skip to Main Content

এডিটর’স কলাম I চিৎকার চমক

‘চিৎকার করো মেয়ে, দেখি কত দূর গলা যায়’—হালের খুব চেনা স্লোগান। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোতে চালু আছে। ঢাকার নানা দেয়ালচিত্রে দেখা গেছে; এমনকি পোস্টারেও

চিৎকার। পুস্তকি অর্থে, মনের আবেগ কিংবা ভয় থেকে সৃষ্ট তীব্র শব্দ। ব্যবহারিক অর্থে, মনের ভেতর গভীর ক্রোধ বা হতাশা চেপে রাখলে কিংবা ভীষণ ভড়কে গেলে মানুষ চিৎকার করে সেটির প্রকাশ ঘটায়। নরওয়েজিয়ান চিত্রশিল্পী এদভার্দ মুঙ্খের বিখ্যাত চিত্রকর্ম ‘দ্য স্ক্রিম’ তথা ‘চিৎকার’ নিশ্চয় দেখেছেন অনেকে। ১৮৯৩ সালে প্রকাশিত ওই চিত্রকর্মে একটি মানবমূর্তিকে নিজের কানের কাছে দুহাত চেপে রেখে চিৎকার করতে দেখা যায়। এই ছবি আঁকার আগে, চিৎকারের মতো একটি তীব্র অভিব্যক্তিকে চিত্রশিল্পের ভাষায় ফুটিয়ে তোলার দুরূহ অথচ সফল প্রয়াস চালানোর প্রাক্কালে, এর আবহ উপলব্ধি সম্পর্কে মুঙ্খ ১৮৯২ সালের ২২ জানুয়ারি তার দিনলিপিতে লিখেছেন, ‘এক সন্ধ্যায় একটি রাস্তা ধরে হাঁটছিলাম। এক পাশে শহর, নিচে সমুদ্রের খাঁড়ি। ভীষণ ক্লান্ত আর অসুস্থতা অনুভব করছিলাম। থমকে দাঁড়িয়ে খাঁড়িটির দিকে তাকিয়ে রইলাম। সূর্য তখন অস্তমান; মেঘগুলো ধারণ করেছিল রক্তের মতো লাল রং। প্রকৃতির ভেতর দিয়ে একটি চিৎকার প্রবাহিত হওয়া অনুভব করছিলাম আমি। মনে হয়েছিল, যেন চিৎকারটি শুনতে পাচ্ছি। সেই ছবি এঁকেছি। তাতে মেঘের রং এঁকেছি সত্যিকারের রক্তরঙা। স্বয়ং রংই তীব্র চিৎকার করছে যেন।’ শিল্পমন এমনই গভীর বোধী; প্রকৃতির চিৎকারও উপলব্ধি করতে সক্ষম। অথচ আমরা অনেকে বিভিন্ন সময় খুব কাছের মানুষের যন্ত্রণা, গ্লানি অনুভব করতে পারি না, যতক্ষণ না ওই মানুষ চিৎকার করে তা জানান দেন।
দুই
মানুষের বেড়ে ওঠার কালে পরিবার ও সমাজ নানাবিধ শিষ্টাচারের শিক্ষা দেয়। এগুলোর মধ্যে জোরে কথা না বলা, চিৎকার-চেঁচামেচি না করা উল্লেখযোগ্য। ফলে ক্রোধ, হতাশা বা ভয় নিজের ভেতরে পুষে রাখার অভ্যাস মানুষ আপনাআপনিই রপ্ত করে নেয়। আর তা মানসিক চাপ বাড়াতে বাড়াতে একসময় ডেকে আনতে পারে মহাবিপর্যয়। তাই কিছু ক্ষেত্রে চিৎকার করে এসব অনুভূতি উগরে দেওয়ার পক্ষে আওয়াজ তোলেন বিশেষজ্ঞরা। পশ্চিমা দুনিয়ায় রীতিমতো নিয়ম করে চিৎকার চর্চার চল শুরু হয়ে গেছে বেশ আগেই; যদিও আমাদের দেশে এখনো তা ব্রাত্য অনেকটা।

তিন
মানুষের মনে নানা আবেগের বসবাস। কিছু আবেগ এতই জটিল, তা প্রকাশ করা সব সময় সম্ভব হয়ে ওঠে না; ভেতর থেকে কুরে কুরে খায়। এমন আবেগ উগরে দেওয়ার জন্য চিৎকার হতে পারে সেরা উপায়—এই অভিমত যুক্তরাজ্যের বার্মিংহাম সিটি ইউনিভার্সিটির সিনিয়র লেকচারার ড. রেবেকা সেমেন্স-হুইলারের। স্নায়ুমনোবিজ্ঞান, চেতনা ও জ্ঞান বিষয়ে বিশেষজ্ঞ তিনি। বিবিসি রেডিও ফোরের এক পডকাস্টে তিনি বলেন, এমন আবেগগুলোকে চেপে রাখা হলে ফল হতে পারে ভয়াবহ। এমনকি তা ট্রমা রূপ ধারণ করতে পারে। তাই এগুলোকে চিৎকারের মাধ্যমে মন থেকে বের করে দেওয়াই উত্তম। এর রয়েছে আরও হরেক উপকারিতা। এটি বিশেষত নারীদের বৈরী পরিবেশে নিজ ক্ষমতা প্রকাশের মাধ্যম হতে সক্ষম। তাই ছোটবেলা থেকে বিদ্যালয়েও শিক্ষার্থীদেরকে চিৎকার চর্চার পরামর্শ দিয়ে থাকেন পশ্চিমা বিশেষজ্ঞরা। ব্রিটিশ বিহেভিওরাল অ্যান্ড ডেটা সায়েন্টিস্ট এবং যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের একাধিক বিশ্ববিদ্যালয়ের খণ্ডকালীন শিক্ষক ড. প্রজ্ঞা আগরওয়ালের মতে, ‘আমি আমার সন্তানদের দেখাতে চাই, নারীত্ব মানে নিজেকে ছোট ভাবা নয়; বরং যোদ্ধার উচ্চতায় দাঁড়ানো এবং নিজ শক্তি ও ক্ষমতা অনুভব করে প্রয়োজনে আওয়াজ তোলা। তার মানে, চিৎকার করে নিজ অবস্থান জানান দেওয়া ক্ষেত্রবিশেষে অপরিহার্য।’

চার
আচম্বিত চিৎকার কণ্ঠস্বরের মারাত্মক ক্ষতি করতে পারে, তা সহজে অনুমেয়। অথচ প্রয়োজনে চিৎকার করার বিকল্পও থাকে না অনেক সময়। তাই সঠিক উপায়ে চিৎকার চর্চার ওপর জোরারোপ করছেন বিশেষজ্ঞরা। সে ক্ষেত্রে কিছু বিষয় খেয়াল রাখা তাৎপর্যপূর্ণ। শুরুতে গুরুত্ব দেওয়া শ্রেয় চিৎকারের ক্ষেত্রে কম বাতাস ব্যবহার করা। আগে থেকে ঠোঁট খোলা রাখা, কণ্ঠে মৃদু আওয়াজ চালু করা, ঘাড়ের সঠিক অবস্থান নিশ্চিতকরণ, পিঠ শক্ত কোনো কিছুতে ঠেস দেওয়া, হাঁটু ভাঁজ করে নেওয়া, কণ্ঠস্বরের খানিকটা অনুশীলন ইত্যাদি ধাপ অনুসরণে চিৎকার চর্চা করা মঙ্গল। শুরুতে অভিজ্ঞ কারও কিংবা কোনো বিশেষজ্ঞের পরামর্শ মেনে এর অনুশীলন করা উপকারী। এই অনুশীলনের তাৎপর্য সবার মাঝে ছড়িয়ে দিতে ১২ অক্টোবর পালিত হয় ‘ইন্টারন্যাশনাল মোমেন্ট অব ফ্রাস্ট্রেশন স্ক্রিম ডে’।

পাঁচ
‘চিৎকার করো মেয়ে, দেখি কত দূর গলা যায়’—হালের খুব চেনা স্লোগান। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোতে চালু আছে। ঢাকার নানা দেয়ালচিত্রে দেখা গেছে; এমনকি পোস্টারেও। মূলত নারী নিপীড়নবিরোধী মিছিলগুলোতে এই স্লোগান বেশ চাউর। কথাগুলো আসলে পশ্চিমবঙ্গের গীতিকার, সুরকার ও সংগীতশিল্পী আকাশ চক্রবর্তীর ‘চিৎকার করো মেয়ে’ গানের মুখরা। এর বার্তা যে শুধু ‘মেয়ে’র মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়; বরং ‘সর্বজনীন’, তা বলা বাহুল্য।
প্রয়োজনে চিৎকার করতে জানাও গুণ। চর্চার ভেতর দিয়ে তা অর্জন করা শ্রেয়। এর মর্মার্থ সবাই অনুভব করবেন, আশা রাখি। ভালো থাকুন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top