তনুরাগ I ট্যান ট্রেন্ডিং
ফ্যাশন ফো পা থেকে ফ্লেক্স, ট্যানের টাইমলাইন এমনটাই! একসময় গণ্য করা হতো আর্থিক দীনতার প্রতীক হিসেবে। সেখান থেকে আজকের বিউটি স্টেটমেন্টের দুর্দান্ত যাত্রা
সূর্যের আলোতে মেলানিন বেড়ে ত্বক গাঢ় হয়ে ওঠে, এটিই প্রাকৃতিক ট্যান। যবে থেকে সূর্য আর দেহের দেখা হচ্ছে, তবে থেকে। ইতিহাসের পাতায় পাওয়া যায় ভিক্টোরিয়ান যুগের কথা। সে সময়ে ট্যানকে ধরা হতো কঠোর পরিশ্রমী লোকের চিহ্ন। যারা মূলত দিন কাটান আর্থিক টানাপোড়েনে। তাই পরিশ্রমের চূড়ান্ত করতে হয় প্রতিটা দিন। নিজের সুখ-শান্তি তো দূর, দেহও একমুহূর্ত স্বস্তি পায় না। রোদে পুড়ে রং বদলে যায়! সভ্য সমাজে পোশাকের আস্তরণে ঢেকে থাকার যে চল, তা এদের জন্য নয়। রোদে পোড়া ত্বক লুকোনোতেই সমাধান খুঁজে পেতেন তখনকার ট্যানধারীরা। ফ্যাশন হিসেবে গ্রহণ তো কোন দূর!
চিত্রপট বদলায় ১৯২০ সালে। একদম ৩৬০ ডিগ্রি উল্টো ঘুরে। সে কেমন? বিশ্রাম তখন ‘আ লাক্সারি থিং’! অর্থাৎ ধনীদের বিষয়। লাক্সারি ভ্যাকেশন তখন আকাঙ্ক্ষিত। দীর্ঘ সময় সমুদ্রতটে রৌদ্রস্নান অথবা ইয়টের ছাদে শুয়ে থেকে নীল জলরাশি উপভোগ—এভাবেই ছুটির মাহেন্দ্রক্ষণ কাটাতেন সচ্ছল ব্যক্তিরা। ফিরে আসতেন রোদে পোড়া ত্বক নিয়ে। যাতে স্পষ্ট হতো বিলাসের চিহ্ন! ঠিক এ সময়ে ট্যান জায়গা করে নিতে শুরু করে ট্রেন্ড টপ চার্টে। অভিনব কায়দায় দেহের চামড়ায় তৈরি করা হতো ট্যান। ত্বকে এই আলো-ছায়ার খেলা তৈরির আকাঙ্ক্ষায় অনেকে দীর্ঘ সময় কাটাতেন সূর্যের আলোতে। ইকারাসের মতো মোহমুগ্ধতা রবি করকে ঘিরে। উত্তাপের উদ্বাহু আহ্বানে।
এ সময়টায় অল্প কিছু ফ্রেকেলস আর একটি ট্যান লাইন যদি কারও দেহে দেখা যেত, তাহলে ধরে নেওয়া হতো, তিনি ধনী হওয়ার পথে হাঁটছেন। সুস্বাস্থ্য, সম্পদ আর বিলাসবহুল ছুটি কাটানোর চিহ্ন মনে করা হতো এটিকে। ট্যান ম্যাডনেস এতটাই জাঁকিয়ে বসেছিল, ১৯৬০ থেকে ৭০-এ ট্যান তৈরিতে এক কৌশলের আশ্রয় নেওয়ার চল শুরু হয়। আগ্রহীরা শুরু করেন রান্নার তেল আর ফয়েল কম্বল ব্যবহার। গায়ে তেল মেখে ফয়েল কম্বলে নিজেকে পেঁচিয়ে সানবাথ! কিন্তু সূর্যালোকের সরাসরি ব্যবহারে এহেন কারবারের মাঝেই খোঁজ পাওয়া যায় সূর্যের ক্ষতিকর রশ্মির বিষয়ে। জানা যায় এমন কৌশলে স্কিনে শুধু ট্যান নয়, ক্যানসারও শিকড় পুঁতে বসতে পারে।
১৯৫০ সাল অবধি ট্যানলাইন লুকানোর গল্প শোনা যায়। এয়ারব্রাশ ব্যবহার করে লুকিয়ে রাখার চল ছিল তখন। এরপরে ক্যালিফোর্নিয়া কুল ফিলোসফি সেন্টারস্টেজ দখল করে ষাটের দশকে। জীবনযাপনের এই দর্শনের ফলে অনেক রকমের পরিবর্তনের মুখোমুখি হয় সমাজ। তার মধ্যে ট্যানলাইন একটি। শ্রেণিবৈষম্যের বিপরীতে তারুণ্যের শক্ত অবস্থান হয় প্রকট। প্রভাব পড়ে ফ্যাশনেও। ট্যানকে শ্রমজীবী মানুষের কষ্টের প্রতীক হিসেবে লুকিয়ে নয়, বরং বরণ করার প্রত্যয়ে নেওয়া হয় পদক্ষেপ। ফ্যাশন-সচেতনেরা সেখানে আরও যোগ করেন যৌবন, স্বাধীনতা ও আবেদনময়তার দর্শন। চিরায়ত সাদা চামড়াকে প্রাধান্য না দিয়ে নিজের পছন্দমতো গাঢ় শেডে ত্বককে রাঙিয়ে তোলার রীতিনীতি সেখান থেকে ডানা মেলে। সে সময়ের ট্যান বিলাসের খানিকটা খোঁজ মেলে চিত্রগ্রাহক স্লিম অ্যারোনের বিখ্যাত পুল সাইড ফটোগ্রাফিতে। দেখা যায় লাক্সারিয়াস ভ্যাকেশন ভিলাতে ট্যানকে আপন করে নিয়ে ছুটি যাপনের চিত্র। অর্থাৎ ট্যান তখন থেকেই বিলাসব্যসন!
আবারও এত বছর পরে ট্যান এবার ট্রেন্ড ইন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম দিচ্ছে তার সাক্ষী। এখানে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে হালের জনপ্রিয় সোশ্যাল মিডিয়া অ্যাপ টিকটক। বিকিনি স্ট্র্যাপ, হার্ট শেপড স্টিকার, রাইনস্টোন আউটলাইনসহ বেশ কিছু নকশা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। ট্যান ট্রানজিশনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, এই ট্রেন্ড এতটাই মুগ্ধতা ছড়িয়েছে যে ইচ্ছা করে ত্বকে নকশা করে নেওয়া হচ্ছে। ট্যান এখন অতি আকাঙ্ক্ষিত। বেশ কয়েকটি উপায়ে ত্বকে বসানো যায় এই আলো-ছায়ার খেলা। তেমন কঠিন কিছু নয় ট্যানট্যালাইজিং।
সূর্যের সঙ্গে সন্ধি
সূর্যের আলোতেই যদি ট্যান তৈরির ইচ্ছা হয়, তাহলে রোদে থাকার সময় বাড়াতে হবে। এতে প্রাকৃতিক ও দীর্ঘস্থায়ী ট্যান তৈরি হবে। কিন্তু এখানে ঝুঁকি থেকে যায় সানবার্ন, স্কিন ড্যামেজ, প্রিম্যাচিউর স্কিন আর ক্যানসারের। তবু এতেই যদি পুরোটা শেষ করতে হয়, তাহলে যথেষ্ট সানস্ক্রিনে পাওয়া যেতে পারে সুরক্ষা।
স্প্রে ট্যান
কেমিক্যাল স্প্রে করে সম্পন্ন করা হয় এই ট্যান তৈরি। এর আরেক নাম এয়ারব্রাশ ট্যানিং। ডিএইচএ-বেসড ট্যানিং সল্যুশন ব্যবহার করা হয় ত্বকের ওপরের অংশে। শেড তৈরি করা যায় চাহিদামতো। ত্বকের জন্য ক্ষতিকর নয়। তবে টিকে থাকে ৫ থেকে ৭ দিন। আবার কাপড়ে লাগলে দাগও তৈরি হতে পারে। রানওয়ে মডেল এবং ফটোশুটে বেশ দেখা যায়।
ব্রোঞ্জিং মেকআপ ও বডি শিমার
পাউডার, ক্রিম আর বডি অয়েল ব্যবহারে ব্রোঞ্জড গ্লো তৈরি করা যেতে পারে। এতে খুব অল্প সময়ের মধ্যে ট্যান পাওয়া যায়। আবার তুলে ফেলাও সম্ভব মুহূর্তে। ছবি তোলার জন্য বেশ কাজের। তবে ঘামের কারণে নষ্ট হওয়ার ঝুঁকি বেশ উচ্চ। পোশাকেও দাগ বসতে পারে অসাবধানে। তাই ব্যবহারের পরে থাকা চাই সচেতন।
ট্যানের গ্লামারাস গ্লো মাতিয়েছে বিউটি ইন্ডাস্ট্রি। পশ্চিমা বিশ্বে ট্যানকে আউটডোর লাইফস্টাইলের প্রতীক হিসেবে দেখা হয়। অন্যদিকে দক্ষিণ এশিয়ায় ফরসা ত্বকের প্রতি আকর্ষণে প্রাধান্য থাকলেও ফ্যাশন ও বিউটির জগতে ধীরে ধীরে ট্যান ত্বকও জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। অসূর্যম্পশ্যা থেকে রবি কিরণের উদ্ভাসের আহ্বানে।
সারাহ্ দীনা
মডেল: নাভিলা
মেকওভার: পারসোনা
ছবি: কৌশিক ইকবাল
