ফিচার I খোলা আকাশের তলায়
সিনেমা দেখা মানেই শুধু হল বা মাল্টিপ্লেক্সের শীতাতপ পরিবেশে বসে দৃশ্য ও শব্দের শিল্প-বিনোদন উপভোগ করা নয়। চলচ্চিত্রে বিশ্বব্যাপী নানা এক্সপেরিমেন্টের মতোই এর প্রদর্শনী নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা হচ্ছে বিশ্বজুড়ে। খোলা আকাশের তলায় প্রকৃতির সঙ্গে একাত্ম হয়ে সিনেমা দেখার ঝোঁক দেখা যাচ্ছে। ওপেন এয়ার ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল থেকে শুরু করে ওপেন এয়ার সিনেমা স্পেস এখন ইউরোপের পাশাপাশি উপমহাদেশেও। মাল্টিপ্লেক্সের দমবন্ধ ব্যবস্থার সমান্তরালে এই সিনেমা স্পেসই চলচ্চিত্রের ভবিষ্যৎ। এর পরম্পরা নিয়ে লিখছেন অতনু সিংহ
‘তোমার বাড়ির রঙের মেলায় দেখেছিলাম বায়োস্কোপ/ বায়োস্কোপের নেশায় আমায় ছাড়ে না/ ডাইনে তোমার চাচার বাড়ি/ বাঁয়ের দিকে পুকুর ঘাট/ এই ভাবনায় বয়স আমার বাড়ে না…’
বিকেলবেলার মহল্লায় একটা চৌকো জাদুবাক্স নিয়ে হাজির হয়েছেন হারুন চাচা। সেই বাক্সে একটা ঘুলঘুলি। তাতে চোখ তাক করেছে পাড়ার ‘পোলাপাইন’রা, বাক্সের ভেতরের ‘জাদু’ দেখার জন্য। কিশোরীদেরও ভিড় জমেছে! ‘জাদু’ অর্থাৎ চলমান কিছু দৃশ্য। যাকে আমরা ‘ফুটেজ’ নামে এখন চিনি।
তো, চলচ্চিত্রের একসময়ের ধারণা এমনই ছিল। সিনেমা মানে তখন বোঝাতো স্থানান্তরযোগ্য ‘বায়োস্কোপ’। সিনেমা হল নয়, ওটাই ছিল দৃশ্যশ্রাব্য বা অডিও-ভিজ্যুয়াল মিডিয়ামের প্রাথমিক ব্যবস্থা। খোলা আকাশের তলায় চলমান দৃশ্য বায়োস্কোপের ফাঁক দিয়ে চেখে নেওয়ার সে এক উন্মাদনার সময়। তারপর ক্রমে চলচ্চিত্র এক শক্তিশালী মাধ্যমে পরিণত হয়। শুটিং, শব্দগ্রহণ, সম্পাদনা, সংগীত নির্মাণ, শব্দ সম্পাদনার মাধ্যমে চলচ্চিত্রায়ণের পর তার মার্কেটিং, ডিস্ট্রিবিউশন হয়ে চলচ্চিত্র প্রদর্শনের ব্যবস্থায় সিনেমা হল বা প্রেক্ষাগৃহ এবং সবকিছু নিয়ে সিনেমা হয়ে ওঠা… এবং সিনেমা মানেই তার যে মায়াবাদী পরিকাঠামো, তা ইনডোর স্পেসনির্ভর। অর্থাৎ, মাথার উপরে ছাদসহ চারদিকের দেয়াল ঘেরা প্রেক্ষাগৃহের ভেতরে রুপালি পর্দায় সিনেমা দেখে আমরা অভ্যস্ত।
পরে সিনেমা হলের চরিত্র কিছুটা বদলেছে মাল্টিপ্লেক্সকে কেন্দ্র করে। কিন্তু চলচ্চিত্র মানেই ইনডোর। তা সিনেমা হল, অথবা মাল্টিপ্লেক্সে অথবা বাড়ির হোম থিয়েটার, হাই ডেভিনিশন এলইডিই হোক না কেন! কিন্তু এই ট্রেন্ড এখন বদলাচ্ছে। শুরু হয়েছে ওপেন এয়ার সিনেমার ধারা। যা অনেকটাই বাড়ির উঠোনে অথবা খোলা মাঠে আমাদের পূর্বজদের কালের যাত্রাপালাগুলোর মতো করে অথবা সেই যে বায়োস্কোপের কথা দিয়ে এ লেখা শুরু হয়েছিল, সেই ফিল আমাদের মনে ধরা দেবে ওপেন এয়ার সিনেমা স্পেসকে কেন্দ্র করে।
খোলা হাওয়ায় চলচ্চিত্রের মায়া উৎসব
মূলত গোটা বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে কেন্দ্রীয় বিনিয়োগের বাইরে গিয়ে স্বাধীন প্রযোজনার স্বাধীন চলচ্চিত্র নির্মাণ এখন বড় একটা ট্রেন্ড হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ওপেন এয়ার ফিল্ম ফেস্টিভ্যালের আয়োজন করা হচ্ছে বিভিন্ন দেশে। খোলা আকাশের তলায় চলছে চলচ্চিত্র প্রদর্শনী। যেমন এথেন্সের ওপেন এয়ার ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল। ৮ বছরে পা দিয়েছে এই চলচ্চিত্র উৎসব। স্থানীয় একটি চলচ্চিত্র পত্রিকা ও এথেন্স মিউনিসিপ্যালিটির যৌথ উদ্যোগে ৪ জুন এই উৎসব শুরু হয়েছে, চলবে ২৯ আগস্ট পর্যন্ত। বিভিন্ন পার্কে, খোলা মাঠে এটি অনুষ্ঠিত হচ্ছে। একেকটি ফিল্ম একেকটি স্থানে প্রদর্শিত হছে এই উৎসবে। খোলা হাওয়ায় সিনেমা দেখার অভিজ্ঞতার মধ্যে প্রকৃতির সঙ্গে থাকার সুখ যেমন রয়েছে তেমনি স্বাধীনতার আনন্দও আছে।
ভারতের উডিশা রাজ্যের পুরীতে সমুদ্রের ধারে ‘ব্রিং ইউর ঔন ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল’ নামে একটি ওপেন এয়ার ইন্ডিপেন্ডেন্ট ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল অনুষ্ঠিত হয় প্রতিবছর। কলকাতার সত্যজিৎ রায় ফিল্ম অ্যান্ড টেলিভিশন ইনস্টিটিউটের ওপেন এয়ার থিয়েটারেও চলচ্চিত্র প্রদর্শিত হয়, তবে তা কেবল সেখানকার ছাত্রদের জন্য।
শুধুই ইন্ডিপেন্ডেন্ট ফিল্ম নয়, খোদ হলিউডের সিনেমাও এখন প্রদর্শিত হচ্ছে খোলা আকাশের তলায়। ডাবলিনের মেরিওন স্কয়ারে জুনের শেষ সপ্তাহ ধরে প্রদর্শিত হয়েছে মাইকেল গ্রেসি পরিচালিত মিউজিক্যাল ফিল্ম ‘দ্য গ্রেটেস্ট শো-ম্যান’। প্রায় ছয় ইউরোতে বিক্রি হয়েছে এই ছবির ওপেন এয়ার প্রদর্শনী।
এই উপমহাদেশে ওপেন এয়ার ফিল্ম ফেস্টিভ্যালের ইতিহাস প্রায় ৭৫ বছরের পুরোনো। ৪৭-এর আগে থেকে চলচ্চিত্রকার ঋত্বিক কুমার ঘটক, বারীন সাহা, মৃণাল সেনরা সোভিয়েতের আইজেনস্টাইন থেকে শুরু করে ইতালির ডেসিকাসহ নানা কিংবদন্তি চলচ্চিত্রকারের ছবি গ্রাম-গ্রামাঞ্চলে গিয়ে খোলা আকাশের তলায় প্রদর্শনের উদ্যোগ নিয়েছিলেন। কারণ, সিনেমাকে মনে করা হয় সমাজবিপ্লবের প্রধান একটি অস্ত্র। তাই বাম মতাদর্শ প্রচারে একে সাধারণ মানুষের কাছে এভাবেই পৌঁছে দিতে চেয়েছিলেন তাঁরা। পরবর্তীকালে কেরালার বিখ্যাত চলচ্চিত্রকার প্রয়াত জন আব্রাহাম রাজনৈতিক তাগিদ থেকেই তাঁর নিজের তৈরি করা ছবি গ্রামগঞ্জে প্রদর্শনীর ব্যবস্থা করেছিলেন খোলা আকাশের নিচে। বিশ্বের বহু ছবিকে মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে ‘ওডেসা’ নামক একটি ফিল্ম গ্রুপ তৈরি করেছিলেন তিনি।
বিলেতের মুক্ত সিনেমারা
লন্ডনের ঐতিহাসিক স্থান, সাহেবসুবোদের খানাপিনা, বার-রেস্তোঁরা এসবের প্রতি আমাদের মতো উপমহাদেশের সাধারণ পর্যটকদের আগ্রহ বেশি। কিন্তু লন্ডনের কোনো প্রাসাদের উঠোনে বসে, কোনো বাড়ির ছাদে শুয়ে অথবা টেমসে ভাসতে ভাসতে যদি সিনেমা দেখা যায়, তাহলে তার অভিজ্ঞতা হবে একেবারেই অন্য রকম। সিনে-পর্যটকদের জন্য চালু হয়েছে এমন ব্যবস্থা। তাই চলচ্চিত্রপ্রেমী পর্যটকেরা এখন লন্ডনে পা রাখলে দেখবেন চলচ্চিত্র প্রদর্শনের নানা ব্যবস্থা। বলা যেতে পারে, লন্ডনের নানা জায়গায় খোলা আকাশের তলায় ঝুলে আছে সিনেমার পায়া পর্দা।
যেমন সামরেস্ট হাউজে প্রতিবার আগস্টে এডমন্ড জে সাফরা ফাউন্টেইন কোম্পানি চলচ্চিত্র প্রদর্শনীর আয়োজন করে। সেখানে বেশ কিছু ফিল্মের রেড কার্পেট প্রিমিয়ারের অনুষ্ঠানসহ বহু ক্ল্যাসিক ও সমকালীন চলচ্চিত্র প্রদর্শিত হয়। সতেরো পাউন্ড খরচ করলেই এসব প্রদর্শনীতে অংশ নেওয়া যায়।
লন্ডনের রুফটপ ফিল্ম ক্লাবের সৌজন্যে সূর্যাস্তের সময় বিভিন্ন বিল্ডিংয়ের ছাদে রঙিন আকাশের তলায় বসে দেখা যেতে পারে মনোমুগ্ধকর কিছু ছবি। কোনো কোনো ছবির পরিচালক ও কলাকুশলীদের সঙ্গে আড্ডাও দেওয়া যায়। মূলত পেখাম রাইয়েস বিল্ডিংয়ের ছাদে বসে এভাবে চলচ্চিত্রের স্বাদ নেওয়া যায়। এ ছাড়া মূল শহরের আশপাশেও এই ফিল্ম ক্লাব ছাদ-সিনেমার ব্যবস্থা রেখেছে। এভাবে ছবি দেখতে খরচ করতে হবে মাথাপিছু মাত্র পনেরো পাউন্ড।
টেমসের পানিতে ভেসে ভেসে যদি ফরাসি নবতরঙ্গের ছবি কিংবা ইরানের আব্বাস কিওরাস্তামি, জাফর পানাহি, মহসিন মখমল বাফদের ছবি অথবা ওজু-কুরোসাওয়া-মিজোগুজিদের ক্ল্যাসিক বা আজকের সাইমিং লিয়াং আর তাকাশিমিকেদের ছবি নয়তো নেহাত হলিউড ক্ল্যাসিকের কোনো রোম্যান্টিক ছবি কিংবা আমাদের ভাষা বাংলার কোনো ছবি যদি দেখা যায়, তাহলে তো কথাই নেই সিনেমা পর্যটকদের কাছে। এই ব্যবস্থা রয়েছে। টাইম আউট নামে একটি সংস্থার সৌজন্যে সিনেমা পর্যটকেরা এই সুযোগ পাচ্ছেন। অবশ্য এর জন্য মাথাপিছু খরচ ২৯ পাউন্ড।
এ ছাড়া গ্রিনউইচ পেনিনসুলা, কেনিংটন পার্ক, কোরাম ফিল্ডের মতো জায়গায় খোলা আকাশের তলায় সন্ধ্যার পর পপ-আপ স্ক্রিনে ছবি দেখা যায়। খরচ মাথাপিছু ১২ পাউন্ড।
লন্ডনের গ্রসভেনার উদ্যানে বসে নোমাড সিনেমার পপ-আপ স্ক্রিনে সিনেমা দেখার মজাই আলাদা। মনে হবে কবরস্থানে বসে সিনেমা দেখছেন। প্রতি রাতে এখানে বসে ছবি দেখা যায়, খরচ পড়বে মাথাপিছু মাত্র ৮ পাউন্ড। এ ছাড়া লন্ডনের বিভিন্ন পার্কে লুনা সিনেমা নামে একটি পার্কে নানা ধরনের ছবি দেখার ব্যবস্থা করেছে। পার্কে ছবি দেখার মাথাপিছু খরচ সাড়ে ১৪ পাউন্ড। অতএব লন্ডনকে সিনেমা পর্যটকের দৃষ্টিকোণ থেকে দেখার নতুন সুযোগ চলচ্চিত্রপ্রেমীদের কাছে।
সিনে পর্যটন
শুধু যুক্তরাজ্যের লন্ডনেই নয়, ফ্রান্স, আমেরিকা, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া ও ভারতের নানা জায়গায় ছোট, মাঝারি ও বড় উদ্যোগে ওপেন এয়ার সিনেমা চর্চা শুরু হয়েছে। বলা যেতে পারে, মাল্টিপ্লেক্স কালচারের সমান্তরালে খুব তাড়াতাড়িই এই ব্যবস্থা জনপ্রিয় হয়ে উঠবে। পর্যটনের সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়বে সিনেমা। পাহাড়ে, সমুদ্রতটে, অরণ্যে, ঝর্নার ধারে, নদীবক্ষে, মহাসমুদ্রে জাহাজের ডেকে, প্রত্যন্ত গ্রামে, বরফের চূড়ায় শুরু হবে সিনেমার দিন। রিয়েল টাইম-স্পেসের দৃশ্য-শ্রাব্যের সঙ্গে মিশে যাবে রিল টাইম-স্পেসের অডিও-ভিজ্যুয়াল। শুধু সেসব ক্ষেত্রে প্রজেক্টর, পাওয়ার ব্যাকআপ আর একটা ল্যাপটপ ও সিনেমা মজুত রাখার জন্য একটা এক্সটারনাল হার্ডড্রাইভ হলেই হলো।
ছবি: সংগ্রহ
Hello there! This is my first visit to your blog!
We are a team of volunteers and starting a new initiative in a community
in the same niche. Your blog provided us beneficial information to work
on. You have done a extraordinary job! – Ruby