ফুডচেইন I মিশুয়ে বরফ-মালাই
মিশুয়ে আইসক্রিম অ্যান্ড টি। আইসক্রিম ও আইসড টি স্টোরের চীনা ফ্র্যাঞ্চাইজি। গেল শতাব্দীর শেষ দিকে যাত্রা শুরু। দ্রুত ঘটেছে বিস্তার। দুনিয়াজুড়ে সাড়ে বাইশ হাজারের বেশি স্টোর নিয়ে
প্রতিটি দেশে জাতীয় অর্থনীতির বিকাশ ত্বরান্বিত হলে এর প্রভাব পড়ে দৈনন্দিন খাদ্য ও পোশাকে। জীবনযাত্রার মানের দিকে মনোযোগ দিতে এবং জীবনের উচ্চতর প্রয়োজনীয়তা অনুসরণ করতে শুরু করেন নাগরিকেরা। দুধ-চা শিল্পের জন্ম এর প্রভাবেই। দুধ-চায়ের বাজারে ক্রমবর্ধমান জনপ্রিয়তার সঙ্গে প্রতিযোগিতা ক্রমেই তীব্র হচ্ছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে মিশুয়ে আইসক্রিম অ্যান্ড টি একটি প্রবল জনপ্রিয় ব্র্যান্ড হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে; তবে তাদের ঘাড়ে অনিবার্যভাবে নিশ্বাস ফেলছে অন্টিয়া জেনি, চাবাইদাও, হেইটির মতো ব্র্যান্ডগুলো। অবশ্য প্রাথমিক অবস্থায় কম প্রাইজ লেভেল, উচ্চ ব্র্যান্ড হোমোজিনাইজেশন এবং কম মিডিয়া সুবিধা ব্যবহার করতে পারার মতো কিছু বিষয়ের সম্মুখীন হয়েছিল ফুড চেইনটি। এসব সমস্যা ধীরে ধীরে মিশুয়ে আইসক্রিম অ্যান্ড টির সুবিধাকে দুর্বল করে দিয়েছিল। এই প্রেক্ষাপটে গবেষণার প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করে কর্তৃপক্ষ। ফলে তারা শরণাপন্ন হয় বিভিন্ন বিশেষজ্ঞ ও পণ্ডিতদের; প্রাসঙ্গিক গবেষণা ও বাছাই করা বিষয় অনুসন্ধানের জন্য। বিদ্যমান বিভিন্ন বিষয় ও ব্র্যান্ড উপাত্তের তথ্য বিশ্লেষণের মাধ্যমে মিশুয়ে আইসক্রিম অ্যান্ড টি বিপণন পদ্ধতি গভীরভাবে বিশ্লেষণ করে।
প্রধানত কম দাম ও উচ্চমানের কারণে বিপুল গ্রাহককে আকৃষ্ট করতে পেরেছে এবং কয়েক বছরের মধ্যে দেশে-বিদেশে বেশ কয়েকটি অফলাইন চেইন স্টোর খুলেছে এই চীনা ফ্র্যাঞ্চাইজি। সব সময় আন্তর্জাতিক প্রভাব সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছে। ব্র্যান্ড ইমেজ হিসেবে ‘স্নো কিং’ এবং থিম সং হিসেবে ‘মিশুয়ে আইসক্রিম অ্যান্ড টি’ সফলভাবে ব্যবহার করার পর ব্র্যান্ড সচেতনতা বাড়তে থাকে এর। বিশেষ করে খরচের সামর্থ্য যাদের প্রাপ্তবয়স্কদের তুলনায় অনেক কম, সেই তরুণ শিক্ষার্থীরা ব্র্যান্ডটির প্রতি আকৃষ্ট হতে থাকে। মিশুয়ে আইসক্রিম অ্যান্ড টি বিষয়টি উপলব্ধি করে। এরপর থেকেই এটি প্রথম ও দ্বিতীয় সারির শহুরে স্কুলগুলোর কাছাকাছি দৃশ্যমান হয়ে ওঠে। বিষয়বস্তু বাছাই এবং শেখার জন্য প্রাসঙ্গিক সাহিত্য ও উপকরণ থেকে এই ব্র্যান্ড নিজেদের বর্তমান পরিস্থিতি ও সমস্যাগুলো বিশ্লেষণ ও অধ্যয়ন করতে থাকে।
যাত্রা শুরুর গল্পটা ১৯৯৭ সালের জুন মাসের। চীনের হেনান ইউনিভার্সিটি অব ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইকোনমিকসের ছাত্র ঝাং হংচাও তার পরিবারের আর্থিক ভার হালকা করার জন্য একটি ঠান্ডা পানীয় কিয়স্কে খণ্ডকালীন গিগের সন্ধানে ছিলেন। কিয়স্কে কাজ করার সময় তিনি নিজের ব্যবসা শুরু করার অনুপ্রেরণা পান। দাদির কাছ থেকে ঋণ নিয়ে নিজ শহর, হেনান প্রদেশের রাজধানী ঝেংঝোতে একটি শেভড আইসের স্টল খোলেন। সেখানে বিভিন্ন ধরনের শেভড আইস, আইসক্রিম, স্মুদি বিক্রি করেন। পরে মেনুতে যোগ করেন পার্ল মিল্ক টি। তার ব্যবসাযাত্রা সহজ ছিল না। বাধার মুখে পড়েন প্রচুর। একসময় প্রথম দোকানটি বন্ধ করে দেন। তাই বলে স্বপ্ন ছোঁয়ার হাল ছাড়েননি। ১৯৯৯ সালে দ্বিতীয় আইস স্টল খুলে বসেন ঝাং। নাম রাখেন মিশুয়ে বিংচেন; সহজ অর্থে ‘মিষ্টি তুষার প্রাসাদ’। চায়ের পাশাপাশি আইসক্রিমের দিকেও মনোযোগ দেন তিনি। কেননা, ২০০৬ সাল থেকে ঝেংঝোতে সফট-সার্ভ ট্রিট জনপ্রিয়তা লাভ করে এবং এর ফলে আইসক্রিমের দাম বেড়ে যায়। আইসক্রিমকে আরও সাশ্রয়ী করতে রেসিপির সংস্কার করে নেন ঝাং। অনুরূপ পণ্যের তুলনায় প্রায় ২০ শতাংশ কম দামে অফার করেন।
চা ও আইসক্রিম বিক্রিতে তার সাফল্য ২০০৮ সালে ফ্র্যাঞ্চাইজিংয়ে উদ্যোগী হতে প্ররোচিত করে। ২০১০ সালের পর থেকে চীনের অন্যান্য অঞ্চলে নিজের ফ্র্যাঞ্চাইজি স্কিম প্রসারিত করতে থাকে মিশুয়ে। হেনানের বিভিন্ন এলাকায় কোম্পানিটির গবেষণা ও উন্নয়ন কেন্দ্র রয়েছে। সেই সঙ্গে উৎপাদন খরচ নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য রয়েছে গুদামজাতকরণ ও সরবরাহ কেন্দ্র। ঝাং হংচাও ও তার দলের নিষ্ঠা ও কঠোর পরিশ্রমের জন্য মিশুয়ের চা ও আইসক্রিম ব্যবসা ক্রমাগত সাফল্যের সঙ্গে বিস্তার লাভ করছে।
যদিও একটি সুপরিচিত চা ও আইসক্রিম ব্র্যান্ডে পরিণত হয়েছে, তবু অনেকে এখনো ‘মিশুয়ে’ শব্দের আসল অর্থ জানেন না। মজার বিষয় হলো, শব্দটি ম্যান্ডারিন ভাষা থেকে অনুপ্রাণিত এবং এর একটি গভীর ও অনন্য অর্থ রয়েছে। ম্যান্ডারিন ভাষার ‘ফেং মি’ ও ‘তিয়াং মি’ শব্দ দুটির অর্থ ‘মধু’; এখান থেকেই ‘মি’ আসা। অন্যদিকে ‘শুয়ে’ অর্থ ‘তুষার’। একসঙ্গে করলে ‘মিশুয়ে’র সরল অর্থ দাঁড়ায় ‘মধুর মতো মিষ্টি তুষার’।
মিশুয়ে নামের অনন্য অর্থ গ্রাহকদের জ্ঞানের পরিধিকে আকৃষ্ট করে, আবার উদ্যোক্তাদের জন্য অনুপ্রেরণামূলক গল্পও বটে। এর অর্থ থেকে প্রেরণা নিয়ে মিশুয়ের প্রতিষ্ঠাতা ঝাং হংচাও একটি অনন্য মিষ্টি স্বাদের বিভিন্ন ধরনের আইসক্রিম ও রিফ্রেশিং পানীয় তৈরি করেছেন। কিন্তু সেটি করেই তিনি থেমে যাননি। মিশুয়ে ভোক্তাদের জন্য সাশ্রয়ী মূল্যের আইসক্রিম ও চায়ের একটি বিস্তৃত পরিসর গড়ে দিয়েছেন। ব্র্যান্ডটির আইসক্রিম ও চা বিক্রির সাফল্য ঝাংকে নিজ দেশে ফ্র্যাঞ্চাইজিংয়ের মাধ্যমে ব্যবসা প্রসার করার প্রেরণা জোগায়। মিশুয়ে শুধু সুস্বাদু ও সাশ্রয়ী মূল্যের পণ্যের জন্যই নয়, বিপণনে সৃজনশীলতার জন্যও পরিচিত। ব্র্যান্ডটি মিউজিক ভিডিও প্রকাশের পাশপাশি ‘স্নো কিং’ নামে একটি মাসকট প্রবর্তন করেছে, যেটি পরবর্তীকালে এর প্রতিটি দোকানে একটি স্যুভেনির হয়ে উঠেছে। মিশুয়ের উদ্ভাবন অব্যাহত রাখা এবং আইসক্রিম শিল্পে ব্র্যান্ডটির প্রসার ঘটানোর প্রচেষ্টারই বহিঃপ্রকাশ এটি।
এর মধ্যে ২০১২ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় হেনান ডগা ফুড কোম্পানি লিমিটেড। এর পাশাপাশি মিশুয়ে আইস ক্রিম অ্যান্ড টি কোম্পানি লিমিটেড এবং আরঅ্যান্ডডি প্রোডাকশন—এই তিন কোম্পানির যৌথ ব্যবস্থাপনায় পরিচালিত হয় ফুড চেইনটি। স্টোরেজ ও লজিস্টিক সার্ভিস জোগায় শাংদাও ইন্টেলিজেন্ট সাপ্লাই চেইন কোম্পানি লিমিটেড। সে সময় মিশুয়ে আইসক্রিম অ্যান্ড টি মূল কাঁচামাল নিজেরাই উৎপাদন করার প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করে। শুধু তা-ই নয়, এরা বেশ কিছু পেটেন্ট প্রযুক্তি যোগ করে।
২০১৪ সালে বাস্তবায়িত হয় মিশুয়ে আইসক্রিম অ্যান্ড টি লজিস্টিক পার্ক। সেই মুহূর্তে ব্র্যান্ডটির স্টোর সারা চীনে ছড়িয়ে পড়ে। ২০১৮ সালের ৫ সেপ্টেম্বর ভিয়েতনামের হ্যানয় শহরে খোলে প্রথম বিদেশি স্টোর। পরের বছরের ২৪-২৬ মে ব্র্যান্ডটির উদ্যোগে প্রথম আইসক্রিম মিউজিক ফেস্টিভ্যাল অনুষ্ঠিত হয় ঝেংঝোয়ের ওপালালা ওয়াটার পার্কে। তাতে যোগ দেন ত্রিশ হাজারের বেশি দর্শক। ভোজনরসিকেরা সেখানে পানাহারে লাভ করেন দারুণ অভিজ্ঞতা। ২০২৩ সালের ৩০ এপ্রিল থেকে ১ মে পর্যন্ত চীনের হুবেই প্রদেশের উহানের মায়ান বিচ ওয়াটার পার্কে মিশুয়ে আইসক্রিম অ্যান্ড টি আয়োজন করে আইসক্রিম উৎসব।
এদিকে, ২০২০ সালের ২৪ জুন ফুড চেইনটি ব্যাপক প্রচারণার মাধ্যমে ১০ হাজারতম স্টোরটি খোলে হেনানের ইউয়ানয়াং কাউন্টিতে। সে বছরই ইন্দোনেশিয়ার বান্দুংয়ের সিহামপেলাস ওয়াকে খোলে স্টোর। এর দুই বছরের মধ্যে সেনজেন স্টক এক্সচেঞ্জে সর্বজনীন হওয়ার পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করে মিশুয়ে বিংচেন কোম্পানি লিমিটেড। ইতিমধ্যে মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড, কম্বোডিয়া, লাওস, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া ও মিয়ানমারের মতো এশীয় বেশ কিছু দেশে শতাধিক আউটলেট খুলেছে ব্র্যান্ডটি। অস্ট্রেলিয়ার সিডনিতে তাদের প্রথম স্টোর খুলেছে ২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে।
এর আগে, ২০২২ সালের এপ্রিলে করোনা অতিমারির প্রেক্ষাপটে আগের বছরের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত চালু থাকা সব ফ্র্যাঞ্চাইজির জন্য ২০০ মিলিয়ন চায়নিজ ইয়ান এক বছরের খরচ হিসাবে কমায় ফুড চেইনটি। তার ওপর, দোকানের ৫০ শতাংশের বেশি সামগ্রীসহ একটি ‘৫০%-এর বেশি উপাদান হ্রাস’ নীতি প্রবর্তন করা হয়, যাতে অন্তর্ভুক্ত ছিল উপাদান, প্যাকেজিং উপকরণ, ভোগ্যপণ্য ও যন্ত্রপাতি।
২০২২ সালে মিশুয়ে আইসক্রিম অ্যান্ড টি নিজ দেশি চা-চাষিদের কাছ থেকে ৯ হাজার টনের বেশি চা ক্রয় করে। এর ফলে ৫০ হাজারের বেশি চাষির আয়ক্ষমতা বাড়ে। ১১ হাজারের বেশি ফ্র্যাঞ্চাইজিকে নিজস্ব ব্যবসা শুরু করার জন্য একটি প্ল্যাটফর্ম প্রদান এবং সমগ্র শিল্পক্ষেত্রে ৫ লক্ষাধিক চাকরি তৈরির ব্যাপারে কাজ করতে থাকে তারা।
খাদ্য নিরাপত্তা, শিশুশ্রমের অবৈধ ব্যবহার, ইন্দোনেশিয়ায় হালাল সার্টিফিকেশনের মতো বিষয়ে কিছু বিতর্কের জন্ম দিলেও সামাজিক উন্নয়নে মিশুয়ে আইসক্রিম অ্যান্ড টি বেশ কাজ করে যাচ্ছে। এর মধ্যে ২০২০ সালের জানুয়ারিতে ঝেংঝো ক্রস-স্ট্রেইটস এন্টারপ্রাইজ ম্যানেজমেন্ট কোম্পানি লিমিটেড (মিশুয়ে আইসক্রিম অ্যান্ড টি) হেনান প্রাদেশিক চ্যারিটি ফেডারেশনকে ছয় মিলিয়ন চায়নিজ ইয়ান এবং ওয়েনজিয়ান রেড ক্রসকে এক মিলিয়ন চায়নিজ ইয়ান অনুদান দিয়েছে করোনা অতিমারি প্রতিরোধের জন্য। একই বছর ফল চাষিদের আয় তৈরি ও বৃদ্ধি করতে সহায়তা দিতে থাকে ফুড চেইনটি। ২০২১ সালের জুলাই মাসে হেনান প্রদেশে প্রচুর বৃষ্টিপাত হয়েছিল, যা এর ইতিহাসে বিরল। সেই সময় ঝেংঝো ও অন্যান্য অঞ্চল ভয়াবহ বন্যার কবলে পড়ে। বিপর্যয় কেন্দ্রে মিশুয়ে আইসক্রিম অ্যান্ড টির সদর দপ্তর সক্রিয়ভাবে উদ্ধার ও দুর্যোগ ত্রাণ কার্যক্রমে অংশ নেয়। এ সময়ে ঝেংঝো চ্যারিটি অ্যাসোসিয়েশনকে ২০ মিলিয়ন ইউয়ান অনুদান দেয় প্রতিষ্ঠানটি। এ ছাড়া হেনান প্রদেশের পাঁচটি বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথমবারের মতো সাড়ে ৬ মিলিয়ন চায়নিজ ইয়ান দিয়ে ‘মিশুয়ে আইসক্রিম অ্যান্ড টি স্কলারশিপ’ চালু করা হয়েছে।
এভাবে শুধু ব্যবসার বিস্তার নয়; সামাজিক ও সামগ্রিক উন্নয়নেও অবদান রাখছে এশিয়ান এই আইসক্রিম ও আইসড টি চেইনস্টোর।
ফুয়াদ রূহানী খান
ছবি: ইন্টারনেট