ফিচার I শুরুশেষের আদ্যোপান্ত
ফুটবল বিশ্বকাপ এবার অনুষ্ঠিত হচ্ছে রাশিয়ায়। ফিফা বিশ্বকাপ ফুটবলের একুশতম আয়োজনে বিশ্বমুকুট জয়ের লক্ষ্যে লড়বে ৩২টি দেশ। কোন কোন দেশ খেলছে, কার সঙ্গে কে খেলবে- এসব আলাপ পুরোনো হয়ে গেছে। কেননা, জুন মাসের ১৪ তারিখ যে বিশ্বকাপের উদ্বোধনী খেলা!
আধুনিক সময়ে বিশ্বকাপ ফুটবলের আয়োজনে উদ্বোধনী অনুষ্ঠান নিয়ে বেশ হইচই হয়ে থাকে। আয়োজক দেশটি সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য বিশ্বদরবারে তুলে ধরার জন্য এর চেয়ে বড় সুযোগ আর কী হতে পারে। রাশিয়া প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপ আয়োজনের সুয়োগ পেয়েছে এবার। পুরো বিশ্বকাপ তাই দৃষ্টিনন্দন ও সফল করতে তাদের চেষ্টার ত্রুটি নেই। ১৪ জুন রাশিয়ার লুঝনিকি স্টেডিয়ামে জমজমাট আয়োজনের মধ্য দিয়ে পর্দা উঠতে যাচ্ছে বিশ্বকাপের। প্রথম ম্যাচে মুখোমুখি হবে স্বাগতিক রাশিয়া ও সৌদি আরব। এই ম্যাচের ঘণ্টা দুয়েক আগে হবে বিশ্বকাপের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান। ৫০০ জন নৃত্যশিল্পী, জিমন্যাস্ট, ট্রাম্পোলোনিস্ট তাদের পারফর্ম পারফরম্যান্সের মাধ্যমে তুলে ধরবেন রাশান সংস্কৃতির নানা দিক। এ ছাড়া থাকবে আতশবাজির মহাপ্রদর্শনী।
ব্রাজিল বিশ্বকাপে উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে মঞ্চ মাতিয়েছিলেন জেনিফার লোপেজ ও পিট বুল। তার আগে দক্ষিণ আফ্রিকা মাতিয়েছিলেন শাকিরা। রাশিয়া বিশ্বকাপে সে রকম কোনো তারকা পারফরমার থাকছেন কি না, সেটা এখনো নিশ্চিত করেনি আয়োজক কর্তৃপক্ষ ও ফিফা। তবে অপেরা সিঙ্গার পাসিদো ডোমিঙ্গো, যিনি ‘ইটালিয়া ৯০’ গানটি গেয়েছেন, তিনি পারফর্ম করবেন বলে জানা গেছে। তার সঙ্গে থাকবেন লুসিয়ানো পাভারোত্তি, হোসে কারিরেস ও পেরুর হুয়ান দিয়াগো ফ্লোরেজ। রাশিয়ান পারফরমারদের মধ্যে থাকবেন পিয়ানিস্ট ডেনিস ম্যাটসুয়েভ, অপেরা স্টার অ্যানা নেতরেবকো, ইউসিফ এভাযোভ, এলদার আবদ্রাযাকভ, আইদা গারিফুল্লিনা ও আলবিনা শাগিমুরাতোভা।
বিশ্বকাপের মতো মহা আয়োজনের একটা বড় অংশজুড়ে রয়েছে থিম সং, যা সারা পৃথিবীতে আলোড়ন সৃষ্টি করে প্রতিবার। ফুটবল বিশ্বকাপের অফিশিয়াল থিম সংয়ের ধারণাটি চালু হয়েছিল ১৯৬২ সালে চিলিতে অনুষ্ঠিত বিশ্বকাপে। সেটি ছিল ‘এল রক দেল মুন্দিয়াল’। বিশ্বকাপ ইতিহাসের প্রথম অফিশিয়াল থিম সং এটি। সে সময়ের জনপ্রিয় ব্যান্ড ‘দ্য র্যাম্বলার্স’ গানটি তৈরি করে। ১৯৯০ সালে জিয়ানা নান্নিনি ও এদুয়ার্দো বেনেতোর ‘আনস্টেট ইতালিয়ানা’ শিরোনামের থিম সং বিশ্বকাপের জনপ্রিয় গানগুলোর মধ্যে তৃতীয় স্থানে রয়েছে। বিশ্বকাপ ফুটবলে থিম সং নিয়ে সবচেয়ে বেশি আলোড়ন সৃষ্টি করে ১৯৯৮ সালে। গতানুগতিক ধারা থেকে বেরিয়ে থিম সংয়ের জন্য বেছে নেওয়া হয় লাতিন গায়ক রিকি মার্টিনকে। পুয়ের্তোরিকান-স্প্যানিশ এই তারকার ‘কোপা দে লা ভিদা’ গানটি মুক্তির সঙ্গে সঙ্গেই মার্কিন মিউজিক চার্টের শীর্ষে চলে আসে। ‘কোপা দে লা ভিদা’ থেকে অনুপ্রাণিত হয়েই পরে শুরু হয় জনপ্রিয় ঘরানার থিম সংয়ের ধারা। ২০১৪ ব্রাজিল বিশ্বকাপের থিম সং গেয়েছিলেন পিটবুল ও জেনিফার লোপেজ। গানটির শিরোনাম ছিল ‘ওলে ওলে’। তার আগের বছর ২০১০ বিশ্বকাপের থিম সং ‘ওয়াকা ওয়াকা’ গেয়েছিলেন কলাম্বিয়ান তারকা শাকিরা।
এবার বিশ্বকাপ উপলক্ষে দুটি থিম সং তৈরি করা হয়েছে। অফিশিয়াল থিম সংটির নাম ‘লিভ ইট আপ’। ইতিমধ্যে গানটি মুক্তি দিয়েছে ফিফা। এবারের অফিশিয়াল থিম সংটিতে কণ্ঠ দিয়েছেন হলিউড অভিনেতা ও র্যাপার উইল স্মিথ, পুয়ের্তোরিকান সংগীতশিল্পী নিকি জ্যাম ও কসোভোর গায়িকা ইরা ইসত্রেফি। আর মিউজিক আয়োজন করছেন বিশ্বের অন্যতম সেরা ডিজে এবং গীতিকার ডিপলো। গানটির মিউজিক ভিডিও পাওয়া যাবে ৭ জুন থেকে। বিশ্বকাপ ফাইনালের দিন ১৫ জুলাই লুঝনিকি স্টেডিয়ামে বিশ্বকাপের থিম সং পরিবেশন করবেন এই তিন শিল্পী। আয়োজকেরা আশা করছেন, এ গানে আছে ঐক্য এবং উদারতার কথা; এ গানের সুর ও তালে একযোগে নাচবে সারা বিশ্ব। যদিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে গানটি নিয়ে শ্রোতাদের ইতিবাচক মতামতের চেয়ে নেতিবাচক মতামতই বেশি পাওয়া গেছে। এ ছাড়া বিশ্বকাপ সহযোগী হিসেবে কোমল পানীয় কোম্পানি ‘কোকা-কোলা’ প্রকাশ করেছে ‘কালার্স’ শিরোনামে আরও একটি গান। গানটি গেয়েছেন জেসন ডিরুলো ও র্যাপার মালুমা।
বিশ্বকাপের সমাপনী অনুষ্ঠান নিয়ে এখনো বিস্তারিত কিছুই জানা যায়নি। সমাপনী অনুষ্ঠানে উইল স্মিথ, নিকি জ্যাম ও ইরা ইসত্রেফির থিম সং পরিবেশন ছাড়া আর কোনো কিছুই এখনো প্রকাশিত হয়নি।
খেলাধুলাবিষয়ক প্রতিটি বড় আয়োজনে মাসকটের ব্যবহার বেশ জনপ্রিয়। বিশ্বকাপ ফুটবলে মাসকটের ব্যবহার প্রথম শুরু হয় ১৯৬৬ সালে, ইংল্যান্ড বিশ্বকাপে। মাসকট মূলত আয়োজক দেশের ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির মিশেলে এমন এক প্রতিকৃতি ওই বিশ্বকাপকে প্রতিনিধিত্ব করে থাকে। এবারের বিশ্বকাপে মাসকট হিসেবে নেকড়ে বাঘকে বেছে নিয়েছে রাশিয়া। এর নাম দেওয়া হয়েছে ‘জাবিভকা’। রাশিয়ান ভাষায় এর অর্থ ‘যে গোল করতে পারে’। রাশিয়া এই মাসকটটিকে ‘মনোহর, আত্মবিশ্বাসী ও সামাজিক’ বলে অভিহিত করেছে ‘যার স্বপ্ন ফুটবল তারকা হওয়া’। ২০১৬ সালে মাসব্যাপী অনলাইন ভোটিংয়ের মাধ্যমে বাছাইপ্রক্রিয়া সম্পন্ন করার পর জনগণের সামনে মাসকট হিসেবে নেকড়েকে চূড়ান্তের ঘোষণা আসে। রাশিয়া বিড়াল, বাঘ ও নেকড়ে- এই তিনটিকে মাসকট করার বিষয়ে জনগণের ভোট চায়। রাশিয়ার জনগণ নেকড়েকে ৫৩ শতাংশ, বিড়ালকে ২০ শতাংশ ও বাঘকে ২৭ শতাংশ ভোট দিয়ে নেকড়েকে বেছে নেয়। ভোটিং প্রক্রিয়ায় এক মিলিয়নের বেশি মানুষ অংশ নেন।
এ ছাড়া কয়েক বছর আগে অভিনব কায়দায় রাশিয়া ফুটবল বিশ্বকাপের লোগো উন্মোচন করা হয়। লোগো উšে§াচন করেন মহাকাশচারীরা। মস্কোর আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশন থেকে এই কা- ঘটায় রাশিয়া বিশ্বকাপের আয়োজক কমিটি। পরে এই লোগো উন্মোচন অনুষ্ঠান মস্কোর থিয়েটার বিল্ডিংয়েও নিয়ে যাওয়া হয়। সেখান থেকে সরাসরি তা সম্প্রচার করা হয় টেলিভিশনে।
২০১৮ সালের রাশিয়া বিশ্বকাপের উদ্বোধনী ও সমাপনী অনুষ্ঠান যে স্টেডিয়ামে অনুষ্ঠিত হবে, দর্শক ও পাঠকেরা ইতিমধ্যে জেনে গেছেন তার নাম। লুঝনিকি স্টেডিয়াম। স্টেডিয়ামটি শুধু রাশিয়ার নয়, পুরো ইউরোপের প্রধান বড় একটি স্টেডিয়াম। রাশিয়ার রাজধানী মস্কো শহরের সেন্ট্রাল অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের ওরুগের খামোভনিকি এলাকায় অবস্থিত। এর দর্শক ধারণক্ষমতা ৮১ হাজার ৬ জন। রাশিয়ার সুন্দরতম স্টেডিয়ামগুলোর এটি একটি। ২০১৮ বিশ্বকাপের এটি বৃহত্তম স্টেডিয়াম ও ইউরোপের অষ্টম বৃহত্তম স্টেডিয়াম হিসেবে স্বীকৃত। ১৯৫৫ সালে স্টেডিয়ামটির নির্মাণকাজ শুরু হয়। ১৯৫৬ সালের ৩১ জুলাই এটি উদ্বোধন করা হয়। এটি রাশিয়ার জাতীয় স্টেডিয়ামও বটে। রাশিয়া বিশ্বকাপের অংশ হিসেবে স্টেডিয়ামটি পুনর্নির্মিত ও সংস্কার করা হয়। স্টেডিয়ামটির ঐতিহাসিক স্থাপত্য মূল্যের কারণে এর মূল কাঠামোটি অক্ষত রাখা হয়। ২০১৩ সালে শুরু হয়ে ২০১৭ সালে শেষ হওয়া স্টেডিয়ামটির পুনর্র্নির্মাণ ও সংস্কারে ব্যয় হয় ৩৫০ মিলিয়ন ইউরো। ১৯৮০ সালের অলিম্পিক গেমসের প্রধান স্টেডিয়াম ছিল এটি। অলিম্পিক গেমসের উদ্বোধন ও সমাপনী অনুষ্ঠান এখানেই অনুষ্ঠিত হয়েছিল। মাইকেল জ্যাকসন, দ্য রোলিং স্টোনস, ম্যাডোনা, মেটালিকা, ইউ টু, রেড হট চিলি, মিরারের মতো শিল্পী ও ব্যান্ডদের কনসার্টের অন্যতম স্থান হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে লুঝনিকি। ১৯৮৯ সালের আগস্টে মস্কো মিউজিক শান্তি উৎসবও এখানে অনুষ্ঠিত হয়। ২০১২ সালের ১৪ ডিসেম্বর জাপানের টোকিওতে অনুষ্ঠিত ফিফা নির্বাহী কমিটির বৈঠকে উদ্বোধনী ও সমাপনী ভেন্যু হিসেবে এই স্টেডিয়াম নিশ্চিত করা হয়। লুঝনিকি স্টেডিয়ামে উদ্বোধনী ও সমাপনী খেলা ছাড়া আরও ৫টি ম্যাচ অনুষ্ঠিত হবে।
শুভ্র মিসির
ছবি: সংগ্রহ