skip to Main Content

সাক্ষাৎকার I বর্তমানেই আগামীর যাপন

যাপনকে নিরবচ্ছিন্ন, সুস্থির আর উপভোগ্য করতে নব্বই বছর আগে দুই জার্মান বন্ধুর ছোট্ট উদ্যোগ আজ বহুজাতিক। সময়ের নানা বাঁক পেরিয়ে এই প্রতিষ্ঠানের সানন্দ উপস্থিতি বর্তমানে বাংলাদেশেও। সম্প্রতি হ্যাফলে বাংলাদেশের বিজনেস হেড পার্থ চক্রবর্তীর সঙ্গে কথা বলে সম্ভাবনাময় এই বাজারে প্রতিষ্ঠানটির অবস্থান আর পরিকল্পনা সম্পর্কে স্পষ্ট হয়েছেন শেখ সাইফুর রহমান

১৯২৩। দুই তরুণ অ্যাডলফ হ্যাফলে ও হারমান ফাঙ্ক নিজেদের ভাগ্য নিজেদের হাতে তুলে নিলেন। সে বছরের ১ ডিসেম্বর আউট অব দ্য বক্স ভাবনায় শুরু করলেন এক ব্যবসা অভিযান। উটেনবার্গের অলেনডর্ফে খুলে বসলেন স্পেশালিটি স্টোর। নাম দেওয়া হলো প্রডাক্টস ফর হার্ডওয়্যার অ্যান্ড টুল ইন্ডাস্ট্রি। দোকান সাজানো হলো জোড়া লাগানোর সব প্রয়োজনীয় হার্ডওয়্যার সরঞ্জামে। বিভিন্ন ধরনের জোড়া লাগানোর সামগ্রী তৈরিতে ওস্তাদ তারা। আর অবশ্যই আসবাব তৈরির সরঞ্জামেও দক্ষ। তবে চার বছর পর উটেনবার্গ ছেড়ে হ্যাফলে চলে আসে ছোট্ট শহর নাগোল্ডে। এটা একসময় ছিল আসবাব তৈরির জন্য বিখ্যাত। আরও তিন বছর পর ১৯৩০ সালে অ্যাডলফ হ্যাফলে পাইকারি বিক্রি শুরু করে। এরও তিন বছর পর স্ট্রাসবার্গের আন্তর্জাতিক বাণিজ্য মেলায় অংশগ্রহণ। শোবার ঘর আর রান্নাঘরের ফার্নিচার ফিটিংয়ের নতুন রেঞ্জ উপস্থাপন করা হয় সেই মেলায়। প্রথমবারেই বাজিমাত। ডিসপ্লে বুথ ডিজাইনে স্বর্ণপদক। শুরু রপ্তানি।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ডামাডোল থেকে বেরিয়ে নতুন করে এগিয়ে যায় হ্যাফলের কর্মযজ্ঞ। যোগ হয় নতুন প্রজন্ম। হ্যাফলের ভাইপো ওয়াল্টার থিয়েরার। তবে ১৯৪৫ সালে ২৫ বছর উদযাপনের পর বছর না ঘুরতেই তিরোহিত হন অ্যাডলফ হ্যাফলে। থিয়েরারের নতুন নেতৃত্বে অব্যাহত থাকে অভিযান। ১৯৬৪ সালে সূচনা দিগ্বিজয়ের। সুইজারল্যান্ডে খোলা হলো হ্যাফলের শাখা।
১৯৬৪ থেকে ২০১৮। বাংলাদেশে শাখা খোলার অবকাশে বিশ্ববিজয় সমাপ্ত হয়েছে। এরই মধ্যে পৌঁছে গেছে অন্তত ১৫০ দেশে। তবে বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক আরও পুরোনো। অন্তত ১১ বছরের। কারণ, বাংলাদেশে হ্যাফলের পা রাখা ২০০৭ সালে। এখানে একটা কথা বলা প্রয়োজন, যে বছর বাংলাদেশ স্বাধীন হয়, অর্থাৎ ১৯৭১, সে বছর হ্যাফলে প্রকাশ করে দ্য কমপ্লিট হ্যাফলে। সবচেয়ে বড় ফার্নিচার ফিটিং টুলের রেফারেন্স বই। তাতে স্থান পায় ২৫ হাজারের বেশি আইটেম।
যা হোক, এ বছরের গোড়ায় ২১ জানুয়ারি বনানীর ১২ নম্বর রোডে শাখা শুরু করে হ্যাফলে। ৩৩০০ স্কয়ার ফুটের ডুপ্লেক্স। এটাই হ্যাফলে ডিজাইন সেন্টার। এক বছরে বেশ গুছিয়ে নিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। সম্প্রতি কথা হচ্ছিল ডিরেক্টর (ফাইন্যান্স অ্যান্ড অপারেশন্স) সাউথ এশিয়া অ্যান্ড বিজনেস হেড (বাংলাদেশ) পার্থ চক্রবর্তীর সঙ্গে। বিভিন্ন বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানের অভিজ্ঞতাসম্পন্ন এই করপোরেট ব্যক্তিত্ব হ্যাফলের সঙ্গে আছেন ২০১২ সালের জানুয়ারি থেকে। বলছিলেন, ২০০৭ সালে বাংলাদেশে হ্যাফলের কার্যক্রম শুরু হলেও প্রথম দিকে মূলত বড় প্রকল্পভিত্তিক কর্মকান্ডে সীমাবদ্ধ ছিল। র‌্যাডিসন, ওয়েস্টিন, লা মেরিডিয়ানের মতো পাঁচ তারকা হোটেল আর বড় প্রজেক্টগুলোয় কাজ করা হয়েছে।
এ জন্য হ্যাফলের কার্যক্রম সম্পর্কে অবহিত থেকেছেন কিছু আর্কিটেক্ট বা প্রকল্প সম্পৃক্তরা। বাংলাদেশে রিটেইলিং শুরু ৪-৫ বছর আগে। দক্ষিণ এশিয়ায় স্ট্র্যাটেজিক কান্ট্রি হিসেবে হ্যাফলে কর্তৃপক্ষের কাছে গুরুত্ববহ হয়ে উঠেছে বাংলাদেশ। সম্ভাবনাময় বাজার বিস্তার হচ্ছে। ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধির পাশাপাশি সুযাপনের প্রতি, সৌষ্ঠব যাপনের প্রতি আগ্রহী হচ্ছে এ দেশের মানুষ। ফলে কেবল প্রকল্প নয়, সরাসরি ভোক্তার কাছে হ্যাফলেকে নিয়ে যাওয়ার ভাবনার বাস্তবায়ন ঘটানো হয়েছে। অন্তত এমনই অভিমত পার্থবাবুর।
পরিসংখ্যানে জানালেন, ৪০ দেশে রয়েছে হ্যাফলের সাবসিডিয়ারি। আর দেড় শ দেশে সুলভ হ্যাফলে পণ্য। ভারতে শুরু ২০০১ সালে। সাবসিডিয়ারি হয়েছে দু বছর পর। সার্কভুক্ত দেশে হ্যাফলে তার অবস্থান জানান দিয়েছে। এর মধ্যে বাংলাদেশের বাজারকে তিনি এগিয়ে রাখছেন সবার থেকে। বাংলাদেশিদের রুচি আর উন্নত মানের পণ্যের প্রতি আগ্রহকেই মূল কারণ বলে অভিহিত করলেন তিনি।
হ্যাফলের সবচেয়ে ভালো দিক হলো ভোক্তার সঙ্গে সম্পর্ক দীর্ঘস্থায়ী করা। তাই পণ্য বিক্রিতেই শেষ হয়ে যায় না লেনদেন; বরং তা অব্যাহত থাকে যন্ত্রাংশ ও বিক্রয়োত্তর সেবার মধ্য দিয়ে।
কথায় কথায় পার্থ চক্রবর্তী আরও জানালেন, বিক্রি আর সেবা সুনিশ্চিত করতে বাংলাদেশে রয়েছে হ্যাফলের ১০ জনের একটি সুদক্ষ দল। আছে নিয়মিত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা। প্রতি কোয়ার্টারেই ভারত থেকে আসেন প্রশিক্ষক। হ্যাফলের কর্মী ছাড়াও প্রশিক্ষণ দেওয়া হয় ডিস্ট্রিবিউটর আর ডিলারদের। সবাইকে সমান্তরালে দক্ষ করে তোলাই এই প্রশিক্ষণের লক্ষ্য।
বহুজাতিক প্রতিষ্ঠান হ্যাফলের কাছে সমান গুরুত্বপূর্ণ স্থানীয় বাজারের চাহিদা, মানুষের অভ্যাস ও রুচি, রীতিসহ যাপনের নানা দিক। ফলে পণ্য উন্নয়নের গবেষণায় গুরুত্বের সঙ্গে স্থান পায় এসব খুঁটিনাটি। এর একটি উদাহরণ হতে পারে বার্নার। ইউরোপের রান্নার সঙ্গে এশিয়ার রান্নার তফাত স্পষ্ট। হ্যাফলেও তাই এখানকার মানুষের জন্য রন্ধন উপযোগী বার্নার ডিজাইন করেছে; যেখানে কার্যকারিতার সঙ্গে সুরক্ষাও সমান গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে।
এখানেই শেষ নয়, হ্যাফলে বস্তুত সিমলেস ফ্লো অব লাইফস্টাইল নিশ্চিত করার চেষ্টায় নিয়োজিত। সেটা শোবার ঘর, বসার ঘর, বাথরুম হোক বা রান্নাঘর- প্রয়োজন আর আরাম নিশ্চিত করার জন্য তৈরি পণ্যে নান্দনিক সৌকর্যকেও গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। ফলে নিরবচ্ছিন্ন যাপন নিশ্চিতের মধ্য দিয়ে ধরে রাখা হচ্ছে সুখানুভূতির অন্তর্লীন আবেশ। দরজা, রান্নাঘরের চিমনি, আলো- সবেতেই সেটা বিদ্যমান, সানন্দে অবহিত করলেন পার্থবাবু।
সংযোজনে আরও স্পষ্ট হলো, হ্যাফলে বর্তমান নিয়েই কেবল ভাবে না, ভাবে ভবিষ্যৎ নিয়েও। তাই তো ফিউচার রেডি প্রডাক্ট ডেভেলপমেন্টে রয়েছে বিশেষ তাগিদ। এ ক্ষেত্রে বিশ্বের শীর্ষ আর্কিটেক্ট, ইন্টেরিয়র ডিজাইনার এমনকি কার্পেন্টারদের মতামতকে অনেক গুরুত্ব দেওয়া হয়। এই প্রসঙ্গে তিনি জানিয়ে রাখলেন, লক-এর ক্ষেত্রে হ্যাফলে বিশেষভাবে দক্ষ। তবে ডিজিটাল জীবনধারাকে বিবেচনায় রেখে ব্লুটুথ এনাবেলড লকও তারা অচিরেই বাজারে আনবেন।
পণ্য তৈরির পর তা গভীর পর্যবেক্ষণ, নিরীক্ষণ আর মান নিরূপণের মধ্য দিয়ে উতরে তবেই তা বাজারজাত হয়ে থাকে।
অনেকের ধারণা হতে পারে, হ্যাফলে বোধ হয় উচ্চবিত্তের জন্যই। কিন্তু এই ধারণাকে নস্যাৎ করে দিলেন পার্থ চক্রবর্তী। বরং বললেন, প্রাথমিকভাবে সেটা মনে হলেও ভ্যালু ফর মানির দিক বিবেচনায় হ্যাফলে কখনোই তা নয়।
যেকোনো পণ্যের প্রতি তখনই মানুষের আগ্রহ তৈরি হয়, যখন সেটা নজরে আসে। হাতে ধরে দেখা যায়। শুনে সেটা হয় না। এ জন্যই তো হ্যাফলে ডিজাইন স্টুডিও করা হয়েছে ঢাকায়, জানিয়ে দিলেন পার্থবাবু। সঙ্গে যোগ করতে ভোলেননি, ঢাকা এবং ঢাকার বাইরে তাদের ডিলারের সংখ্যা দিন দিন বেড়েই চলেছে।
আরও বললেন, হ্যাফলে আসলে একটা টোটাল সলিউশন কোম্পানি। এক ছাদের নিচেই মেলে সব সমাধান। এ জন্যই মানুষ হ্যাফলের প্রতি আগ্রহী হয়ে থাকে। তা ছাড়া প্রডাক্ট কোয়ালিটি ঢাকাতেও যা, জার্মানিতেও তাই। এটাই হ্যাফলের সবচেয়ে বড় শক্তির জায়গা।
কেবল জয়েনারি হার্ডওয়্যার, লাইটিং, কিচেন ফিটিংই নয়, হ্যাফলে বাংলাদেশে আরও নিয়ে এসেছে ইলেকট্রিক আভেন, কুকিং স্টোভ, ইনডাকশন কুকার আর রেফ্রিজারেটরও।
উচ্চতর গুণগত মান, কার্যকর ও নান্দনিক পণ্যে অন্দরের সজ্জায় মাত্রা দিতে জুড়িহীন হ্যাফলে পণ্য। আগামীর যাপনসৌন্দর্য উপভোগের সুযোগ করে দিচ্ছে বর্তমানেই।
sksaifurrahman@gmail.com
ছবি: ক্যানভাস

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top