ছোট ঋতুরাজ এবং তার পিতা শুভাশীষ এখন পরিচিত মুখ। সম্পর্কে তারা পিতাপুত্র। ‘বাপকা বেটা’ নামেও এই যুগলকে চিনে থাকেন অনেকে। গান গেয়ে শ্রোতা মাতাচ্ছে ছেলে ঋতুরাজ। পুরোনাম ঋতুরাজ ভৌমিক হূদ্য। পিতা শুভাশীষ ভৌমিক শুভ। তা ছাড়াও ভিন্ন কিছু উদ্যোগও নিয়েছেন শুভাশীষ। যেমন মূল্যবোধের চর্চার জন্য তৈরি করেছেন ‘মূল্যবোধের পাঠশালা’। তা নিয়েই আলাপ হলো শুভাশীষ ভৌমিক শুভর সঙ্গে।
ক্যানভাস: ‘বাপকা বেটা’ মূলত কী? এর নামকরণের পেছনে কোনো থিম কাজ করেছে কি?
শুভাশীষ: বাপকা বেটা আসলে আমার ৮ বছরের সন্তান ঋতুরাজ এবং আমার গড়া একটি ব্যান্ডের নাম। এই নামে সোশ্যাল মিডিয়ায় আমদের অ্যাকাউন্ট আছে, যেখানে আমরা আমাদের নিজেদের সুন্দর মুহূর্তগুলো স্মৃতিবন্দি করে রাখি এবং গানের মাধ্যমে আমাদের বাবা ছেলের সম্পর্কের গভীরতা পরখ করি। এটি একটি প্রতীকী নাম। আমরা বিভিন্ন কন্টেন্টের মাধ্যমে বাবা-মায়েদের উৎসাহিত করতে চেষ্টা করি, যেন তারা তাদের সন্তানদের সাথে এক বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তোলেন, সন্তানের সুপ্ত প্রতিভা বিকাশে তাদের সাহস যোগান এবং সন্তানদের মাত্রাতিরিক্ত বিভিন্ন ডিজিটাল ডিভাইসে ডুবে যেতে না দিয়ে, তাদের সঙ্গে সুন্দর কিছু সময় কাটান।
ক্যানভাস: ‘মূল্যবোধের পাঠশালা’র মূল লক্ষ্য কী? এর মাধ্যমে শিশু, তরুণ-তরুণী কিংবা পিতা-মাতারা কীভাবে উপকৃত হতে পারেবে?
শুভাশীষ: বর্তমানে আমাদের চারপাশে আমরা শুধু মূল্যবোধের অবক্ষয় দেখতে পাই। হিংসা, বিদ্বেষ, একে অপরকে হেয় প্রতিপন্ন করা, গুণী মানুষদের অবজ্ঞা করা, কি না হচ্ছে আমাদের চারপাশে। আমার মতে, এর সমাধান একটাই। ছোট থেকে বাচ্চাদের মূল্যবোধের চর্চা করা। ৬ থেকে ১২ বছর বয়স হচ্ছে বাচ্চাদের মূল্যবোধ তৈরির শ্রেষ্ঠ সময়। এই সময়টাতে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার পাশাপাশি পিতা-মাতারা যদি সন্তানদেরকে মূল্যবোধের চর্চা করতে শেখায়, তাহলে হয়তো আগামী ২০ বছরের মধ্যে আমরা এক নতুন বাংলাদেশ দেখতে পাবো। সেজন্যই আমাদের এই ক্ষুদ্র উদ্যোগের নাম ‘মূল্যবোধের পাঠশালা’। যেখানে আমরা চেষ্টা করছি সমাজের সকল পজিটিভ চিন্তা-ভাবনার মানুষদের কাছ থেকে আলোচনার মাধ্যমে মূল্যবোধের সব ভালো অভ্যাসগুলো জানা এবং এই উদ্যোগের মাধ্যমে সকলকে অবহিত করা। এর ফলে শিশু, তরুণ-তরুণী কিংবা পিতা-মাতারা প্রত্যেকেই অনুপ্রাণিত হবেন পজিটিভ চিন্তাভাবনা করার।
আমদের লক্ষ্য হচ্ছে, জেনারেশন এক্স ও জেনারেশন ওয়াই-কে সচেতন করা যাতে তারা জেনারেশন জেড ও আলফা-কে সঠিক মূল্যবোধের শিক্ষায় আলোকিত করতে পারেন।
ক্যানভাস: বাংলাদেশে অনেক শিশু-কিশোর, তরুণ-তরুণী ও পিতামাতা এখনও ইন্টারনেট সুবিধার বাইরে। তারা কীভাবে মূল্যবোধের পাঠশালার মাধ্যমে উপকৃত হবে?
শুভাশীষ: খুবই ভালো প্রশ্ন। আমি ইতিমধ্যে মূল্যবোধের পাঠশালার প্রতিটি পর্বের অলোচনাগুলো নিয়ে বই লেখার কাজ শুরু করেছি। পাশাপাশি বাপকা বেটা, পেন্সিল ফাউন্ডেশনের সঙ্গে যুক্ত হয়ে দেশের প্রান্তিক পর্যায়ে লাইব্রেরি বসানোর কাজ করছে। ইতিমধ্যে রাজশাহীর তানোর উপজেলার ৭৫ টি স্কুলে লাইব্রেরি এবং বই প্রদান কর্মসূচিতে আমরা যুক্ত ছিলাম।
আমি মনে করি পর্যায়ক্রমে মূল্যবোধের পাঠশালা নিয়ে লেখা বইটি আমরা পরবর্তীতে সেই লাইব্রেরিগুলোতে পৌঁছে দিতে পারব এবং এর মাধ্যমে প্রান্তিক পর্যায়ের শিশু-কিশোর, তরুণ-তরুণী এবং পিতা-মাতারা উপকৃত হবেন।
ক্যানভাস: পথশিশু ও ভিন্নভাবে সক্ষম শিশুদের মুল্যবোধ নির্মাণে আপনারা কোনো কাজ করছেন কী?
শুভাশীষ: সত্যি বলতে এখনো এই সেক্টর নিয়ে আমাদের কাজ করা হয়নি। আমি বিশ্বাস করি, পরিবর্তন কিছু মানুষের মধ্যে আনতে পারলে পর্যায়ক্রমে সব মানুষের মধ্যেই আনা সম্ভব।
তবে, আপনার এই প্রশ্নের মাধ্যমে ভালো একটা চিন্তার উদ্রেক হলো। অবশ্যই পথশিশু ও ভিন্নভাবে সক্ষম শিশুদের নিয়ে বিভিন্ন ক্যাম্পেইন করা যেতে পারে, যার মাধ্যমে তাদেরকেও একই কাতারে নিয়ে আসা যাবে।
ক্যানভাস: এ পর্যন্ত মূল্যবোধের পাঠশালায় কারা কারা অতিথি হয়ে এসেছেন? মিডিয়া পার্টনার কিংবা পার্টনার হিসেবে কাদেরকে পাশে পেয়েছেন?
শুভাশীষ: ইতিমধ্যে মূল্যবোধের পাঠশালার ৪ টি পর্ব অনুষ্ঠিত হয় । আমরা প্রতি পর্বে একটি করে মূল্যবোধ নিয়ে আলোচনা করি এবং চেষ্টা করি ওই মূল্যবোধের সাথে সম্পর্কিত দুজন অতিথিকে আমন্ত্রণ জানানোর। যেমন: পর্ব ১-এ ছিল ‘অন্যের প্রশংসা করা কি খুব কঠিন?’ তাতে উপস্থিত ছিলেন আয়মান সাদিক এবং সেজুতি সাহা। দ্বিতীয় পর্ব ছিল ‘অন্যের সাফল্য কি আপনাকে আনন্দ দেয়?’ বিষয়ক। সেখানে ছিলেন মুনজারিন শহীদ ও তাজদিন হাসান। তৃতীয় পর্বটি হয়েছে ‘শৃঙ্খলা-সুস্থতায় আমরা কি সচেতন?’ বিষয়ে। এসেছিলেন শাহরিয়ার নাফিস এবং ডা. সাকলায়েন রাসেল। চতুর্থ পর্ব ছিল ‘মানুষের বিশ্বাসের মূল্য কি আমরা সঠিকভাবে দিতে পারি?’ প্রসঙ্গে। তাতে ছিলেন গোলাম মোর্শেদ ও ডন সামদানী।
আমরা খুব সৌভাগ্যবান যে অনুষ্ঠানটির প্রচার সহযোগী হিসেবে আমরা পাশে পেন্সিল ফাউন্ডেশনকে পেয়েছি এবং অনুষ্ঠানটির দ্বিতীয় পর্ব থেকেই দি ডেইলি স্টার আমাদের মিডিয়া পার্টনার হিসেবে পাশে আছে।
ক্যানভাস: ২০ বছর পর আপনি একটি নতুন বাংলাদেশ দেখতে চেয়েছেন। কেমন হবে সেই বাংলাদেশ?
শুভাশীষ: আসলে আমি এমন বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখি যে বাংলাদেশে একে অন্যের বিশ্বাসের মর্যাদা রাখবে, সম্পর্কের মূল্য দেবে, একে অন্যের সাফল্যের প্রশংসা করবে, সবাই সহনশীল ব্যবহার করবে, থাকবে না কোনো সাইবার বুলিং, নারীরা তাদের প্রাপ্য সম্মান বুঝে পাবেন, যেখানে শুধু উন্নয়নের কথা হবে, অন্যের সাফল্যে কেউ ঈর্ষান্বিত হবে না, থাকবে না কোন বিদ্বেষ ও হানাহানি।
ক্যানভাস: বাপকা বেটা ও মূল্যবোধের পাঠশালা নিয়ে আপনার পরবর্তি পদক্ষেপ কী?
শুভাশীষ: যদি সৃষ্টিকর্তা আমাকে সুস্থ রাখেন, তাহলে আমি আগামী ১০ বছর আমার সন্তানকে নিয়ে প্রতিবছর একটি করে সর্বমোট ১০টি প্রধান মূল্যবোধ নিয়ে কাজ করতে চাই। দেশ-বিদেশের বিভিন্ন জ্ঞানীগুণী মানুষদের থেকে ওই মূল্যবোধগুলো সম্পর্কে আরও জ্ঞান অর্জন করতে চাই এবং তা সবার মধ্যে বিলিয়ে দিতে চাই।
ক্যানভাস: এমন কোনো বার্তা আছে কি যেটি আপনি এই সাক্ষাৎকারটির মাধ্যমে মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে চান?
শুভাশীষ: আমার কাছে মনে হয় আমি যে স্বপ্ন দেখেছি তা বাস্তবায়ন করা সম্ভব, যদি আমরা প্রত্যেকে তার নিজ নিজ সন্তানের দায়িত্ব নেই। সবার কাছে আমার একটাই অনুরোধ, আমি আমার সন্তানের দায়িত্ব নিচ্ছি, আপনারা আপনাদের সন্তানের দায়িত্ব নিন। তাহলে সবাই মিলে স্বপ্নের বাংলাদেশ গড়তে আমাদের বেশিদিন অপেক্ষা করতে হবে না।