্রতি আগ্রহ বাড়িয়ে তোলে।
সুবিধা ও লোভের মেলবন্ধন
সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মের সঙ্গে যুক্ত ফুড ডেলিভারি অ্যাপগুলো লোভের প্রতি প্রতিক্রিয়া জানানোকে আগের চেয়ে সহজ করে তুলেছে। একটি লোভনীয় খাবারের পোস্ট সরাসরি কয়েকটি ট্যাপের মাধ্যমে অর্ডারে পরিণত হতে পারে। এটি তাৎক্ষণিক সন্তুষ্টির অনুভূতিকে আরও শক্তিশালী করে তোলে।
চাপে চুরমার
সোশ্যাল মিডিয়া শুধু খাবার উপস্থাপন করে না; বরং সামাজিক প্রেক্ষাপটে সেটির আবেদন বাড়িয়ে দেয়। কেননা, কেউ যখন নিজের বন্ধু বা পরিবারের সদস্যদেরকে তাদের খাবার, খাদ্যাভ্যাস বা রেস্তোরাঁ অভিজ্ঞতা শেয়ার করতে দেখেন, অবচেতনেই তার ব্যক্তিগত খাদ্যপছন্দের ওপর তা প্রভাব ফেলতে পারে।
সোশ্যাল প্রুফ
সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহারকারী যখন সমকক্ষ কাউকে একটি ট্রেন্ডি রেস্তোরাঁয় খেতে বা কোনো ভাইরাল ফুড ট্রেন্ড চেখে দেখার চেষ্টা করতে দেখেন, তখন সেটি নিজেও আস্বাদনের একধরনের সামাজিক চাপ তার ওপর তৈরি হতে পারে। ব্যাপারটি ‘সোশ্যাল প্রুফ’ নামে পরিচিত, যা বিশেষ করে তরুণদের মধ্যে খাদ্য আচরণ গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়।
শেয়ার কালচার
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম খাবার ঘিরে একধরনের কমিউনিটি গড়ে তোলে, যা ব্যবহারকারীদের বিভিন্ন ধরনের রন্ধনশৈলী আবিষ্কার কিংবা নতুন রেসিপি যাচাইয়ে উৎসাহিত করে। ‘ফুডি’ বা ‘ভেগানলাইফ’-এর মতো হ্যাশট্যাগগুলো একই ধরনের আগ্রহসম্পন্ন মানুষদের পরস্পর সংযুক্ত এবং তাদের খাবারের পছন্দকে ইতিবাচকভাবে প্রভাবিত করে।
রেস্তোরাঁর বিপণন
রেস্তোরাঁগুলোর ক্ষেত্রে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম একটি অপরিহার্য মার্কেটিং টুলে পরিণত হয়েছে। ছোট রেস্তোরাঁগুলোর জন্য কার্যকরী মার্কেটিং স্থানীয় গ্রাহকদের আকৃষ্ট এবং একটি বিশ্বস্ত কাস্টমার বেস গড়ে তুলতে সাহায্য করতে পারে। এই প্ল্যাটফর্মগুলো খাবারের ছবি প্রদর্শন, ব্র্যান্ড পরিচয় তৈরি এবং সরাসরি গ্রাহকদের সঙ্গে যোগাযোগ করার জন্য একটি ব্যয়-সাশ্রয়ী উপায় জাহির করে। এ ক্ষেত্রে সাফল্য পাওয়ার রয়েছে কিছু চলতি কৌশল।
ভিজ্যুয়াল স্টোরিটেলিং
উচ্চমানের ছবি ও ভিডিওই সফল রেস্তোরাঁ মার্কেটিংয়ের মূল ভিত্তি। অনেক রেস্তোরাঁ এখন তাদের খাবার, পরিবেশন ও অভিজ্ঞতাকে হাইলাইট করতে পেশাদার ফটোগ্রাফার বা কনটেন্ট ক্রিয়েটর নিয়োগ দেয়।
এনগেজমেন্ট ও কমিউনিটি
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কমেন্টের রিপ্লাই দেওয়া, গ্রাহকদের ছবি পুনঃপ্রচার এবং ইন্টার্যাকটিভ ক্যাম্পেইন চালানো—এসব ক্রিয়াকলাপ ভোক্তাদের সঙ্গে সংযোগ আর আনুগত্যের অনুভূতি তৈরি করে।
সহযোগিতা ও অংশীদারত্ব
ইনফ্লুয়েন্সার বা ফুড ভ্লগারদের সঙ্গে অংশীদারত্ব রেস্তোরাঁর দর্শক তথা গ্রাহকসংখ্যা বহুগুণে বাড়াতে পারে। এ ছাড়া এর মাধ্যমে নতুন গ্রাহক পাওয়া এবং সুনাম দৃঢ়তর করা সম্ভব।
প্রমোশন ও ইভেন্ট
দক্ষভাবে সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রচার করলে সীমিত সময়ের অফার বা থিমভিত্তিক ইভেন্ট বিশেষ আগ্রহ তৈরি করতে এবং ফুড ট্রাফিক বাড়াতে পারে।
আমরা কী খাই, তা থেকে শুরু করে খাদ্যবিষয়ক ভাবনা পর্যন্ত খাবারের সঙ্গে আমাদের যোগাযোগ স্থাপনের ধরনে সোশ্যাল মিডিয়া এক গভীর পরিবর্তন এনে দিয়েছে। হোক ইতিবাচক কিংবা নেতিবাচক—এর কোনো প্রভাবকেই এ সময়ে এড়িয়ে যাওয়ার তেমন উপায় নেই!

ছবি: ইন্টারনেট

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top