বর্তমানে ফাস্ট ফুডপ্রেমীদের প্রথম পছন্দ আলু দিয়ে তৈরি মোহনীয় স্বাদের ফ্রেঞ্চ ফ্রাই। নামের মধ্যে ফ্রেঞ্চ তথা ফরাসি শব্দ লুকিয়ে থাকলেও এর উৎপত্তি কিন্তু ফ্রান্সে নয়। ফ্রেঞ্চ ফ্রাইয়ের ক্রেডিট অনেকাংশেই ইউরোপে স্প্যানিশদের ওপর বর্তায়।
এ সোনালি অমৃত উৎপত্তির ইতিহাস আছে দু্ই রকমের। সঠিক উৎপত্তি নিয়ে এখনো খাদ্যবিশারদেরা সন্দিহান। ফ্রেঞ্চ ফ্রাইয়ের উৎপত্তির পেছনে লুকিয়ে আছে স্প্যানিশ জিমেনেজ দে কুয়েসেডার কলম্বিয়া সফর, ফ্রান্সের সেনাবাহিনীর ডাক্তার অ্যান্টনি অগাস্টিনের আলু ভোজসভা, ১৭ দশকে বেলজিয়ামে মাছের অভাব এবং ১৭৮৫ সালে দুর্ভিক্ষের ১০ বছর পর ফ্রান্সে আলুর বাম্পার ফলনের ইতিহাস।
ফ্রেঞ্চ ফ্রাইয়ের বিবর্তন বর্ণনা করতে গেলে মোটামুটি ১৫৩৭ সাল থেকে শুরু করতে হবে। ওই বছর স্প্যানিশ নাগরিক জিমেনেজ দে কুয়েসেডা তার স্প্যানিশ দল নিয়ে কলম্বিয়া সফরে বের হয়েছিলেন। সেখানে একটি গ্রামে তিনি ভিন্ন ধরনের এক জাতের আলুর সন্ধান পান। আলুগুলো দেখতে অনেক বড় ও হৃষ্টপুষ্ট ছিল। তারা ওই আলুর নাম দিয়েছিল ‘ট্রাফলস’। এ শব্দের বাংলা করলে দাঁড়ায় ‘ভিন্ন গন্ধের ছত্রাক’।
জিমেনেস দে কুয়েসেডার কলম্বিয়া ভ্রমণের প্রায় ২০ বছর পর স্পেনে ‘ট্রাফলস’ আলু চাষ শুরু হয়। একই সময়ে ইতালিতেও শুরু হয় চাষাবাদ। কিন্তু ইতালিয়ানরা সফলতার মুখ দেখেনি। তাদের আলুগুলো ছোট আকৃতির ও তেতো স্বাদের হওয়া শুরু করলো, যা দ্বারা ফ্রেঞ্চ ফ্রাই চাষ তৈরি করা সম্ভব ছিল না। ধীরে ধীরে তারা তাদের চাষ পদ্ধতি পরিবর্তনের মাধ্যমে আলুর তিক্ততা কমিয়ে আনে। এরপর বেলজিয়ামে আলুর চাষ শুরু হয়। অর্থাৎ, যারা মনে করেন যে বেলজিয়ামই ফ্রেঞ্চ ফ্রাইয়ের উৎপাদক, তারা হয়তো ভুলই ভাবছেন।
বেলজিয়ামে হয়তো ফ্রেঞ্চ ফ্রাইয়ের প্রচলন হতো না যদি না তাদের দেশে মাছের আকাল পড়ত। বেলজিয়ানরা পাতলা করে মাছ কেটে তা ভেজে খেত। পর্যাপ্ত মাছ না পাওয়ায় তারা আলুর দিকে ঝোঁকে এবং মাছের আদলেই পাতলা করে আলু কেটে খাওয়া শুরু করে তারা। কেননা, মাছ ধরার চেয়ে আলু চাষ সহজ হয়ে পড়েছিল তখন। তারা এভাবে আলু কেটে খাওয়া শুরু করেছিল ১৭ শতকে কিংবা ১৮ শতকের শেষের দিকে। ফ্রেঞ্চ ফ্রাই উৎপত্তির প্রথম ইতিহাসটা এ রকমই। এবার আসা যাক দ্বিতীয় ইতিহাসে।
ফ্রান্সে আলুর জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি করেছিলেন সে দেশের সেনাবাহিনীর ডাক্তার অ্যান্টনি অগাস্টিন পারমেনতিয়ার। ১৭৭২ সালের আগে তিনি সেনাদের মধ্যে আলু খাওয়ার প্রচলন করেন বলে জানা যায়। তার আগে ফ্রেঞ্চরা আলু খাওয়ার কথা ভেবে দেখেনি। ১৭৭২ সালে প্যারিসের মেডিকেল বিভাগ জানায় যে আলু খেলে কোনো সমস্যা হয় না। এ ঘোষণার পর অ্যান্টনি পারমেনতিয়ার আলু চাষ করার অনুমতি দেওয়া হয়ে যায়। আলু চাষকে অনুমোদিত করার জন্য তিনি একটি ভোজসভার আয়োজন করেছিলেন। সেখানে তিনি বেনজামিন ফ্রাঙ্কলিন, অ্যান্টনি ল্যাভয়সিয়ের, রাজা ষোড়শ লুই এবং রানি মেরি অ্যান্টনেটকে দাওয়াত করেছিলেন। এরপর তিনি আলুর চাষ শুরু করেন এবং আলুখেতে পাহারাদার নিযুক্ত করেন। তবে পাহারাদারকে তিনি নির্দেশ দিয়েছিলেন, কেউ যদি ঘুষ দিয়ে আলু চুরি করতে চায়, তাহলে যেন তারা ঘুষ নিয়ে চোরকে চুরি করার সুযোগ দেয়। এভাবে ফ্রান্সে আলু অতি জনপ্রিয় হয়ে ওঠে।
১৭৮৫ সালে ফ্রান্সে আলুর দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়। কিন্তু তার ১০ বছর পর অর্থাৎ, ১৭৯৫ সালে ফ্রান্সে প্রচুর পরিমাণে আলু চাষ শুরু হয়। সেই সময় ফ্রেঞ্চরা আলু চিকন করে কেটে ভাজতে শুরু করে। চিকন করে কাটা আলুভাজার নাম ছিল ‘ফ্রিটস’। এ শব্দের বাংলা ‘ফরাসি ভাজা’।
এবার আসা যাক আলু ভাজার নাম কীভাবে ফ্রেঞ্চ ফ্রাই হলো।
১৮০১ সালে থমাস জেফারসন ফরাসি বাবুর্চি অনারে জুলিয়েনের সঙ্গে পরিচিত হন। তিনি আলু ভেজে এক প্রকার খাদ্য তৈরি করেন। এর রেসিপি ছিল এমন, প্রথমে ছোট করে কাটা আলু লবণে ডুবিয়ে নরম করে নিতে হবে। তারপর কাটা আলু ডুবো তেলে ভাজতে হবে। সেই থেকে এর নাম ‘ফ্রেঞ্চ ফ্রাই’ হয়েছে বলে অনেকে ধারণা করেন।
১৯৩০ সাল পর্যন্ত মার্কিনরা ফ্রেঞ্চ ফ্রাইয়ের কোনো নাম দেয়নি। পরবর্তী সময়ে তারা আলু দিয়ে তৈরি এই খাবারকে ‘ফ্রেঞ্চ ফ্রাই’ নাম দেয়।