ফিচার I সিল দ্য ডিল
ভালোবাসা প্রকাশের ভঙ্গি। কিন্তু তাতেই লেপ্টে যেতে পারে সাধের লিপস্টিক। হতেও পারে স্থানান্তরিত। বিড়ম্বনাই বটে। এসব অস্বস্তিকর পরিস্থিতিতে কিস প্রুফ কসমেটিক যেন এক আশীর্বাদ। লিখেছেন সারাহ্ দীনা
টিকটকের ভাইরাল কিস টেস্টে মিলিয়ন মানুষকে আগ্রহী হতে দেখা গেছে। উদ্দেশ্য—চিহ্নহীন চুমু। এমন লিপস্টিকের বাজারও কলেবরে বেড়েছে। তাই কিস প্রুফ কসমেটিকস এখন মোটেই নতুন কিছু নয়। কিন্তু এই নিয়ে ভাবনা শুরু হয়েছিল অনেক আগে। সেই ১৯৫০ সালে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী সময়টাতে হলিউড দর্শকদের ব্যাপকভাবে পরিচয় করিয়ে দেয় চুমুর সঙ্গে। মেরিলিন মনরো, এলিজাবেথ টেলর, গ্রেস কেলি তখন পর্দায় উজ্জ্বল। এই কালজয়ীরা সেট করছেন বিউটি স্ট্যান্ডার্ড। যেখানে দেখা যাচ্ছে লিপস্টিকে নিখুঁত ঠোঁট, মসৃণ কপোল এবং নিপুণ নারীত্ব।
লিপস্টিকের ব্যবহার যতই বাড়ে, ততই বৃদ্ধি পায় অনাকাঙ্ক্ষিত স্থানান্তরের ভয়। সে কেমন? লিপস্টিক দেখা যেতে থাকে কফি কাপে, ন্যাপকিনে, জুসের গ্লাসে তো কখনো প্রেমিকের গালে। সমস্যা যে শুধু গ্রহীতার হতো, তা কিন্তু নয়। দাতাও অনেক সময় পড়ে যেতেন বিপদে! চুমু শেষে একদম মিলিয়ে যেত লিপস্টিকও। সর্বনাশের চূড়ান্ত। সেই বিড়ম্বনাতেই আশার আলো দেখতে পান সৌন্দর্য ব্যবসায়ীরা। শুরুয়াত সেখানেই। সেই বছরে একজন রসায়নবিদ আবিষ্কার করেন লাস্টিং লিপস্টিক। এই কেমিস্টের নাম হ্যাজেল বিশপ। পড়াশোনা তার অরগানিক কেমিস্ট্রিতে। তার আবিষ্কৃত বেশি সময় টিকে থাকার লিপস্টিকটি বাজারে আসে চমকে দেওয়া একটি ট্যাগলাইন নিয়ে। ‘স্টেইস অন ইউ, নট অন হিম’। এই সেনসেশনাল লাইনের মাদকীয়তায় ভালোই বুঁদ হন সে সময়কার ক্রেতারা। এই প্রথম কোনো লিপস্টিক বাজারজাতকরণে ক্রেতার অস্বস্তিকর অবস্থার নিদান নিয়ে ভাবা হয়। স্বাভাবিকভাবে এই ইতিবাচকতায় মুগ্ধ হন তারা।
হ্যাজেলের এই যুগান্তকারী আবিষ্কারের মূলে ছিল রসায়নের কারিকুরি। সে সময়ের প্রচলিত লিপস্টিক তৈরি করা হতো ওয়াক্স ব্যবহার করে, আর হ্যাজেলের ফর্মুলায় তেল ও স্টানিং ডাই ব্যবহারে সম্পন্ন হয় পুরো প্রক্রিয়া। তাতেই বাজিমাত। কিস প্রুফ কোয়ালিটির সঙ্গে পরিচিত হয় বিশ্ব। এই বাজারে প্রতিযোগিতা শুরু হয় খুব দ্রুত। হ্যাজেলের প্রথম প্রতিদ্বন্দ্বী রেভলন। যুক্তরাষ্ট্রের এই কসমেটিক কোম্পানি অতি দ্রুত সময়ে বাজারে আনে একই ফর্মুলার লিপস্টিক। বাজারজাতকরণের সময়ে ব্যবহার করা হয় দুটি ক্যাচি ট্যাগলাইন। ‘ইট ওন্ট কিস অব’ এবং ‘স্টেইস ট্রু লঙ্গার’। এর পরপরই পোল্যান্ডের কোম্পানি ম্যাক্স ফ্যাক্টর বাজারে আনে তাদের পণ্য। সেখানে ফর্মুলা ছিল ফিল্ম-বেসড। এটা তৈরি করা হয় মূলত অভিনেত্রীদের টার্গেট করে। যারা দীর্ঘ সময় প্রচণ্ড আলোতে কাজ করেন উচ্চ তাপমাত্রায়। আবার, যাদের কিসিং সিনেও অভিনয় করতে হয়।
চাহিদার পারদ একের পর এক মাইলস্টোন ছুঁতে থাকে। তবে শুরু থেকে এ পর্যন্ত বহুবার পরিবর্তন এসেছে ফর্মুলায়। ভোলাটাইল অয়েল বেসড লিপস্টিক ব্যবহারের পরে খুব দ্রুত বাষ্প হয়ে উড়ে যেত তৈলাক্ত উপাদানটি। পিগমেন্টের ছোঁয়া থাকত ঠোঁটজুড়ে। শুষ্ক হতো ঠোঁট। অনেক সময়ে ঠোঁটের চামড়া ফেটে যাওয়ার মতো ঘটনার সম্মুখীন হতেন ব্যবহারকারীরা। আবার দীর্ঘ সময় টিকে থাকার গুণও আদতে ছিল না সব কটির। একটুখানি স্পর্শেই সৌন্দর্য নষ্ট হতে শুরু করে। কিন্তু তাই বলে যে চাহিদা কমে যায়, তা মোটেই নয়; বরং অন্তরঙ্গ সময়ে সুন্দরতা ধরে রাখা নিয়ে প্রসাধন কোম্পানিগুলো ভাবতে শুরু করে। এতে তৈরি হয় তীব্র আকর্ষণ। বাণিজ্যিক দিকেও অনন্য হয়ে আছে এই বিশেষ গুণসম্পন্ন পণ্যগুলো। তারা নারী চাহিদাকে প্রাধান্য দিয়ে মার্কেটিং প্ল্যান সাজাতে শুরু করে। সেখানে নারীত্ব, আত্মনিয়ন্ত্রণ ও কমনীয়তা গুরুত্ব পেত।
সব মুহূর্তেই সুন্দরতা ধরে রাখার মন্ত্রণায় মুগ্ধতা ছড়িয়ে যাচ্ছে এখনো। আর ঠোঁটের সৌন্দর্য নিয়ে আগ্রহ সে বেশ পুরোনো। পান খেয়ে ঠোঁট লাল করার কাহিনি মোটেই আজকের নয়। সেই আগ্রহ প্রকাশ পায় গ্লোবাল কালার কসমেটিকস রেভিনিউতে। দেখা যায় মোট আয়ের ৩০ শতাংশ আসে লিপস্টিক থেকে; বিশেষ করে ম্যাট লিকুইড লিপস্টিক সেগমেন্টে, যার অন্য নাম কিস প্রুফ লিপস্টিক, সেটি ২০১৬ সাল থেকে মাল্টি বিলিয়ন ডলারের ইন্ডাস্ট্রি হিসেবে টিকে আছে। হাই সেলিং প্রোডাক্টের মধ্যে আছে মেবিলিন সুপার স্টে, ফেন্টি স্টানা। ১২ থেকে ১৬ ঘণ্টা অবধি টিকে থাকার ক্ষমতা রয়েছে এ দুটির। দক্ষিণ এশিয়ার অধ্যায়েও পাওয়া যায় ধারাবাহিকতা। জানা যায় ব্রাইডাল মেকআপে কিস প্রুফ লিপস্টিকের চাহিদা তুঙ্গে থাকার কথা। যদিও এই অঞ্চলে বিয়ের আয়োজনে বর-কনে চুমু খাওয়ার রীতি নেই; বরং দীর্ঘ সময় আলো-গরমে ঘেমে যাওয়া থেকে রক্ষাই আছে মূলে। এই বিশাল বাজারের পেছনে যুক্তি খুঁজতে গেলে জানা যায়, পোস্টকোভিড লাইফস্টাইলে মাস্ক যেহেতু ছিল মাস্ট, তাই এ সময়ে লিপস্টিক টিকিয়ে রাখা হয়েছিল বেশ কঠিন। মাস্কের স্পর্শে সহজে সুন্দরতা হারাত। অনলাইন ডেটিংয়ের জনপ্রিয়তাও একটি কারণ হিসেবে বিবেচিত হয়। কারণ, এখানে দীর্ঘ সময় ধরে মেকআপ ধরে রেখে অন্য কাজ চালিয়ে যাওয়ার পাশাপাশি ভিডিও কলে ব্যস্ত থাকার অভ্যাস গড়ে উঠেছিল।
মেল গ্রুমিংয়ের পণ্য; যেমন লিপ টিন্ট এবং বামও তৈরি করা হচ্ছে একই ফর্মুলায়। গ্লোবাল লং ওয়্যার মেকআপ মার্কেটের সাইজ ২০২৪ সালে এসে দাঁড়ায় প্রায় ১৪ মিলিয়ন মার্কিন ডলারে। কি সেগমেন্টের তালিকার প্রথমে পাওয়া যায় লিপস্টিক। এরপরে আসে ফাউন্ডেশন, সেটিং এবং আই মেকআপ। সবচেয়ে বড় বাজার যুক্তরাষ্ট্র, চীন, দক্ষিণ কোরিয়া ও ব্রাজিলে বলে জানা যায়। চুমুকে মিষ্টি হিসেবে অভিহিত করা হয় বেশির ভাগ গল্প, উপন্যাসে। সেই মিষ্টি ছোঁয়া বহুক্ষণ টিকিয়ে রাখার চেষ্টা চলবে, এ তো অস্বাভাবিক কিছু নয়!
মডেল: সিনথিয়া
মেকওভার: পারসোনা
ছবি: কৌশিক ইকবাল
