ফিচার I সাংহাইয়ের নৈশাহার
সাংহাইয়ের পথনাশতার সুলুকসন্ধান আগেই দিয়েছিলেন। এবারের রসনাভ্রমণে তারকা শেফ শুভব্রত মৈত্র শেয়ার করলেন নৈশাহারের অনবদ্য অভিজ্ঞতা
নাশতার পর ব্যবসায়ীদের সঙ্গে মিটিং করতে করতেই দিনটা গেল। এর মধ্যে দুপুরে কোনোমতে নাকেমুখে গোঁজা হলো। চীনে লাঞ্চের জন্য বরাদ্দ এক ঘণ্টা। শুরু ১২টায়। ওরা আধঘণ্টার মধ্যেই খেয়ে নেয়। বাকিটা সময় বিশ্রাম। সব অফিসেই যে যার ডেস্কে বিশ্রাম নেয়। অনেক অফিসে আবার বিশ্রামের জন্য ব্যবস্থা থাকে। এই বিশ্রামকে আসলে ভাতঘুমই বলা চলে।
যা হোক, আমি সেদিন লাঞ্চে নুডলস স্যুপ ও রোস্টেড হাঁসের মাংস খেলাম। বিশ্বের অনেক শহরের মতোই সাংহাইতেও নানা সংস্কৃতির মানুষের উপস্থিতি লক্ষণীয়। এটা যথার্থই কসমোপলিটান সিটি। ফলে এখানকার রসনাবৈচিত্র্যও চোখে পড়ার মতো। সুস্বাদু স্ট্রিট ফুড থেকে শুরু করে পাঁচ তারা রেস্তোরাঁর সহাবস্থান ঘটেছে এই শহরে। এখানে বৈচিত্র্য, প্রাণময়তা, উচ্ছলতায় ভরপুর সাংহাইয়ের জীবন। উল্টো পিঠে এই শহর জনাকীর্ণও বটে। কারণ, প্রায় আড়াই কোটি মানুষের বাস এখানে। অবশ্য এতে অবাক হওয়ার মতো কিছু নেই।
বিকেলে আমাদের পিপলস স্কয়ারে যাওয়ার কথা। আমার বন্ধু আমাকে তাই তৈরি হতে বললো। বলে গেল, এটা এই শহরের সবচেয়ে কৌতূহল জাগানো স্থান। কিন্তু কেন- আমার এই উত্তরে তার ভাবখানা যেন: রসো বৎস, গেলেই মালুম হবে। সেখানে গিয়ে আমি তো বিস্ময়তাড়িত। পিপলস স্কয়ার আক্ষরিক অর্থেই সমাগমস্থল। সাংহাই মিউনিসিপ্যাল গভর্নমেন্ট বিল্ডিংয়ের পাশের একটি খোলামেলা এলাকা। আকাশছোঁয়া অট্টালিকায় গাদাগাদি এই শহরের বাসিন্দাদের বুকভরে শ্বাস নেওয়ার জায়গা। নীল চাঁদোয়ার নিচে সবুজের আয়োজন এই শহরকে সজীব আর সতেজ রাখার জন্য। সপ্তাহান্তে এটাই আবার মার্কেট প্লেসে পরিণত হয়। মজার ব্যাপার হলো, চীনা বাবা-মায়েরা তাদের বিবাহযোগ্য সন্তানের জন্য সঙ্গী খুঁজতেও যান ওই পিপলস স্কয়ারে। ভালো চাকরি, এমবিএ ডিগ্রি, নিজেদের বাড়ি- এসব আবার পাত্রী খুঁজতে সাহায্য করে। অন্যদিকে কম বয়স, উচ্চতা, আকর্ষক শারীরিক গঠন কন্যার জন্য সুপাত্র পেতে সহায়ক হয়। উচ্চ শিক্ষিত চীনা তরুণীদের আবার বিয়ে নিয়ে মাথাব্যথা নেই। তাদের কাছে আগে ক্যারিয়ার পরে সংসার। তাদের এই মনোভাব পুরুষতান্ত্রিক চৈনিক সমাজে নারীর ক্ষমতায়নকে ত্বরানি^ত এখন আর কেবল উচ্চ বেতনের চাকরি নয়, বরং সৎ ও দায়িত্বশীল জীবনসঙ্গীই মেয়েদের কাছে প্রাধান্য পায়। হাল প্রজন্মের স্বাধীনচেতা মেয়েদের পছন্দের পুরুষসঙ্গী বাছাই প্রক্রিয়া দেখাটাও এক অনন্য অভিজ্ঞতা বৈকি।
হুয়াংপু রোডের মুখে আসতেই দুজন আবার চা-চক্রে যোগ দেওয়ার আমন্ত্রণ জানালেন। ওদের চায়ের তো যথেষ্ট খ্যাতি রয়েছে। আমিও তাই আগ্রহী ছিলাম। কিন্তু আমার বন্ধু আমাকে বাধা দিয়ে বলল, এই চা-চক্র নিয়ে সাংহাইয়ের যথেষ্ট বদনাম রয়েছে। কারণ, এই দম্পতিরা চা-চক্রে আমন্ত্রণ জানিয়ে পর্যটকদের কাছ থেকে হাজারখানেক আরএমবি (বাংলাদেশি ১৩ হাজার টাকা) কৌশলে হাতিয়ে নেয়। আমার অবশ্য এ নিয়ে কোনো ধারণাই ছিল না। সাংহাইয়ের স্থানীয়রা এদের থেকে নিরাপদ দূরত্বে থাকে। আমি ভাগ্যবান ভেবেছি, কারণ অ্যানিস আর কাইজিনের মতো বন্ধুও তো সবার হয় না। আরও একটা বিষয়, এই শহরে পকেটমারদের থেকেও খুব সাবধানে চলাফেরা করতে হয়।
ক্রমেই আমি যেন এক অনন্ত গোলকধাঁধার মধ্যে সেঁধিয়ে যেতে থাকি। চারপাশে সানন্দ মানুষের ভিড়। এদের অনেকেই প্রত্যাশার বুদ্বুদ ওড়াতে থাকে। আমি দেশের চিরচেনা পরিবেশের কথা ভাবি। কারণ, সোমর্থ নাতি-নাতনিদের নিয়ে কি ভীষণ চিন্তাই না করে থাকেন আমাদের দাদু-দাদিরা। তাদের দুশ্চিতার সীমা থাকে না। এখানেও সেই দৃশ্যের অবতারণায় ভাবি আসলে পরিবার-সংস্কৃতি এখনো টিকে আছে সর্বত্রই। তা সে ভারত, বাংলাদেশই হোক কিংবা চীন।
সঙ্গীসন্ধান বর্তমানে কঠিন কিছু নয়। তবু এটা আজও সত্যিকারে সামাজিক বিষয়েই থেকে গেছে। মানুষ একসঙ্গে হাঁটছে, কথা বলছে, গল্প করছে। গাছের তলায় গলা সাধিয়েরাও মশগুল। আর বাবা-মায়েদের সঙ্গে আসা বাচ্চা মেতে আছে নানা অ্যাকটিভিতে। খেলাধুলা, মাছ ধরা ইত্যাদি। ওদের জন্য চলছে আলাদা কার্নিভ্যালও।
সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলে আমরা হোটেলে ফিরি। বন্ধুদের বিদায় জানিয়ে আমি তৈরি হয়ে নিই। কারণ, দীর্ঘ প্রতীক্ষার এ নৈশভোজে আপ্যায়িত হওয়ার উত্তেজনা তখন আমার ভেতর। লন্ডনের অভিজাত মিচেলিন স্টার রেস্তোরাঁ ‘হাক্কাসান’ সাংহাইতে চালু হওয়ার পর থেকে সেখানে ডিনারের স্বপ্ন দেখেছি। আমার তালিকায়ও রয়েছে এই রেস্তোরাঁ। এবারের চীন সফরে আমি করণীয় তালিকায় এটা রেখেছি। সেখানে গিয়ে চায়নিজ অভিজাত ভোজন অভিজ্ঞতার সঙ্গে পরিচিত হতে চাই। বুন্ড এইটিন বিল্ডিংয়ের পঞ্চম তলায় হাক্কাসান। এই রেস্তোরাঁ সাংহাইয়ের উচ্চকোটির মানুষের জন্য। এর অনিন্দ্য অন্দর, বিশ্বমানের মিক্সোলজি আর আধুনিক ক্যান্টোনিজ কুজিনের মেলবন্ধনে অনবদ্য রসনা অভিজ্ঞতা প্রদান করাই এই রসনালয়ের উদ্দেশ্য। ২০১৪ সালে শুরু। এরপর থেকেই সুললিত পর্যালোচনার কল্যাণে হাক্কাসান বিশ্বের সেরা ৫০টি রেস্তোরাঁর অন্যতম হিসেবে পরিগণিত হচ্ছে। আশ্চর্যসুন্দর অন্দরে তিনটি পৃথক ডাইনিং এরিয়া। কাঠের জাফরির সঙ্গে চামড়ায় মোড়ানো মূল ডাইনিং রুমে প্রতীয়মান অন্তরঙ্গ আবহ।
লিং লিং লাউঞ্জে মিলবে সাংহাই স্কাইলাইন ও হুয়াংপু নদীর সম্মোহনী সৌন্দর্য দেখার অভিজ্ঞতা। অভিজাত নগরবাসী, শিল্পপতি, অভিবাসীরাই রয়েছেন মূলত নিয়মিতদের তালিকায়। কোনো অতিথিকে মুগ্ধ করতে চাইলে কিংবা প্রিয়সান্নিধ্যে সন্ধেটা কাটাতে চাইলে হাক্কাসান লা জবাব। রেস্তোরাঁয় পৌঁছতেই মেলে সেবিকাদের উষ্ণ অভ্যর্থনা। জেনে নিতে চায় আমার ইচ্ছে- ডিনারের আগে কোন পানীয়ে গলা ভেজাতে চাই, নাকি সরাসরি মজে যেতে চাই নৈশাহারে।
আমি সোজা চলে যাই নির্দিষ্ট ডাইনিং টেবিলে। বিলাসী সোফা অনাবিল উষ্ণতার সঙ্গে মৃদু সুরের মূর্ছনায় মৌতাত বোনে অন্দরের আবহ। থিয়েটারের মতো উঁচু জানালার শার্সি ভেদ করে নিবদ্ধ দৃষ্টিতে উজ্জ্বল হয় রাতের শহরের আকাশরেখা আর বুন্দ।
আমাদের বলা হলো মুখপাতটা হাক্কাসানের সিগনেচার স্টার্টার দিয়ে করতে। বাতাবিলেবু, আনার আর পাইন নাটের সঙ্গতে মুচমুচে ডাক স্যালাড। ঢিবির মতো উঁচু করে সাজিয়ে পরিবেশন করা হয়েছে শৈল্পিক নান্দনিকতায়। হাঁসের মাংসের উপরিভাগ মুচমুচে। কিন্তু ভেতরের অংশ এতটাই মোলায়েম যে মুখে দিলেই মিলিয়ে যায়। হাক্কাসানের আরেকটি ট্রেডমার্ক বিশেষত্ব ডিমসাম। লাক্সারিয়াস ডিমসাম প্লেটার আসলে, প্রন ডাম্পলিং; সঙ্গে মাশরুম ডাম্পলিং আর রোস্টেড ডাক। রসাল ডাম্পলিংয়ে ভরপুর সৌরভ। আর জিভে জল আসা তো বটেই। একের পর এক পদ আশে ষে গলাধঃকরণ করেছি। তারপর এসেছে শেষপাতের মিষ্টি। অর্থাৎ ডেজার্ট। লেমন পট। ভীষণই পাতলা অথচ বাদামের তক্তিকে ঘিরে মেরাঙের উপস্থিতিকে মাত্রা দিয়েছে ডিমাকৃতির লেমন কার্ডের দলা। তাকে বসানো হয়েছে মুজের আসনে। এক চামচেই পুরোটা মুখে পুরতে পারেন। অথবা তারিয়ে খেতেও পারেন। একের মধ্যে বহু স্বাদ। অম্লমধুর, মোলায়েম-কঠিন। প্রতিটির আলাদা বৈশিষ্ট্য আর স্বাদের অনন্যতা আপনাকে মোহিত করবে।
অন্যান্য সময়ের তুলনায় একটু ব্যয়বহুল। এই রেস্তোরাঁর অভিজ্ঞতা স্মরণীয় হয়ে থাকবে।
বড় বড় রেস্তোরাঁ মানেই ব্যাপক কড়ি গোনার বিষয়। এটাই আমাদের চিরাচরিত ধারণা। কিন্তু মিচিলিন স্টার রেস্তোরাঁ হওয়া সত্ত্বেও এখানকার খাবার থাকছে সাধ্যের মধ্যেই। যাকে বলে ভ্যালু ফর মানি।
যা হোক, হাক্কাসানের রসনা উৎসবের অনন্যতায় নিজেকে ঋদ্ধ করে পথে নামি। বলতেই হবে বুন্দের সান্নিধ্য আপনাকে যতটা আনন্দিত করবে, তার চেয়ে কোনো অংশে কম হবে না হাক্কাসানে সময় কাটানো। এবার সাংহাইয়ের নৈশজীবন বলার অপেক্ষা রাখে না এই শহর আপনাকে যে অভিজ্ঞতা দেবে, তা অন্য কোনো শহরের সঙ্গে তুল্য হবে না। সারা রাতেই বার, লাউঞ্জ আর ক্লাবগুলো তাদের দরজা খুলে রাখে স্থানীয় অধিবাসী, অভিবাসী আর বিদেশি পর্যটকদের জন্য। জমজমাট থাকে পুরো শহর। তা সে সপ্তাহের যে দিন হোক না কেন। সাংহাইয়ের সফর শেষ করে আমি ভেবেছি ২০ বছর আগের কথা। কী ছিল এটা। একটা মৎস্যজীবীদের শহর বৈ তো নয়।
অথচ মাত্র দুই দশকে কীভাবে বদলে ফেলা হয়েছে এই শহরটা। পরিণত হয়েছে নগরে। শুধুই কি তাই; এটা এখন কেবল চীনের নয়, বরং এশিয়ার অর্থনৈতিক আর বাণিজ্যিক নগরী। সরগরম মেট্রোপলিস। বন্ধুবান্ধবের জন্য স্মারক উপহার কিনতে ন্যানজিং রোড দিয়ে হাঁটতে থাকি। তারপর চলে আসি হোটেলে। আরও একটি শহরের পরিক্রমায় রাত পোহালেই শুরু হবে নতুন সফর। এবার আমার গন্তব্য গুয়াংজু।
ছবি: ফজলে রশিদ