skip to Main Content

যাপনচিত্র I শৈল্পিক সারল্যে

রাশেদ নোমান। দূরদর্শী ব্যবসায়ী নেতা, শিক্ষাবিদ ও সামাজিক উদ্যোক্তা। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক স্বাস্থ্য প্রযুক্তি কোম্পানি কমিউরের সহযোগী প্রতিষ্ঠান অগমেডিক্স বাংলাদেশের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও কান্ট্রি ম্যানেজার। কেমন তার একান্ত জীবন?

অগমেডিক্স বাংলাদেশকে দেশের অন্যতম সফল হেলথটেক উদ্যোগে রূপান্তর করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন রাশেদ নোমান। ২০১৭ সাল থেকে তার নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠানটি ৭০ জন থেকে ১ হাজার ৩০০ জনের টিমে পরিণত হয়। কারিগরি দক্ষতা, কৌশলগত দৃষ্টিভঙ্গি এবং জনপ্রিয় নেতৃত্বের দারুণ সমন্বয়ে সাজানো তার পেশাজীবন।
নিজেকে গড়ে তোলার পথে শিক্ষাজীবনে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজে ভর্তি হয়েছিলেন রাশেদ। সাত মাস সেখানে চিকিৎসাবিদ্যায় অধ্যয়ন করলেও অবশ্য মন বসাতে পারেননি। ছেড়ে এসে ভর্তি হন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বুয়েট)। সেখান থেকে সম্পন্ন করেন স্নাতক। এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব বিজনেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (আইবিএ) থেকে এমবিএ। তারপর সাউথ ক্যারোলিনা স্টেট ইউনিভার্সিটি ও নিউইয়র্ক ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি থেকে নিয়েছেন উচ্চতর পাঠ।
আন্তর্জাতিক করপোরেট ক্যারিয়ারে ১১ বছর বোয়িংয়ে কর্মরত ছিলেন রাশেদ নোমান। এ ছাড়া জেনারেল মোটরস এবং যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক অন্যান্য প্রযুক্তি সংস্থায়ও গুরুত্বপূর্ণ পদে কাজ করেছেন। করপোরেট নেতৃত্বের বাইরে তিনি উদ্যোক্তা এবং উদ্ভাবনের প্রতি গভীরভাবে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। সাইবারনেটিকস হাই-টেক সলিউশনের সহ-প্রতিষ্ঠাতা তিনি; বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর জন্য দেশের প্রথম ইওডি রোবট তৈরি করেছেন এবং তা কানাডিয়ান রোবটের তুলনায় ছয় ভাগের এক ভাগ খরচে। তার উদ্যোগগুলো হেলথটেক, ফিনটেক, বিপিও এবং শিল্প অটোমেশনকে বিস্তৃত করে।
রাশেদ শিক্ষা ও যুব ক্ষমতায়নের প্রতি সমানভাবে আগ্রহী। ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন অ্যাডজাঙ্কট ফ্যাকাল্টি হিসেবে ব্যবসায় ও প্রকৌশল—উভয় স্কুলেই শিক্ষকতা করেন। তিনি ডেটা অ্যানালিটিকস রোড শোতে নেতৃত্ব দিয়েছেন, দেশের ৩০টির বেশি বিশ্ববিদ্যালয় পরিদর্শন করেছেন এবং ডেটা অ্যানালিটিকস, এআই ও প্রযুক্তিতে ক্যারিয়ারের সুযোগ সম্পর্কে শিক্ষার্থীদের নির্দেশনা দিয়েছেন।
ব্যস্ত জীবনে তার অবসর মেলে শনিবার। এদিন এক ঘণ্টা বেশি ঘুমানোর সুযোগ পান। ব্যস্ত দিনে তার ঘুমানোর সময় রাত সাড়ে ৪টা থেকে সকাল সাড়ে ৮টা। ছুটির দিনে বাজার করাসহ বাসার টুকটাক কাজ করেন। এই করপোরেট ব্যক্তিত্বের আবাসস্থল রাজধানীর গুলশানে। কাছাকাছি এলাকাতেই থাকেন তার বাবা, ভাই ও ভাতিজারা। শুক্রবার নিয়ম করে বাবাকে ২-৩ ঘণ্টা সময় দেন। শনিবারও সময় পেলে সকাল কিংবা দুপুরে বাবাকে দেখতে যান। পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কাছের কফি শপে সময় কাটাতে ভালোবাসেন। বিকেলে বন্ধুমহলে, বিশেষত বুয়েট অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশনের বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দেন তিনি।
নিজের লাইফস্টাইলকে কিছুটা আনহেলদি মনে করেন রাশেদ নোমান। ছুটির দিনে রাত সাড়ে ১০টায় বাসায় ফিরে স্ত্রীর সঙ্গে সিনেমা দেখেন। কোনো কোনো দিন অবশ্য ঘনিষ্ঠজনদের নিয়ে তার বাসায় বসে গান ও আড্ডার আসর। জানালেন, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ে পরবর্তী সেমিস্টারে চারটার পরিবর্তে দুটি ক্লাস নেওয়ার পরিকল্পনা আছে তার; যেন নিজের সুস্থতায় ও শরীরের যত্নে পার্কে হাঁটা কিংবা ব্যায়াম করার মতো ওয়ার্কআউট করতে পারেন। রাশেদ বিশ্বাস করেন, পৃথিবীকে ভালো কিছু দিতে গেলে সুস্থ থাকার বিকল্প নেই।
কর্মব্যস্ত দিনে সকালে এক কাপ ব্ল্যাক কফি ও সেদ্ধ ডিম খেয়ে বাসা থেকে বেরিয়ে পড়েন। এ সময় কোনো কারণে স্ত্রীর সঙ্গে দেখা না হলে রোবোটিকস ল্যাবে যাওয়ার আগে বাসায় ফিরে এক কাপ চা পান করেন। সাধারণত ১২টা ২০ মিনিটে ক্লাস নেওয়া শেষ হয়ে যাওয়ার পর বেলা সাড়ে ৩টা পর্যন্ত রোবোটিকস ল্যাবে সময় দেন। এরপর বাসায় ফিরে সারেন মধ্যাহ্নভোজ। মেনুতে থাকে ভাত, মাছ, সবজি ও ডাল। মাংস খাওয়া কমিয়ে দিয়েছেন আগের তুলনায়। আধা ঘণ্টা বিশ্রাম নিয়ে বেরিয়ে পড়েন অগমেডিক্সের উদ্দেশে। মাঝরাতে বাসায় ফিরে কদাচিৎ স্ত্রীর সঙ্গে টিভি দেখেন অথবা গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়েন টিএসসি অথবা গুলশান ২-এ।
বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠদান শুরু করার আগে সকালের সময়টুকু নিয়মিত রবীন্দ্রসংগীত শোনার অভ্যাস ছিল তার। তারুণ্যে প্রেমে পড়েছিলেন জেমস, ওয়ারফেজ, কবীর সুমন ও স্করপিয়ন্সের। ‘একেকটা দিন মসৃণ/ ভোর থেকে শুরু করে রাতের শয্যায়/ একেকটা দিন উঁচু-নিচু…’ কবীর সুমনের এমন অনেক গানের পঙ্‌ক্তির সঙ্গে নিজের জীবনের সাদৃশ্য খুঁজে পান তিনি। কবীর সুমন ও জেমস তার বিশেষ পছন্দের।
রাশেদ নোমান কাজ করেন জেন-জিদের সঙ্গে। ফলে সাম্প্রতিক গান ও শিল্পীদের খোঁজখবর রাখেন। অ্যালেক বেঞ্জামিন, রেহমান ডুয়ো, মাশা ইসলাম, এনজেল নূর, মাহতিম শাকিবসহ অনেকের গানই তার মনে ধরেছে। গেল শতকের নব্বইয়ের দশকে বুয়েটে পড়া অবস্থায় বুয়েট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, আর্মি স্টেডিয়ামে অনেক কনসার্টে উপস্থিত ছিলেন। এখনো বুয়েটে কনসার্ট হলে উপস্থিত থাকার চেষ্টা করেন। যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসের সময় সামনে থেকে উপভোগ করেছেন কার্লোস স্যান্টানা, ঈগলস, ম্যাডোনা, গানস এন রোজেস, ইয়ানি, ওস্তাদ জাকির হোসেন, রাহাত ফতেহ আলী খানের কনসার্ট। পরে দেখবেন ভেবে ২০০০ সালে মাইকেল জ্যাকসনের কনসার্ট উপভোগের সুযোগ হাতছাড়া করেছিলেন, যা এখনো তার কাছে আক্ষেপ হয়ে আছে।
যুক্তরাষ্ট্রে থাকাকালে প্রতি দুই বছরে তিনবার দেশে আসতেন। চেষ্টা ছিল পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে ঢাকায় যত বেশি সময় পার করার। তবে ভ্রমণের কথা বলতে গিয়ে জানালেন, যুক্তরাষ্ট্রের ৩৫টির বেশি রাজ্যে ঘুরেছেন। ভ্রমণ করেছেন নেপাল, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, তুরস্ক, ফ্রান্স, সুইজারল্যান্ড, জার্মানি, সুইডেন ও ইংল্যান্ডে। এসব দেশের মধ্যে আলাদা করে বললেন সুইজারল্যান্ড ভ্রমণের কথা। সেখানে সাধারণত জনপ্রিয় কোনো ট্যুরিস্ট প্লেসে না গিয়ে, গিয়েছিলেন থুম শহরে। যে হোটেলে উঠেছিলেন, সেটি ছিল দ্বাদশ শতাব্দীর একটি দুর্গ। পরে তা অর্ধেক হোটেল ও অর্ধেক জাদুঘরে রূপান্তর করা হয়। জানালেন, কাজের সুবাদে ১১ বছর থেকেছেন ওয়াশিংটনের সিয়াটল শহরে। তার বয়ান অনুযায়ী, এটি ভ্যালির মতো জায়গা, যার এক পাশে ক্যাসকেড আর অন্য পাশে অলিম্পিক মাউন্টেইন। সিয়াটলের ভেতর দিয়ে যে হাইওয়ে, তা পৌঁছেছে কানাডার ভ্যানকুভারে। সকালে ধীরে ধীরে সূর্য ওঠা এবং পর্বত শিখরে সাদা বরফের ভেতরে সূর্যের প্রতিফলন দেখতে অনেক সময় গাড়ি থামিয়ে দাঁড়িয়ে পড়তেন। এ ছাড়া তিনি লেক ওয়াশিংটনের কথা বিশেষভাবে বললেন, যেটির দৈর্ঘ্য প্রায় ২৬ মাইল। এর এক পাশে সিয়াটল আর অন্য পাশে বেলভিউ। সেখানে পাহাড়ে পাঁচ মাইল দীর্ঘ টানেল দিয়ে শহরে বের হওয়ার ব্যাপারটি তার মনে অদ্ভুত অনুভূতি এনে দিত। প্রতিদিন সেই রাস্তায় আসা-যাওয়া করলেও কখনো একঘেয়েমি লাগেনি।
অবসর সময়ে রাশেদ নোমানের আরেকটি পছন্দের কাজ সিনেমা ও টিভি সিরিজ দেখা। ছোটবেলায় সেবা প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত ওয়েস্টার্ন, কিশোর ক্লাসিক, তিন গোয়েন্দা, মাসুদ রানা সিরিজের বই পড়তেন। তা থেকে বিভিন্ন ওয়েস্টার্ন ও গোয়েন্দা সিনেমার বিশেষ ভক্ত হয়ে পড়েন। পছন্দের সিনেমার তালিকায় আছে ‘দ্য গুড, দ্য ব্যাড অ্যান্ড দ্য আগলি’, ‘জেমস বন্ড’ সিরিজ, ‘আ ফিউ গুড মেন’, ‘দ্য শশাঙ্ক রিডেম্পশন’, ‘ফরেস্ট গাম্প’, ‘দ্য গডফাদার’ ট্রিলজি, ‘দ্য বোর্ন সুপ্রিমেসি’, ‘দ্য বোর্ন আলটিমেটাম’, ‘টেকেন’, ‘প্যাচ অ্যাডামস’, ‘আ বিউটিফুল মাইন্ড’, ‘ইনফার্নো’, ‘দ্য দা ভিঞ্চি কোড’, ‘দ্য টার্মিনাল’, ‘এরিন ব্রোকোভিচ’, ‘ডাই হার্ড’ সিরিজের প্রথম তিনটি, ‘ব্ল্যাক প্যান্থার’, ‘দ্য পারসুট অব হ্যাপিনেস’, ‘সেভেন পাউন্ডস’ প্রভৃতি। অভিনেতা ক্লিন্ট ইস্টউড, শন ক্যানরি, পিয়ার্স ব্রসনান, রবিন উইলিয়ামস, রাসেল ক্রো, লিওনার্দো ডিক্যাপ্রিও, টম হ্যাংকস, ব্রুস উইলিস, উইল স্মিথ, মরগান ফ্রিম্যান, আমির খান, অমিতাভ বচ্চন ও অজয় দেবগন এবং অভিনেত্রী জুলিয়া রবার্টস, মেগ রায়ান, ড্রিউ ব্যারমোর, সান্ড্রা বুলক ও ক্যাথরিন জিটা-জোন্সের অভিনয় বিশেষ ভালো লাগে। পছন্দের ফিল্মমেকার স্টিভেন স্পিলবার্গ। ‘ফরেস্ট গাম্প’ সিনেমার ‘লাইফ ইজ আ বক্স অব চকলেট, ইউ নেভার নো হোয়াট ইউ আর গোনা গেট’ এবং ‘দ্য গডফাদার পার্ট টু’র ‘কিপ ইয়োর ফ্রেন্ডস ক্লোজ অ্যান্ড ইয়োর এনিমি ক্লোজার’—সংলাপ দুটি তার বিশেষ পছন্দের। প্রিয় টিভি সিরিজ ‘ব্রেকিং ব্যাড’, ‘মানি হেইস্ট’ ও ‘হাউস অব কার্ডস’। শেষোক্ত সিরিজটি একটানা দেখার জন্য অফিস থেকে ছুটি পর্যন্ত নিয়েছিলেন!
রাশেদ নোমান জিনস ও টি-শার্টে বেশি স্বচ্ছন্দ। তার পছন্দের রং নীল, অলিভ ও সাদা। কোনো কিছুতে তিনি তেমন ব্র্যান্ড ফোকাসড নন। স্বাস্থ্য বিবেচনায় আরামদায়ক জুতাকে প্রাধান্য দেন। পছন্দের ব্র্যান্ড ইকো ও স্কেচার্স। স্মার্টফোন আসার আগে হাতঘড়ি পরতেন; তখন পছন্দের ব্র্যান্ড ছিল স্কেগেন। তবে গাড়ির প্রতি তার ব্যাপক টান। ছাত্রজীবনে নীলক্ষেত থেকে নানা রকম গাড়ির ম্যাগাজিন কিনতেন। সেই সূত্রে গাড়ি কোম্পানিতে কাজ করার আগ্রহ, যা জেনারেল মোটরসে কাজের মাধ্যমে পূরণ হয়েছে। সেখানকার সাড়ে ছয় বছরের কর্মজীবনের শেষ দুই বছর কাজ করেছেন ডিজাইন স্টুডিওতে, যেখানে প্রথমে একটি গাড়ির জন্য ২৭টি ডিজাইন করা হয়। সেখানে থেকে নয়, তিন হয়ে চূড়ান্ত ডিজাইন নির্বাচিত হয়। কয়েক বছর পর বাজারে কোন গাড়ি আসবে, তা সম্পর্কেও ধারণা ছিল তার। প্রথম গাড়ি কেনেন যুক্তরাষ্ট্রে, মায়ের দেওয়া টাকায়। মডেল ছিল ১৯৯০ মাজদা এমএক্স-৬। এরপর সেদান, ক্যামারো, শেভি কোবাল্ট, বিএমডব্লিউ, মার্সিডিজসহ অন্যান্য গাড়ি কিনেছেন।
তার বাসার ডিজাইনে কনটেম্পরারি ও ভিক্টোরিয়ান আবহ বেশি। শৈল্পিক উপায়ে সারল্যের ছোঁয়া। ঘরজুড়ে জীবনসঙ্গী রেবেকা নোমান নীলার আঁকা পেইন্টিং। জীবনদর্শন ঘিরে রাশেদ নোমানের প্রথম কথা হলো, লেস ইজ মোর। দ্বিতীয়ত, অন্যের মধ্যে বেঁচে থাকা। তিনি আরও বলেন, ‘কবরের এপিটাফে জন্ম ও মৃত্যু সালের মাঝখানে যে চিহ্ন থাকে, তা হচ্ছে মানুষের সত্যিকারের জীবন। মনে রাখা চাই, যে সমাজে ফল খাওয়ার উদ্দেশ্য ছাড়া মানুষ গাছ লাগায়, সেই সমাজে সভ্যতা গড়ে ওঠে।’

 ফুয়াদ রূহানী খান
ছবি: সাজ্জাদ হোসেন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top