মনোযতন I বডি ইমেজ প্রেশার
নিজের শরীর নিয়ে চাপ, তুলনা আর অস্বস্তি। বিয়ের সময় এমন চাপ যেন আরও বেড়ে যায়। তা শুধু বাহ্যিক নয়; আত্মসম্মানবোধও ধীরে ধীরে ক্ষয় করে দেয়। আমরা যতই অন্যের চোখে নিখুঁত হওয়ার চেষ্টা করি, ততই দূরে সরে যাই প্রকৃত সত্তা থেকে। বিশদ বাতলেছেন সুবর্ণা মেহজাবীন
‘আয়নায় তাকালে কি আমি যথেষ্ট সুন্দর?’ ‘গালটা একটু বেশি ফোলা?’, ‘ত্বকটা ফরসা হলে কেমন হতো?’—এমন সব প্রশ্নের মধ্যে লুকিয়ে আছে বডি ইমেজ প্রেশার। এটি শুধু শরীরের কোনো একদিক নিয়ে অস্বস্তি নয়; বরং আমাদের অনুভূতি, ধারণা আর আত্মমূল্যায়নের এক জটিল মিশ্রণ। মনোবিজ্ঞানের ভাষায়, বডি ইমেজ মানে শরীরকে কীভাবে দেখেন এবং কেমন অনুভব করেন।
কেউ কেউ নিজের শরীর নিয়ে স্বস্তিতে থাকেন, কেউবা বদলাতে চান। আর এই ইচ্ছাটাই অনেক সময় আসে বাইরের চাপ থেকে। যখন সমাজ, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম কিংবা আশপাশের মানুষ বলে দেয়—কোনটা সুন্দর আর কোনটা অগ্রহণযোগ্য, তখনই তৈরি হয় সেই অদৃশ্য চাপ, যা ধীরে ধীরে মানসিক ভারে রূপ নেয়। গবেষণায় দেখা গেছে, নিয়মিত সৌন্দর্যসংক্রান্ত কনটেন্ট দেখা মানুষদের মধ্যে শরীর নিয়ে অস্বস্তি, আত্মবিশ্বাসের ঘাটতি ও হতাশা তুলনামূলক বেশি। এককথায়, শরীর নিয়ে অসন্তুষ্টি আজ অনেকের কাছে নীরব উদ্বেগের কারণ।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান প্রফেসর ড. এ. কে. এম. রেজাউল করিম এই প্রসঙ্গে বলেন, ‘বডি ইমেজ প্রেশার কোনো বাহ্যিক সৌন্দর্যের ব্যাপার নয়; এটা আত্মসম্মানের। নিজেকে কীভাবে দেখছেন, সেটিই ঠিক করে দেয় আপনি কতটা সুখী।’
আত্মবিশ্বাস থেকে উদ্বেগ
শরীর নিয়ে অসন্তুষ্টি একসময় মনে বাসা বাঁধে এক অদৃশ্য উদ্বেগে। প্রতিদিন আয়নায় তাকিয়ে তুলনা চলে—কে কতটা চিকন, কার ত্বক কত উজ্জ্বল, কার হাসি কত নিখুঁত। সেই তুলনার মধ্যে ধীরে ধীরে গড়ে ওঠে আত্ম-অবমূল্যায়ন। কেউ কেউ ভাবেন, ‘আমি যথেষ্ট ভালো নই;’ কেউ আবার শরীর বদলাতে গিয়ে হারিয়ে ফেলেন নিজের প্রতি ভালোবাসাটাও। স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠান লাইফস্প্রিংয়ের মনোরোগ বিশেষজ্ঞ সাঈদুল আশরাফ কুশল বলেন, নিজের সৌন্দর্য বা চেহারা নিয়ে তুলনা করা কিংবা খুঁতখুঁতে স্বভাব থেকে শুরু হয় বডি ইমেজ প্রেশার। অন্যের সঙ্গে নিজেকে তুলনা করা বা তুলনামূলক চিন্তাই আত্মবিশ্বাসের ক্ষয় ঘটায়, যা ধীরে ধীরে জটিল এক মনোরোগে রূপ নিতে পারে।
যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক মেন্টাল হেলথ ফাউন্ডেশনের এক জরিপে দেখা যায়, শরীর নিয়ে নেতিবাচক ধারণা থাকা প্রতি তিনজনের একজন নিজের চেহারার কারণে সামাজিক অনুষ্ঠানে যেতে সংকোচ বোধ করেন। সোশ্যাল মিডিয়া এই চাপে আরও আগুন ঢালে—ফিল্টার, নিখুঁত ত্বক আর সম্পাদিত শরীরের ছবিগুলো বাস্তবতা ও কল্পনার সীমা ঘোলাটে করে দেয়। বাংলাদেশেও এই প্রবণতা আলাদা নয়। ইনস্টাগ্রাম বা ফেসবুকের ছবির নিচে প্রশংসা কিংবা তুলনার মন্তব্য আমাদের মনে ‘কেমন দেখাচ্ছে’—এই চিন্তাকে আরও গভীর করে। নারী যেমন চেহারা বা ওজন নিয়ে চাপ অনুভব করেন; পুরুষও উচ্চতা, চুল বা শরীরের গঠন নিয়ে সমানভাবে আত্মসন্দেহে ভোগেন। মনোরোগ বিশেষজ্ঞ তৌহিদা ফেরদৌসী এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘নিজেকে নিয়ে যত বেশি তুলনা করা হয়, মনের শান্তি ততটাই কমে যায়। আত্মবিশ্বাস আসলে শুরু হয় নিজের অপূর্ণতাকে মেনে নেওয়ার মধ্য দিয়ে।’
মনস্তাত্ত্বিক চাপ
বিয়ের আগে নিখুঁত শরীর, নিখুঁত চেহারা কিংবা ফোটোজেনিক হাসির প্রত্যাশা—এমন অবিরাম চাপ মানসিকভাবে কী প্রভাব ফেলে, তা অনেক সময় অজানাই থেকে যায়। মনোবিজ্ঞানীরা বলছেন, নিজের চেহারা বা শরীর নিয়ে অতিরিক্ত অস্বস্তি ও তুলনার প্রবণতা ধীরে ধীরে আত্মবিশ্বাস ক্ষয় করে। শুরু হয় উদ্বেগ, আত্মমর্যাদাহীনতা; এমনকি বডি ডিসমরফিক ডিসঅর্ডারের মতো মানসিক সমস্যার ঝুঁকিও তৈরি হয়, যেখানে কেউ নিজের চেহারার ছোটখাটো ত্রুটিকেও বড় বিকৃতি ভাবেন।
বিয়ের প্রস্তুতির সময় এই চাপ আরও বাড়ে। আত্মীয়স্বজনের মন্তব্য, বিয়ের ফটোশুটের প্রস্তুতি, সামাজিক তুলনা—সব মিলিয়ে মানসিক স্বাস্থ্য ধীরে ধীরে পিছিয়ে পড়ে সাজসজ্জার আড়ালে। অথচ এটি হওয়া উচিত নিজের প্রতি সহানুভূতি ও মানসিক দৃঢ়তা গড়ে তোলার সময়। তৌহিদা ফেরদৌসী বলেন, ‘নিজের চেহারা নিয়ে অতি সচেতনতা মানুষকে সম্পর্ক থেকে দূরে সরিয়ে দেয়; কারণ, তিনি তখন নিজের ভেতরের মূল্যবোধ ভুলে যান।’ বিয়ের আগে তাই মানসিক প্রস্তুতি ও আত্মবিশ্বাস ফিরে পাওয়া—দুদিকেই নজর দেওয়া শ্রেয়।
সমাজের নীরব নির্দেশ
বিয়ের তারিখ ঠিক হলেই শুরু হয় এক অদৃশ্য দৌড়। সাজপোশাকের তালিকা, ফটোশুটের প্রস্তুতি। তারও আগে যেন একটাই কাজ, নিজেকে ঠিক করে নেওয়া! এই ‘ঠিক করা’ মানে কিন্তু মন নয়; শরীর। তখন আশপাশের মানুষ, আত্মীয়-বন্ধু, এমনকি নিজেরাও বলতে শুরু করি, ‘ওজনটা কমাতে হবে, না হলে ছবিতে ভালো লাগবে না’, ‘গায়ের রংটা একটু উজ্জ্বল করলে নাকি বিয়ের সাজটা জমে!’ এই মন্তব্যগুলো শুনতে নিছক মনে হলেও, ভেতরে ভেতরে তৈরি করে এক অদৃশ্য মানসিক চাপ—বডি ইমেজ প্রেশার।
অনেক সময় এই চাপ আসে খুবই ঘনিষ্ঠ জায়গা থেকে। হয়তো মা বলেন, ‘তোর চেহারাটার একটু যত্ন নে’, বান্ধবী পরামর্শ দেয়, ‘ওজন না কমালে বিয়ের পোশাক ঠিকমতো মানাবে না’ ইত্যাদি। কেউ কেউ আবার পারলার বা স্কিন ক্লিনিকের ‘ব্রাইডাল ট্রিটমেন্ট প্যাকেজ’ হাতে নিয়ে প্রতিশ্রুতি দেন, ‘বিয়ের দিন তুমি অন্য মানুষ হয়ে যাবে।’ অথচ এই ‘অন্য মানুষ’ হওয়ার ধারণাটাই ভয়ংকর।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক ড. মো. কামাল উদ্দিন বলেন, ‘বিয়ের আগে শরীর নিয়ে অতিরিক্ত সচেতনতা অনেক সময় আত্মপরিচয়ের জায়গাটা নষ্ট করে দেয়। ব্যক্তি কেমন, সেটা ভালোবাসার জায়গা থেকে বদলে যায় সামাজিক মাপে মানানোর জায়গায়।’
এই চাপের তালিকায় পুরুষেরাও পড়েন। ‘বর হিসেবে দেখতে হতে হবে ফিট’, ‘ছবিতে যেন ভুঁড়ি দেখা না যায়’—এমন কথায় তারাও শরীর নিয়ে অস্বস্তিতে ভোগেন। জিম, প্রোটিন ডায়েট, ফটোশুটে সিক্স-প্যাক—সবই যেন বিয়ের প্রস্তুতির অংশ হয়ে ওঠে। আসলে এই সামাজিক নির্দেশগুলো সরাসরি কেউ লিখে দেয় না; কিন্তু বাতাসে ভেসে থাকে—বউ বা বরকে দেখতে হবে নিখুঁত। অথচ বাস্তব জীবনের ভালোবাসা নিখুঁত শরীর নয়; নিরাপদ উপস্থিতি চায়। কিন্তু সমাজ বোঝে না সেই মযার্দা; বরং বলে, ‘নিজেকে বদলাও, তাহলেই বিয়ের ছবিতে ভালো লাগবে!’ এই নিঃশব্দ বার্তাই আজকের তরুণ-তরুণীদের মনে গেঁথে দিয়েছে এক অনন্ত দৌড়—নিজেদের শরীর নয়, বরং অন্যের চোখে নিজেদের প্রতিচ্ছবি ঠিক করার।
নিখুঁত শরীরের প্রতিচ্ছবি
একসময় বিয়ের অ্যালবাম ছিল সুমধুর স্মৃতির ভাণ্ডার। কিন্তু বর্তমানে এ যেন এক প্রতিযোগিতার মঞ্চ। ইনস্টাগ্রামের টাইমলাইন খুললেই দেখা যায় ঝলমলে ব্রাইডাল লুক, নিখুঁত মেকআপে উজ্জ্বল মুখ, আর রকমারি ক্যাপশন। ওয়েডিং ফটোগ্রাফাররাও আজ শুধু মুহূর্ত ধরে রাখছেন না; তৈরি করছেন এক নতুন ট্রেন্ড, যেখানে প্রত্যেক বউ আর বরকে দেখতে হওয়া চাই বিজ্ঞাপনের মতো। এই নিখুঁত চেহারার ছাঁচ বানাতে বড় ভূমিকায় বিউটি ইন্ডাস্ট্রি ও সোশ্যাল মিডিয়া কালচার। একদিকে কসমেটিক ব্র্যান্ডের বিজ্ঞাপন বলে ‘গ্লো আপ করো’, অন্যদিকে ফিল্টার অ্যাপ দেখায় ‘রিয়েল থেকেও সুন্দরতর’ এক সংস্করণ। ফলে নিজ মুখ, ত্বক বা শরীর যেন আর নিজের থাকে না; এক সম্পাদিত সংস্করণে পর্যবসিত হয়।
ডা. সাঈদুল আশরাফের মতে, এই ফিল্টার কালচার মস্তিষ্কে ‘পারফেকশন বায়াস’ তৈরি করছে; অর্থাৎ, মানুষ বাস্তব মুখ বা শরীর দেখে তৃপ্ত হতে পারছে না। তাই নিখুঁত হওয়ার প্রতিযোগিতায় অনেকে ঝুঁকছেন সার্জারির দিকেও।
আমেরিকান সাইকোলজিক্যাল অ্যাসোসিয়েশনের এক প্রতিবেদন বলছে, অতিরিক্ত এডিট করা ছবি নিয়মিত দেখলে মানুষের আত্মমর্যাদা ও আত্মবিশ্বাসে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে, বিশেষ করে বিয়ের প্রস্তুতির মতো সংবেদনশীল সময়ে। তাই তো এখনকার বিয়ের দিন একটি নতুন সম্পর্কের আনুষ্ঠানিকতা না হয়ে, বরং নিখুঁত ছবির প্রতিযোগিতায় মেতে উঠেছেন কেউ কেউ। অথচ ক্যামেরার বাইরের বাস্তব মানুষটি ক্রমেই হারিয়ে যাচ্ছেন নিজের ছায়ায়।
শরীর নয়, সম্পর্কের প্রস্তুতি
বিয়ের আগে শুধু নিখুঁত সাজের খোঁজই নয়; শরীর নিয়েও শুরু হয় এক অদৃশ্য দৌড়। অথচ সম্পর্ক টিকে থাকার মূল শক্তি কখনোই শারীরিক ফিটনেসে নয়; বরং মানসিক প্রস্তুতিতে নিহিত। নিজের প্রতি গ্রহণযোগ্যতা, আত্মসম্মান, পারস্পরিক শ্রদ্ধা—এই জায়গাগুলোর যত্নই আসলে সম্পর্কের ভিত মজবুত করে। সাঈদুল আশরাফ বলেন, ‘বিয়ের আগে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো মানসিক প্রস্তুতি ও আত্মগ্রহণের চর্চা। কেউ যখন নিজের শরীর, সীমাবদ্ধতা ও বাস্তবতাকে মেনে নিতে শেখেন, তখন তিনি অন্যের সঙ্গেও স্বাস্থ্যকর সম্পর্ক গড়ে তুলতে পারেন।’ তার মতে, শরীরের প্রতি সহানুভূতি আসলে নিজের প্রতি ভালোবাসার প্রকাশ। সম্পর্ক শুরু হওয়ার আগে নিজের সঙ্গে সম্পর্কটি দৃঢ় করা খুব জরুরি।
উত্তরণের পথ
চেহারা নিয়ে ক্রমাগত অস্বস্তি বোধ করা, আয়নায় বারবার নিজেকে তুলনা করা কিংবা ছবি দেখে অহেতুক হতাশা—এসব বডি ইমেজ প্রেশারের প্রাথমিক লক্ষণ। কেউ অতিরিক্ত ডায়েট বা এক্সারসাইজে মনোনিবেশ করতে পারেন; কেউ আবার মেকআপ বা ফিল্টারের সাহায্যে বাস্তবতার বিরুদ্ধে লড়াই করেন। এমন আচরণ কেবল শরীর নয়, মনকেও ক্লান্ত করে।
ডা. সাঈদুল আশরাফ জানান, এসব ক্ষেত্রে প্রথমে রোগীর আচরণ ও মানসিক অবস্থা মূল্যায়ন এবং প্রয়োজনে স্কেল বা সার্ভের মাধ্যমে চাপের মাত্রা নির্ধারণ করা হয়। এরপর শুরু হয় থেরাপি। যেমন কগনিটিভ বিহেভিয়ারাল থেরাপি নেতিবাচক ধারণা চিহ্নিত ও পরিবর্তনে সাহায্য করে, আর মাইন্ডফুলনেস বা স্ট্রেস ম্যানেজমেন্ট মানসিক চাপ কমায়। অনেক সময় কাউন্সেলিংয়ের মাধ্যমে আত্মবিশ্বাস ও আত্মসম্মান পুনর্গঠিত হয় এবং পরিবার ও বন্ধুদের সহানুভূতিশীল সমর্থন উত্তরণের পথ সহজ করে।
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো নিজের প্রতি সহানুভূতি ও গ্রহণযোগ্যতা। শরীর, সীমাবদ্ধতা ও বৈশিষ্ট্যগুলোকে মেনে নেওয়া, স্বাস্থ্যকর জীবনধারায় মনোযোগ দেওয়া এবং কল্পিত পারফেকশনের বদলে নিজের আনন্দ ও মানসিক শান্তিকেই অগ্রাধিকারে রাখা। ছোট লক্ষ্য নির্ধারণ করা, থেরাপি ও আত্মসচেতনতার মাধ্যমে ধীরে ধীরে বডি ইমেজ প্রেশারের চাপ থেকে মুক্তি পাওয়া এবং নিজের ভেতরের আলো আবারও জ্বালাতে পারা সম্ভব।
ছবি: ইন্টারনেট
