কাপড়ে প্রাকৃতিক রং এর ব্যবহার এবং কারুশিল্পী আন্দলনের অন্যতম পথিকৃৎ রুবী গজনবী আমাদের মাঝে আর নেই। গত ১৪ জানুয়ারি, শনিবার বিকেলে রাজধানী ঢাকার একটি হাসপাতালে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিলো ৮৮ বছর। প্রাকৃতিক রঙে তিনি রাঙিয়েছেন এই দেশকে। তাঁর স্মরণে সিটি আলোর সৌজন্যে ক্যানভাস আর্কাইভ থেকে একটি বিশেষ সাক্ষাৎকার।
রুবি গজনবী
নির্বাহী সদস্য, বাংলাদেশ জাতীয় কারুশিল্প পরিষদ
ক্যানভাস: ২০২০ সালের পরিবর্তিত সময়ে এসে মেয়েদের কর্মক্ষেত্রের পরিবেশ কেমন দেখছেন?
রুবি গজনবী: আমি মনে করি, বাংলাদেশে গার্মেন্টস ইন্ডাস্ট্রির অগ্রগতির সঙ্গে নারীর কর্মক্ষেত্র প্রসারের একটি গভীর সম্পর্ক রয়েছে। এর আগে প্রান্তিক মেয়েদের একটাই লক্ষ্য ছিল, কবে বিয়ে করে সংসারী হবো। এখন এই অবস্থার পরিবর্তন হয়েছে। স্বাবলম্বী হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তার জীবনযাত্রার মানে পরিবর্তন এসেছে। সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা বেড়েছে। আরও একটি জায়গায় মেয়েরা এগিয়েছে, শিক্ষা ক্ষেত্রে। বাবা-মায়েরা এখন মেয়েদেরও ভালোভাবে পড়ালেখা করাতে আগ্রহী। এর ফলে প্রথমত বাল্যবিবাহ কমে আসছে। এবং মেয়েরা লেখাপড়া করার সুবাদে নিজের ভালোটা বুঝতে শিখেছে। কাজ করার আগ্রহ এবং ইচ্ছা তৈরি হয়েছে। ভালোভাবে বাঁচার প্রবণতা তৈরি হয়েছে। সঙ্গে সঙ্গে তাদের কর্মক্ষেত্রের পরিধি বড় হয়েছে। আমাদের সময় দেখেছি নারীর কাজের ক্ষেত্র কম ছিল। হাতে গোনা কয়েকটি পেশা ছাড়া তাদের কাজের আর কোনো জায়গা ছিল না। আমাদের সমাজ পুরোপুরি না হলেও কিছু কিছু ক্ষেত্রে এই জায়গা থেকে বেরিয়ে আসতে পেরেছে।
ক্যানভাস: সফলতা অর্জনের ক্ষেত্রে এখনো মেয়েদের কী ধরনের বাধার সম্মুখীন হতে হয় বলে আপনি মনে করেন?
রুবি গজনবী: আমাদের দেশে নারীর জন্য সবচেয়ে বড় বাধা হচ্ছে নির্যাতন। প্রতিনিয়ত আমরা দেখছি নানাভাবে তারা এর শিকার। শুধু শারীরিক নয়, মানসিক নির্যাতনও রয়েছে। এর ফলে তাদের মধ্যে ভয়ের সঞ্চার হয়েছে। এই ভয় আরও বেড়ে যাচ্ছে যখন দেখছে, তারা সঠিক বিচার পাচ্ছে না। এভাবে তো খুব বেশি দূর এগোনো যায় না। অনেকে বলবে, এখন নারী নির্যাতন আইন রয়েছে। কিন্তু এই আইন কতটা কার্যকর, সে প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে। কেননা এতে কোনোভাবেই নির্যাতনের হার কমানো যাচ্ছে না। সামাজিক বৈষম্যগুলো দূর করতে রাষ্ট্র খুব বেশি কার্যকর পদক্ষেপ নিতে পারছে না। এ ছাড়া অর্থনৈতিক দিক থেকেও নারীদের জন্য রয়েছে বেশ কিছু বাধা। যেমন উদ্যোক্তাদের ক্ষেত্রে জামানত দিয়ে ব্যাংক থেকে ঋণ নিতে হয়। আমাদের দেশে মেয়েদের সম্পদের পরিমাণ এমনিতেই কম। সুতরাং তার পক্ষে মোটা অঙ্কের জামানত দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। সে ঋণ নিতে পারছে না, তার ব্যবসা বা উদ্যোগ মুখ থুবড়ে পড়ছে। শুধু পারিবারিক দিক থেকে আগের তুলনায় সাহায্য-সহযোগিতা বেড়েছে। মতপ্রকাশের স্বাধীনতা বেড়েছে। কিন্তু ঘর থেকে বাইরে এলেই বাধা। তারপরও বলব, মেয়েরা কিন্তু থেমে নেই। তারা চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করছে, পরিশ্রম করছে, নিজের পথ নিজেই তৈরি করছে।
ক্যানভাস: কাজের ক্ষেত্রে আপনাকে কী ধরনের প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি হতে হয়েছে? সেখান থেকে উত্তরণের পথ কী ছিল? এ ব্যাপারে আপনার অনুপ্রেরণা কী?
রুবি গজনবী: এককথায় বলতে গেলে পারিবারিকভাবে আমাকে কোনো ধরনের বাধার সম্মুখীন হতে হয়নি। বাবা-মা, ভাই-বোন, বন্ধু-বান্ধব সবাই উৎসাহ দিয়েছেন। কিছুটা প্রতিবন্ধকতা এসেছে যখন ব্যবসাটা বড় করতে গিয়েছি। আগেই বলেছি, নারী উদ্যোক্তাদের ঋণ পাওয়া কখনোই খুব একটা সহজ ছিল না। আমিও পাইনি। কিন্তু থেমে থাকিনি। নিজের স্বপ্নপূরণে এগিয়ে গিয়েছি। যখন দেখি একজন কারুশিল্পী নিজের ইচ্ছেমতো কাজের সুযোগ পাচ্ছে, খুবই আনন্দ পাই। অনুপ্রাণিত হই। থেমে থাকলে চলবে না, এগিয়ে যেতে হবে।
ক্যানভাস: কর্মক্ষেত্রে প্রবেশের আগে নারীদের কী ধরনের প্রস্তুতি নেওয়া প্রয়োজন বলে আপনি মনে করেন?
রুবি গজনবী: স্বপ্ন দেখা থামানো যাবে না। স্বপ্ন দেখতে হবে আর চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে। কেউ না কেউ তো হাত বাড়িয়ে দেবেই। না বাড়ালেও সমস্যা নেই। পরিশ্রম থাকলে সফলতা আসবেই। আমি দেখেছি তরুণেরা অনেক বেশি সম্ভাবনাময়। যেমন কিছুদিন আগে বাংলাদেশে কারুশিল্প পরিষদ একটি জামদানি উৎসব করেছে। সেখানে বহু পুরোনো নকশার শাড়ি নতুনভাবে তৈরি করা হয়েছে। এই কাজগুলো কিন্তু করেছে তরুণ কারুশিল্পীরাই। তাদের কাজ দেখে আমরা মুগ্ধ। সুতরাং সব ক্ষেত্রেই তাদের দক্ষতা রয়েছে, প্রতিভা রয়েছে। শুধু একটু সুযোগ করে দিতে হবে। যাতে তারা তাদের পথটুকু পাড়ি দিতে পারে।