skip to Main Content

বিশেষ ফিচার I রানওয়েতে দেশের বিশ

দীর্ঘ ক্যারিয়ারে রানওয়ে দাপিয়ে বেড়িয়েছেন দৃপ্ত পায়ে। মডেলিংয়ের সোনালি অধ্যায়ের পরে কোরিওগ্রাফিতে দুর্দান্ত যাত্রা তার। এই ২০২৪ সালের মাঝামাঝি দাঁড়িয়ে তিনি পেছন ফিরে তাকিয়েছেন। ফেলে আসা বিশ বছরের ফ্যাশন মডেলিং জগতের গল্প বলেছেন। আলো ফেলেছেন সম্ভাবনাময় পথের অলিগলিতে। আজরা মাহমুদের সঙ্গে সেই বার্তা আলাপের বিস্তারিত

ইতিবাচক পরিবর্তন
বিশ বছর আগে বাংলাদেশের ফ্যাশন ব্র্যান্ডের সংখ্যার তুলনায় এখনকার বাজার অনেক বড়। ফ্যাশন মডেলিং যেহেতু সরাসরি ফ্যাশন লেবেলের সঙ্গে সম্পর্কিত, তাই একই সঙ্গে এই কাজেও ব্যাপ্তি বেড়েছে। আগের তুলনায় বেশি শো, বেশি ফটোশুটের সুযোগ তৈরি হচ্ছে। ফ্যাশন মডেলদের জন্য বিষয়টি ইতিবাচক। আবার মিডিয়া যেহেতু মডেলিংকে জনসাধারণের কাছে পৌঁছুতে সাহায্য করে, তাই মিডিয়ার কলেবর বৃদ্ধিও আশীর্বাদ। দেশে ফ্যাশন ম্যাগাজিনের সংখ্যা বেড়েছে। তৈরি হয়েছে ফ্যাশনকেন্দ্রিক ট্যাবলয়েড ও পোর্টাল। বেড়েছে ফ্যাশন মডেলকেন্দ্রিক কাজ। বর্তমানে মডেলিংকে পেশা হিসেবে তৈরির ক্ষেত্রে অবদান রাখছে এই মাধ্যমগুলো। ইলেকট্রনিক মিডিয়ার ভূমিকাও এ ক্ষেত্রে মনে রাখার মতো।
আন্তর্জাতিক মানদণ্ড
আন্তর্জাতিক ফ্যাশন মডেলিং ইন্ডাস্ট্রির সঙ্গে বাংলাদেশের তুলনা আসবেই। কারণ, প্রযুক্তি বর্তমান বিশ্বকে একটি গ্রামে পরিণত করেছে। বাংলাদেশে বসে প্রযুক্তির কল্যাণে আমরা আন্তর্জাতিক ফ্যাশন উইকের খুঁটিনাটি বিষয়ও জেনে যাচ্ছি। উপভোগ করছি বিভিন্ন দেশের ফ্যাশন শো। বিভিন্ন দেশের ফ্যাশন ডিজাইনারদের কাজের ধরন সম্পর্কে জানতে পারছি। চিনতে পারছি ইন্টারন্যাশনাল ফ্যাশন মডেলদের। এমন সময়ে নিজের দেশের সঙ্গে যৌক্তিক হিসাব মেলাতে গেলে বলতে হবে, বিশ্ব দরবারে নিজেদের তুলে ধরার পথে আমরা পা রেখেছি মাত্র। ধীর পদযাত্রা অপেক্ষা করাবে, তবে দিন শেষে দুর্দান্ত কিছুই উপহার হিসেবে নিয়ে আসবে বলে আশা রাখি। আমাদের দেশের বিভিন্ন সেক্টর এখন উন্নতির পথে হাঁটছে। ফ্যাশন মডেলিংও তার গতিপথ ধরে এগিয়ে চলেছে। এই পথ ধরে আলোর দেখা পাওয়ার আর খুব বেশি দেরি নেই বলেই মনে করি। এই দেশে একসময় তৈরি হবে বিশ্বমানের মডেল। বিশ্বব্যাপী ফ্যাশন শোগুলোর রানওয়ে জ্বলজ্বল করবে বাংলাদেশের উজ্জ্বল উপস্থিতিতে।
নতুনের আহ্বান
দুই দশকের বেশি সময়ের ক্যারিয়ারে বিভিন্ন প্রজন্মের সঙ্গে কাজ করেছি। ফলস্বরূপ বিভিন্ন বয়সের মানুষের মনস্তত্ত্ব, তাদের কাজ করার ধরন, ভাবনা, পরিকল্পনার হিসাব-নিকাশ সম্পর্কে বোঝার সুযোগ পেয়েছি। প্রতিটি প্রজন্মেরই রয়েছে কিছু স্বকীয়তা। আমার বয়সী অথবা বয়সে আরও বড়, তাদের মধ্যে মানিয়ে চলার একধরনের প্রবণতা রয়েছে। আপোস করার মানসিকতা অনেক সময় সাহসী উচ্চারণের ক্ষেত্রে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। কিন্তু বর্তমান সময়ের আলোচিত জেনারেশন-জেডদের মাঝে এই অভ্যাস কম। তারা জানেন, তাদের কাজের উদ্দেশ্য কী। দায়িত্ব সম্পর্কে সচেতন থাকেন। তাদের প্রকাশভঙ্গি স্পষ্ট। একই সঙ্গে তারা নিজেদের কাজের মূল্যায়ন যথাযথভাবে করতে জানেন; যা আমাকে আশাবাদী করে তুলেছে।
আমি দেখেছি, তারা সাহস করে এগিয়ে যেতে পারেন। হেরে যাওয়ার ভয়ে পিছপা হন না। নতুনকে স্বাগত জানাতে জানেন; যা তাদের দৃপ্ত পদক্ষেপকে উৎসাহ দেয়। ফ্যাশন মডেলিং ইন্ডাস্ট্রিতে জেন-জিদের ইতিমধ্যে যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হচ্ছে। যার মূলে আছে তাদের নিষ্ঠা। ইতোমধ্যে তারা নিজেদের স্ট্যান্ডার্ড সেট করতে পেরেছেন। তাই আমি তাদের নিয়ে দারুণ আশাবাদী।
বাংলাদেশে বসে বিশ্ব দরবারের আন্তর্জাতিক ফ্যাশন মডেলিংয়ের সঙ্গে নিজেদের তুলনা তখনই করা সম্ভব, যখন আমাদের কাছে সেই বিশাল পরিসরে কীভাবে কাজ হচ্ছে, সে সম্পর্কে পর্যাপ্ত ধারণা থাকবে। ইন্টারনেটের সাহায্য নিয়ে বিশ্বের যেকোনো ফ্যাশন শো কিংবা ফ্যাশন বাজার-সম্পর্কিত ইভেন্ট সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ সম্ভব হলেও কখনোই সেটা সরাসরি অভিজ্ঞতা গ্রহণের সমান নয়। তাই আমাদের মডেলদেরকে বাস্তব অভিজ্ঞতা লাভের সুযোগ করে দিতে হবে। জ্ঞান আহরণ তাদেরকে উপযুক্ত করে তুলবে। দক্ষতা বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখবে।
বিশ্বমানের মডেল হিসেবে কাজের প্রত্যয় নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছি আমরা। গন্তব্যের পথ যথেষ্ট বন্ধুর। তাই শুধু দীর্ঘদিনের সাধনাই আমাদের সাফল্য এনে দিতে পারে। তবে একই সঙ্গে একটি বিশেষ প্রতিবন্ধকতাও রয়েছে। ইন্টারন্যাশনাল ফ্যাশন ওয়ার্ল্ডে বাংলাদেশের মডেলদের আলাদা চাহিদা শুধু আউটলুক দিয়ে তৈরি করা সম্ভব নয়। কারণ, আমাদের চেহারার সঙ্গে পাশের দেশের মানুষের গঠনগত মিল প্রায় শতভাগ। একই সঙ্গে তাদের ইন্ডাস্ট্রি তুলনামূলক বড়। অভিজ্ঞতাও বেশি। আমাদের তুলনায় ব্যাপ্তি বেশি হওয়ার কারণে তাদের পরিচিতি ইতিমধ্যে তৈরি হয়েছে। সেখানে নিজেদের পাকাপোক্ত অবস্থান তৈরি করতে হলে আমাদের প্রফেশনালিজমের ক্ষেত্রে আপোসহীন হতে হবে। দেশ ছেড়ে বিদেশে কাজ করার তাগিদে শিক্ষা আর অভিজ্ঞতার জন্যও সাত সাগর পাড়ি দেওয়ার মানসিকতা তৈরি করতে হবে। প্রচুর শিখতে হবে। আর নিজেকে তৈরি করতে হবে।
আজরা মাহমুদ ট্যালেন্ট ক্যাম্প
ফ্যাশন মডেলিংকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করার জন্য অনেক বিষয়ে সম্যক জ্ঞান থাকা জরুরি বলে দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতায় আমার মনে হয়েছে। সেগুলো একটি আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলের মাধ্যমে যথাযথভাবে লাভ করা সম্ভব। আজরা মাহমুদ ট্যালেন্ট ক্যাম্প থেকে এ বিষয়ে উদ্যোগ গ্রহণ করা হচ্ছে। কোরিয়ার আয়োজনে এশিয়া মহাদেশের সবচেয়ে বড় মডেলিং কনটেস্ট আয়োজিত হয়। যার নাম এশিয়া মডেল ফেস্টিভ্যাল। এই অনুষ্ঠানের একটি অংশ ফেইস অব বাংলাদেশ। এই অংশের ন্যাশনাল ডিরেক্টর হিসেবে যুক্ত হয়েছি। এই আয়োজনে বাংলাদেশের অংশগ্রহণের ক্ষেত্র তৈরি করেছি। এখান থেকেই আমার আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের মডেলদের পৌঁছে দেওয়ার যাত্রা শুরু। তারপরে এর সঙ্গে যোগ হয়েছে মালয়েশিয়ান ট্যুরিজম মিনিস্ট্রির আয়োজন মিস অ্যান্ড মিস্টার সেলিব্রিটি ইন্টারন্যাশনাল। এ বছর এর সঙ্গে আরও যুক্ত হয়েছে মিস ইন্টারন্যাশনাল এবং মিস ইন্টারকন্টিনেন্টাল। বিশ্বমানের আয়োজনগুলোতে যদি প্রতিবছর দশজন করে মডেলকে নিয়ে যাওয়ার সুযোগ তৈরি করা যায়, তাহলে বছরে অন্তত পঞ্চাশজন মডেল পাওয়া যাবে, যাদের আন্তর্জাতিক মানের কাজের অভিজ্ঞতা আছে। সে পথেই এগিয়ে যাচ্ছে আজরা মাহমুদ ট্যালেন্ট ক্যাম্প।
প্রতিবন্ধকতা
একজন মডেলের ক্যারিয়ার হুট করে তৈরি হয় না। গতিপথ বন্ধুর, আর গতিও শ্লথ। একই সঙ্গে ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রির একজন মডেলের জীবনযাত্রা আর দশজন মানুষের চেয়ে বেশ ব্যয়বহুলও বটে। কারণ, যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে সাজপোশাক তাদের জন্য দরকারি। আর এই সুন্দর জামা, সুন্দর সাজগোজ—দুটোতেই বেশ ভালো খরচ করতে হয়। আমাদের দেশে পারিশ্রমিক তুলনামূলক কম হওয়ায় সব মডেলের পক্ষে নিজের আয়-ব্যয়ের হিসাব মেলানো সম্ভব হয় না। নিয়মিত ভালো আয় অন্য পেশার মতো এখানেও খুব জরুরি বিষয়। নিজের জীবনযাপনের ব্যয় নির্বাহের জন্য অন্য পেশাকে আপন করতে হলে তখন তাদের মেধা ও পরিশ্রম কাজে লাগানো বেশির ভাগ ক্ষেত্রে সম্ভব হয় না। বিশ বছর আগের তুলনায় এখনকার ফ্যাশন মডেল ইন্ডাস্ট্রি বেশ এগিয়েছে। তবে পারিশ্রমিক প্রদানে আরও বেশি নিয়মিত হলে মডেলদের জন্য কাজ করা স্বস্তিদায়ক হবে। একইভাবে পারিশ্রমিক নির্ধারণে বাস্তব দুনিয়ার সঙ্গে মিল রেখে হিসাব-নিকাশ জরুরি। একজন প্রফেশনাল মডেলের পারিশ্রমিক তার পরিশ্রমের উপযুক্ত হলে নতুনেরা যেমন আগ্রহী হবেন, তেমনি দীর্ঘদিন অভিজ্ঞতাসম্পন্ন মডেলদেরও পাওয়া যাবে। অন্য পেশা বেছে নেওয়ার প্রতি ঝোঁক কমবে তাদের।
আগামী ২০ বছর
সামনের দিনগুলো সম্ভাবনাময়। আমরা নিয়মিত পরিণত হচ্ছি। শিখছি, শেখাচ্ছি। সামনের ২০ বছরে এই চর্চা হয়তো আরও বাড়বে। আমরা আরও ভালো কাজ পাব বলে মনে করি। ফ্যাশন দ্রুত পরিবর্তনশীল। তাই ফ্যাশন মডেলদের আগামী ২০ বছরে আরও দুর্নিবার হতে হবে। যুগের সঙ্গে পা মিলিয়ে সাহসী পদক্ষেপও জরুরি। বিশ্বের ফ্যাশন, মডেলদের জীবনদর্শন, দিনযাপন সম্পর্কে নিয়মিত খোঁজ রাখা প্রয়োজন। কারণ, নিজেকে গড়ে তোলার জন্য শিক্ষা এবং তার যথাযথ প্রয়োগের বিকল্প নেই। এই যুগের জন্য প্রস্তুত হতে প্রতি মুহূর্তে সচেতনভাবে কাজ করে যেতে হবে।
প্রেরণা
ক্যারিয়ারের শুরু থেকে আজ অব্দি আমার প্রেরণা একটাই—ভালোবাসা। অনেক গুণী মানুষের ভালোবাসা পেয়েছি। একই সঙ্গে ফ্যাশন ডিজাইনার বিবি রাসেল, রীনা লতিফ, মাহিন খান, চন্দ্র শেখর সাহা আমাকে অনুপ্রাণিত করেছেন। কারণ, আমি দেখেছি, তারা নিঃস্বার্থভাবে কাজ করে যাচ্ছেন। তাদের প্রাপ্তির খাতা নিয়ে ভাবনা কম। দিয়েছেন উজাড় করে। আমিও সে পথে হাঁটতে চেয়েছি। নিজেকে সমৃদ্ধ করেছি অন্যের জন্য। মডেলিং ক্যারিয়ারের শুরুতে অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে খুঁজে বের করেছিলাম কৌশিকি নাসের তুপাকে। ফ্যাশন মডেল হওয়ার শুরুর পথ তিনিই বাতলে দিয়েছিলেন আমাকে। সেখান থেকে আজকের আমি। এখন নতুনদের মুখে শুনতে পাই, তথ্য-উপাত্ত যাচাই-বাছাই করে তারা আজরা মাহমুদ ট্যালেন্ট ক্যাম্পে যোগাযোগ করেন। এখানেই আমার উৎসাহ। আমি আস্থার জায়গা হতে পেরেছি। সামনের পথের প্রেরণা এখান থেকেই পাই।

 অনুলিখন: সারাহ্ দীনা
ছবি: সংগ্রহ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top