skip to Main Content

ছুটিরঘণ্টা I মস্কোর আনন্দ উদ্যানে

ভাস্কর্য, জাদুঘর, ফোয়ারা, ফুলবাগান আর দৃশ্যত রাজপ্রাসাদের সমাহারে প্রাকৃতিক ও মনুষ্যসৃষ্ট শিল্পসম্ভারের এ যেন এক ঐশ্বরিক প্রদর্শনী। রাশিয়ার রাজধানীর একটি উদ্যান ঘুরে এসে লিখেছেন ফাতিমা জাহান

ভোর পাঁচটার দিকে ঘুম ভেঙে গেল। বাইরে একটু একটু করে আলো ছড়াচ্ছে। কিন্তু আমি তো পর্দা ব্ল্যাকআউট ব্লাইন্ড করেছিলাম। আলো কীভাবে আসছে? আসলে পর্দা ঠিকমতো টানা হয়নি; তাই মোটা পর্দা ভেদ করে আলো আসছে। ঘুম যখন ভেঙেই গেল, আর শুয়ে থেকে কাজ নেই। উঠে হাতমুখ ধুয়ে ডাইনিংয়ে চলে গেলাম নাশতা করতে।
ডাইনিংয়ে সবে নাশতা সাজানো হচ্ছে। আমি এত ভোরে উঠি; মাঝে মাঝে হোটেলের স্টাফরাই তখনো জাগেন না। একবার ইথিওপিয়ার আদ্দিস আবাবায় সবাইকে উঠিয়ে নাশতা রেডি করিয়েছিলাম। এখানে তা করার প্রয়োজন নেই। এরা এমনিতেই অতিরিক্ত নম্র-ভদ্র জাতি। আর সময়-জ্ঞান টনটনে। এটাও এরা খেয়াল রাখেন, অন্যের যেন অসুবিধা না হয়। না হলে গতকাল মোবাইল নেটওয়ার্ক ছাড়া, ভাষা না জেনে দিব্যি শহর ঘুরে এলাম! আজও তা-ই করব বলেই মনে হচ্ছে।
রিসেপশন থেকে কোথায় কীভাবে যাব, তার ডিরেকশন জেনে নিয়ে পথে পা বাড়ালাম। হোটেলের পাশেই একটি শর্মার দোকান। বোধ হয় মুসলিম দোকান। এক ছেলে উজবেক টুপির মতো একটি টুপি পরে আছে। কয়েকজন খরিদ্দার দেখি দোকানের সামনে। এদের উজবেবিস্তান বা তাজিকিস্তানের বলে মনে হচ্ছে। এখনই দোকান খুলে দিয়েছে, বেশ কর্মঠ জাতি তো!
আমি আজ যাব অল রাশিয়ান এক্সিবিশন সেন্টারে। রুশ ভাষায় বলা হয় ভেদেনখা। মস্কোয় এই এক্সিবিশন সেন্টার নির্মাণ করা হয়েছিল ১৯৩৫ সালে। আয়তন এতই বড় যে এটি ইউরোপের সবচেয়ে বড় এক্সিবিশন সেন্টার হিসেবে পরিচিত।
মেট্রো স্টেশন আমি চিনে ফেলেছি। এক দিনের মধ্যেই চলাফেরাও সহজ হয়ে গেছে। আর মেট্রো স্টেশনে সব যে রুশ ভাষায় লেখা তা নয়; রাশিয়ানের নিচে ইংরেজিতেও স্টেশনের নাম লেখা এবং স্টেশন থেকে বেরিয়ে কোন ডিরেকশনে গেলে বা কোন গেট দিয়ে বের হলে কোথায় যাওয়া যাবে, তা-ও লেখা আছে। গতকাল নতুন দেশ, নতুন ভাষা বলে এসব চট করে চোখে পড়েনি।
মেট্রো থেকে নামার আগে এক দম্পতিকে স্টেশনের কথা জিজ্ঞেস করতেই জবাব পেলাম, তারাও ভেদেনখাতে যাবেন। আমাকে সঙ্গে নিয়ে যাবেন। আমি ইংরেজিতে জিজ্ঞেস করছিলাম আর তারা রুশ ভাষায় জবাব দিচ্ছিলেন। কথোপকথনে কিছুমাত্র অসুবিধা হয়নি। মেট্রো থেকে নেমে দেখি, সামনে বিশাল জায়গাজুড়ে এক উদ্যান। আমরা রাস্তা পার হয়ে সেই উদ্যানে গেলাম। উদ্যানটির নাম মেমোরিয়াল মিউজিয়াম অব কসমোনটিকস। উদ্যানে বিভিন্ন সময়ে মহাকাশ গবেষণায় নিযুক্ত ব্যক্তিদের আবক্ষ ভাস্কর্য পাশাপাশি রাখা। আর উদ্যানের মাঝখানে একটি উঁচু সুচালো মেমোরিয়াল বা স্তম্ভ। এ প্রাঙ্গণের প্রথমেই সায়েন্স মিউজিয়ামের মতো গোল গোল মলিকিউলের ভাস্কর্য করে রাখা। সেটাও অনেকটা জায়গাজুড়ে। এর দুপাশে সারি সারি রাশিয়ান বিশিষ্ট ব্যক্তিদের আবক্ষ ভাস্কর্য। এই মুহূর্তে আশপাশে কেউ নেই বলে জানতে পারলাম না, কার ভাস্কর্য কোনটি। কারণ, সবার নাম রুশ ভাষায় লেখা। উদ্যানের মাঝখানে ফুলের বাগানের লম্বা লম্বা কেয়ারি করা। জায়গাটি দেখতে অনেকটাই আলমাতি প্রেসিডেন্ট পার্কের মতো। একসময় কাজাখস্তান তো সোভিয়েত ইউনিয়নের অংশই ছিল।
সামনের উঁচু সরু পালের মতো সুচালো স্তম্ভের দিকে যেতে হলে সিঁড়ি দিয়ে উঠতে হবে। এই স্তম্ভের নাম মনুমেন্ট টু দ্য কনকারার অব স্পেস। মানে মহাকাশজয়ী সব বীরের সম্মানার্থে এই মনুমেন্ট করা হয়েছে। এর মধ্যেই রোদ চড়ে গেছে। আমি সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠে দেখি, স্তম্ভের নিচে হরাইজন্টালি লম্বালম্বিভাবে একটি ভাস্কর্য করা, আর তাতে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সৈনিকদের যুদ্ধের দৃশ্য খোদাই করে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। আমি সিঁড়ি দিয়ে নিচে নেমে অন্য পাশে হাঁটতে থাকি। এই মুহূর্তে স্পেস মিউজিয়ামে যাব না। ফেরার পথে যাব। উদ্যানটি এত বড়, না জানি ভেদেনখা কত বড় হবে!
ভেদেনখা যেতে হলে রাস্তা পার হতে হবে। আমি মহাকাশ মিউজিয়ামের সামনে একজনকে জিজ্ঞেস করতেই দেখিয়ে দিলেন। এ দেশে যখন-তখন, যেখান-সেখান দিয়ে রাস্তা পার হওয়া যায় না। শুধু জেব্রা ক্রসিং দিয়েই পার হতে হয়। জেব্রা ক্রসিং আরেকটু সামনে। সেদিকে আরেক মিষ্টি দম্পতির সঙ্গে দেখা। তারাও ভেদেনখা যাচ্ছেন। আমাকে বললেন তাদের সঙ্গে হাঁটতে।
রাস্তা পার হতেই ট্রামলাইন। সেটি ধরে অত্যাধুনিক ট্রাম আসছে। ট্রাম দেখলেই আমি নস্টালজিক হয়ে যাই। কলকাতার পরে সান ফ্রান্সিসকোর ট্রাম আমাকে বিহ্বল করেছে। দুই শহরের ট্রামই বেশ পুরোনো। এই অত্যাধুনিক ট্রামও কম শিহরণ দেয়নি মনে। ট্রাম দেখতে দেখতে ট্রামের তলায় যেন না পড়ে যাই, সে জন্য আমার সঙ্গের দম্পতি আমাকে ধরে সরিয়ে দিল। ওদেরকে বলতে ইচ্ছে করছিল, ‘জানো, আমাদের এক বাঙালি কবি ট্রামের নিচে পড়ে মৃত্যুবরণ করেছিলেন। বড্ড বেখেয়ালি কবি ছিলেন; আর ছিলেন জীবদ্দশায় অবহেলিত। আমি নিজেও একবার বেখেয়ালে সেই কলকাতায়ই লোকাল ট্রেনের নিচে পড়তে পড়তে বেঁচে ফিরেছি। আমারই কি খেয়াল থাকে সব সময়!’ থাক, নাই-বা বলি ওদের। এত কথা বলব কোন ভাষায়? তার চেয়ে পথের ভাষা চিনে নেওয়া শ্রেয়।
ট্রাম চলে যেতেই আমরা রাস্তা পার হয়ে এপাশে চলে এলাম। এসে দেখি সেই বিখ্যাত ভাস্কর্য—ওয়ার্কার অ্যান্ড কোলখোজ উইমেন। দুজন নারী ও পুরুষ পাশাপাশি দাঁড়িয়ে আছে; উঁচু করে তুলে ধরা হাতে কাস্তে ও হাতুড়ি। ভাস্কর্যটি একটি বেদির ওপর রাখা, যা বেশ উঁচুতে। খানিকটা দেখে আমি হেঁটে হেঁটে ভেদেনখার মূল তোরণের সামনে এসে পড়লাম। বিশাল এক সাদা রঙের তোরণ, দেখতে একদম রাজপ্রাসাদের মতো। সামনে আর পেছনে ছয়খানা করে মোট বারোখানা স্তম্ভের ওপরে তোরণ দাঁড়িয়ে। তোরণের স্তম্ভগুলোতে খোদাই করা কারুকাজ। আর তোরণের মাথায় একটি সোনালি রঙের ভাস্কর্য শোভা পাচ্ছে, যেখানে একজন নারী ও একজন পুরুষ হাত তুলে মাথার ওপরে এক গোছা শস্য তুলে ধরেছে। অর্থনীতিতে নারী ও পুরুষের মিলিত অবদানের সবচেয়ে বড় উদাহরণ এটি। এই উদাহরণ রাশিয়া ছাড়া আর কোথায় দেখা যাবে!
তোরণ পেরিয়ে সামনে এখন চিরবসন্ত খেলা করছে। মাঝখানে লম্বা বাগান, যার মাঝে কিছুদূর পরপর পানির ফোয়ারা বসানো। ফোয়ারাগুলোর মাঝে রঙিন বাগানে ফুল ফুটে আছে। এর দুপাশে পায়ে চলার চওড়া পথ। এই বাগান আর পথ গিয়ে মিলেছে রাজপ্রাসাদের মতো একটি ভবনে। আমি এসেছি প্রদর্শনী করার জায়গা দেখতে; কিন্তু মস্কো শহর আমাকে কিছুক্ষণ পরপর এসবের নাম করে রাজপ্রাসাদ দেখাচ্ছে!
লম্বা পথ হেঁটে সাদা রঙের রাজপ্রাসাদের মতো ভবনের সামনে দাঁড়াই। দোতলা এই ভবন খানিক বক্রাকার। আর মাথায় লম্বা চূড়া। চূড়ায় একটি সোনালি তারা। নিচতলা আর দোতলার বারান্দায় কোরেন্থিয়ান কলাম বা স্তম্ভ। একটি দুই লেয়ার চারকোনা কেকের মতো দোতলা ভবনটি দেখতে। মাথায় হরাইজন্টালি সোনালি কারুকাজ। মাঝের বৃত্তে কাস্তে, হাতুড়ি খোদাই করা। সোনালি রংটি এত ঝকমকে যে, স্বর্ণ দিয়ে তৈরি বলে ভ্রম হয়। ভবনের ওপরের চার কোনায় চার জোড়া নারী ও পুরুষের ভাস্কর্য। ভবনের সামনে মহামতি লেনিনের বিশাল লাইফ সাইজ ভাস্কর্য। তবে এই ভবন এখন বন্ধ। কোনো প্রদর্শনী চললে তখন খোলা হয়। ভবনটির নাম সেন্ট্রাল প্যাভিলিয়ন।
এই ভবনের সামনেও সুন্দর একটি বাগান আছে। অনেক দর্শনার্থী ইতিমধ্যে এসে গেছেন। আজ রোববার, ভিড় একটু বেশিই মনে হচ্ছে। অনেকে সেন্ট্রাল প্যাভিলিয়নের সামনে ছবি তুলছেন। আমি এর পাশের পথ ধরে এগোলাম। মূল তোরণ থেকে পায়ে চলা পথ; ভেতরে গাড়ি বা বাস প্রবেশ নিষেধ। সেন্ট্রাল প্যাভিলিয়নের দেয়ালে নানা কারুকাজ খোদাই করা। দূর থেকে দেখতে মাঝারি আকারের মনে হলেও ভবনটি আসলে বেশ বড়।
সেন্ট্রাল প্যাভিলিয়ন পার হয়েছি মাত্র; সামনে গোলাপি রঙের হাইড্রেঞ্জা ফুলে ভরে আছে চত্বর। মাঝখানে একটি পানির গোল ফোয়ারা; সেটিকে ঘিরে হাইড্রেঞ্জা ফুলের গোল বাগান। হাইড্রেঞ্জার বাগানের পর খানিকটা জায়গা ছেড়ে গোলাপবাগান। এরপর সেন্ট্রাল প্যাভিলিয়নের মতো আভিজাত্যপূর্ণ কয়েকটি ভবন গোল হয়ে ঘিরে রেখেছে ফুলবাগানকে। মাঝের ফোয়ারা যেন স্বর্গ থেকে উঠে আসা এক জলাধার। কোনটা ছেড়ে কোনটা দেখি!
সিঁড়ি দিয়ে নেমে হাইড্রেঞ্জা বাগান পার হয়ে আরও এক ধাপ নিচে নেমে গোলাপবাগানে গেলাম। চত্বরজুড়ে গোলাপের মিষ্টি সুবাস। আমি বাগানের সামনে পাতা একটি বেঞ্চে বসলাম। এখান থেকে সামনের ফোয়ারা দেখা যাচ্ছে। আজ ছুটির দিন বলেই বোধ হয় অসংখ্য মানুষের সমাগম হয়েছে। বেশির ভাগই পরিবার নিয়ে এসেছেন; কেউ কেউ বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে।
পানির ফোয়ারার ভেতরে রাশিয়ান পোশাক পরিহিত কয়েকজন রাজকুমারির সোনালি রঙের ভাস্কর্য শোভা পাচ্ছে। একেকজনের পোশাকের ধরন আলাদা; রাশিয়ার বিভিন্ন স্থানের ঐতিহ্যবাহী পোশাক পরেছে একেকজন। প্রত্যেকের পোশাক পা অবধি ঢাকা। প্রত্যেকের চুলের বিনুনির স্টাইল আলাদা। কারও দুই বেণি, কারও এক বেণি, কারওবা বেণি ঘুরিয়ে কপালের ওপর দিয়ে মাথায় গোল করে বাঁধা, কারও চুলে অনেকগুলো বেণি বাঁধা। এদের সবার হাতে আলাদা ধরনের ফুল। পায়ের কাছে সেই একই ফুলের গুচ্ছ পড়ে রয়েছে। হাতে ফুল ধরার স্টাইল আলাদা। কারও এক হাত ওপরে তোলা, কারও মুখ বরারব, কারওবা হাত বুকের কাছে। হাতের স্টাইলের এই নান্দনিকতার জন্য এই ভাস্কর্য শিল্পীকে ধন্যবাদ দিতেই হয়। এই ঐশ্বরিক দৃশ্যের মাঝে ফোয়ারার উৎস, মানে নিচের জলাধার ভেদ করে বহু ধারায় রাশি রাশি জলরাশি ছড়িয়ে পড়ছে এদের মাঝে। খুব কাছে গেলে জল ছলকে আমাদের গায়ে এসে পড়ছে।
রোদ চড়ে গেলেও বেশ ঠান্ডা বাতাস বইছে। আমি আরেকটু এগিয়ে হাইড্রেঞ্জা ফুলের বাগান পার হয়ে ফোয়ারার কাছে থামলাম। ইতিমধ্যে প্রচুর দেশি ট্যুরিস্ট ভিড় করেছেন। এখন অবধি আমি ছাড়া কোনো বিদেশি ট্যুরিস্টের দেখা পাইনি। খবরে পড়েছি, ইউক্রেন সংঘাতের পর রাশিয়ানদের ইউরোপ ও অন্যান্য দেশ ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞা জারি হয়েছে। আর ইউরোপীয় ট্যুরিস্টদেরও ম্যালা ঝক্কিতে পড়তে হয় রাশিয়ায় আসতে। অথচ একসময় এ দেশ ছিল ইউরোপীয়দের সবচেয়ে প্রিয় ট্যুরিস্ট ডেস্টিনেশন।
আমার সামনে মা-খালাদের বয়সী চার নারী বিভিন্ন ভঙ্গিতে ছবি তুলছেন। একজন আরেকজনের ছবি তুলে দিচ্ছেন। আমাকেও বললেন তাদের ছবি তুলে দিতে। ছবি তোলার পর তারা আমাকে বললেন ফোয়ারার অনুচ্চ দেয়ালে দাঁড়াতে, আমার ছবি তুলে দেবেন। আমি ভদ্র বাচ্চার মতো দাঁড়ালাম; কিন্তু আমার ছবির পোজ তাদের পছন্দ হলো না! একজন আমার হাত শূন্যে উঠিয়ে, এক পা ধরে খানিক ওপরে তুলে দিয়ে, এক পায়ে দাঁড় করিয়ে দিলেন। তারপর এক পায়ে দাঁড়ানো, হাত ছড়ানো বকের মতো পোজে ছবি তুলে দিলেন। ছবি এবার তাদের পছন্দ হলো; কিন্তু এই ছবি যার, সেই মেয়ে তো আমি নই! দেখে মনে হলো, এক পায়ে ব্যালেন্স করতে না পেরে আমি ফোয়ারার জলাধারে পড়ে যাচ্ছি। আর শঙ্কায় আমার চেহারা ফ্যাকাশে হয়ে যাচ্ছে। এই নারীরা আমাকে জোকার বানিয়েই ছাড়বেন! এদের হাত থেকে ছাড়া পেয়ে দ্রুত পালালাম।
আরেক পাশে এসে হাইড্রেঞ্জা ফুলের গালিচা আর তার ওপর বসে থাকা মৌমাছি দেখে মনে হলো, এই ফুলসজ্জা, এই ফোয়ারা, এই কানন যেন স্বর্গ থেকে তুলে আনা কোনো উদ্যান। এই উদ্যান আসলে এক আনন্দ উদ্যান। কে বলে এখানে কালেভদ্রে বাণিজ্য মেলাজাতীয় কিছু হয়! বাগানের চারদিক ঘিরে অনেকখানি দূরে দূরে আলাদা প্যাভিলিয়ন। নির্মাণের সময়, মানে ১৯৩৫ সালে আলাদা দেশের জন্য আলাদা প্যাভিলিয়ন বা ভবন তৈরি করা ছিল। যেমন কিরগিজস্তান, বেলারুশ, উজবেকিস্তান, কারেলিয়া, ইউক্রেন, ককেশাস, তুর্কমেনিস্তান, আরমেনিয়া ইত্যাদি। এখন নতুনভাবে এগুলোর নামকরণ করা হয়েছে—কৃষি প্যাভিলিয়ন, অ্যাটোমিক অ্যানার্জি প্যাভিলিয়ন, কসমোনটিক প্যাভিলিয়ন ইত্যাদি।
আমি জলের এই ছড়িয়ে পড়া আনন্দ উদ্যান থেকে একটু সরে মহাকাশবিষয়ক প্যাভিলিয়নের দিকে এগোলাম। সে ভবনের বারান্দায় একটি ছাউনি আছে, আর বসার জন্য চেয়ার। বারান্দাটি কোরিন্থিয়ান কলামে সুসজ্জিত। কলামের ওপরের দিকে কারুকাজ করা। এখান থেকে সামনের উদ্যান, ফোয়ারা—সবই দেখা যায়। আমার আশপাশে কয়েকজন নারী-পুরুষ বসে আছেন। আধুনিক পোশাকে সুসজ্জিত। তারা প্রচুর মেকআপ করেন না। আমি এখন অবধি দু-একজন বয়স্ক নারী ছাড়া আর কারও ঠোঁটে লিপস্টিক দেখিনি। তবে এরা নিজের পরিচ্ছন্নতা ও শরীরের প্রতি যত্নশীল। হাত-পায়ে সযত্নে নেইল পেইন্ট করা। তাদের হাত-পা মোটেই খসখসে বা রুক্ষ নয়। আমাদের দেশের সাধারণ নারীদের মতো আঙুলের কোনায় ফাটা বা কাটাকুটির দাগ নেই; নখের ভেতরে নেই হলুদের রং। এরা আমাদের মতো টেবিলে চৌদ্দ পদের খাবার সাজিয়ে খান না। তার ওপর রান্নায় হলুদের ব্যবহার করেন না। আরও বড় বিষয়, রান্না বা খাওয়ার সময় সরাসরি হাত ব্যবহার করেন না; সবকিছু চামচ দিয়ে করেন কিংবা গ্লাভস পরে নেন। তাদের জুতা ভীষণ রুচিসম্মত। প্রায় সবাই সাদা রঙের স্নিকার বা জুতা পরে আছেন। অল্প কয়েকজন মেয়ের পায়ে সাদা স্যান্ডেল। সবার জুতা চকচকে পরিষ্কার; সাদা জুতায় কোনো ময়লা নেই। মনে হচ্ছে নতুন কিনেছেন। পথঘাট এত পরিষ্কার যে, জুতা ময়লা হওয়ার প্রশ্নই আসে না। তা ছাড়া এরা জুতার যত্ন নেন বোধ হয়। প্রত্যেকেই বেশ রুচিসম্মত পোশাক পরে আছেন। এখন গ্রীষ্মকাল; তাই বেশির ভাগই পরে আছেন শর্টস বা মিনি সামার ড্রেস। এখনো কাউকে উৎকট বা শকিং কালার পরতে দেখিনি। কাউকেই প্রিন্টের জামা বা শার্ট পরতে দেখিনি। সবাই কালো, সাদা বা এর কাছাকাছি রঙের পোশাক পরে আছেন।
আমি যেখানে বসে আছি, তা আসলে স্পেস মিউজিয়াম। মিউজিয়ামে ঢোকার পথও এদিক দিয়ে। যারা মিউজিয়ামে যাচ্ছে, তাদের বেশির ভাগ স্কুলের বাচ্চা। তারা মা-বাবার সঙ্গে এসেছে। কেউ কেউ একাই মিউজিয়ামে যাচ্ছে; মা-বাবা বাইরে অপেক্ষা করছেন। বেশি ছোট বাচ্চারা মা-বাবার সঙ্গেই যাচ্ছে।
এই উদ্যানের বাকি রাজপ্রাসাদের মতো ভবনগুলোও প্রায় সময় বন্ধ থাকে। মানুষ আসে এখানে ঘুরেফিরে পিকনিক করে চলে যাওয়ার জন্য। পিকনিকের জন্য আদর্শ এই উদ্যান। পাশেই আছে ফেরিস হুইল। লন্ডন আইয়ের মতো বড় একটি ইলেকট্রিক চরকি, যা আকাশে নিয়ে গিয়ে, ঘুরিয়ে আনছে। তবে এই চরকি আকারে লন্ডন আইয়ের চেয়ে বড়। ইউরোপের সবচেয়ে বড় ফেরিস হুইল এটি; আর সামনে সেই রাজকন্যাদের ফোয়ারা। এই উদ্যান দেখলে মনে হয় মস্কো দেখা সার্থক।

ছবি: লেখক

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top