skip to Main Content

তনুরাগ I আফটার ওয়াক্সিং

এ যেন একটা ত্বক সমস্যা সারাইয়ে গিয়ে আরেক বিপদ বাধানো। চিন্তার কারণ নেই, আছে সমাধানও। সে ক্ষেত্রে পূর্বপ্রস্তুতিটাই প্রধান

ওয়াক্সিং। নারী-পুরুষনির্বিশেষে দেহে অবাঞ্ছিত লোম দূর করার জনপ্রিয় পদ্ধতি। কার্যকারিতা, দ্রুত ফল এবং তুলনামূলক দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব যার প্রধান কারণ। তবে এই কার্যকরী পদ্ধতির উল্লেখযোগ্য পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হিসেবে অনেকে ত্বকে কালো দাগ বা হাইপারপিগমেন্টেশনের সমস্যায় ভোগেন; বিশেষ করে গ্রীষ্মপ্রধান দেশের আর চাপা রঙের অধিকারীদের মধ্যে এই সমস্যা প্রকটভাবে দেখা দেয়। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, প্রায় ৭০ শতাংশ নারী তাদের জীবনের কোনো না কোনো সময়ে ওয়াক্সিং-পরবর্তী কালো দাগের সমস্যার সম্মুখীন হন। তবে সঠিক জ্ঞান, সচেতনতা এবং নিয়মিত যত্নের মাধ্যমে এই সমস্যা সম্পূর্ণরূপে প্রতিরোধ করা, কিংবা অন্তত অনেকাংশে কমিয়ে আনা সম্ভব।
বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা
ডারমাটোলজির ভাষায় ওয়াক্সিং-পরবর্তী কালো দাগকে পোস্ট-ইনফ্লামেটরি হাইপারপিগমেন্টেশন বলা হয়। এটি জটিল জৈব রাসায়নিক প্রক্রিয়া, যা ত্বকের সুরক্ষাব্যবস্থার অংশ হিসেবে কাজ করে। যখন ওয়াক্সিংয়ের মাধ্যমে ত্বকে ক্ষত বা প্রদাহ সৃষ্টি হয়, তখন মেলানোসাইট কোষগুলো সাইটোকাইনস নামক বিশেষ প্রোটিন নিঃসরণ করে। এই সাইটোকাইনস একধরনের সিগন্যাল হিসেবে কাজ করে, যা মেলানোসাইট কোষগুলোকে সক্রিয় করে তোলে। সক্রিয় হওয়ার পর এই কোষগুলো অতিরিক্ত পরিমাণে মেলানিন উৎপাদন শুরু করে। এই অতিরিক্ত মেলানিন ত্বকের এপিডার্মিস স্তরে জমা হতে থাকে এবং ধীরে ধীরে তা দৃশ্যমান কালো দাগ হিসেবে প্রকাশ পায়। পুরো প্রক্রিয়া সম্পন্ন হতে সাধারণত কয়েক দিন থেকে কয়েক সপ্তাহ সময় লাগে।
ঝুঁকির কারণসমূহ
ত্বকের ধরন এই সমস্যার একটি মুখ্য নিয়ামক। ফিটজপ্যাট্রিক স্কেল অনুযায়ী টাইপ ৪ থেকে ৬ অর্থাৎ গাঢ় থেকে খুব গাঢ় ত্বকে মেলানিনের পরিমাণ স্বাভাবিকভাবে বেশি থাকে বলে হাইপারপিগমেন্টেশনের ঝুঁকি বেশি। লোমের গঠনও এখানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। যাদের লোম মোটা, ঘন এবং টার্মিনাল হেয়ার টাইপের, তাদের ক্ষেত্রে ওয়াক্সিংয়ের সময় বেশি টান পড়ে বলে ত্বকে পাওয়া আঘাতের পরিমাণ বেশি হয়। এ ছাড়া লোমের গঠন কার্লি হলে এবং ইনগ্রোন হেয়ারের প্রবণতা থাকলেও এই সমস্যা বেশি দেখা দেয়। এগুলো ছাড়াও ওয়াক্সিংয়ের পদ্ধতিগত ত্রুটি একটি বড় কারণ। অতিরিক্ত গরম ওয়াক্স ব্যবহার, ভুল দিকে টানা, একই স্থানে বারবার ওয়াক্স প্রয়োগ এবং অপরিচ্ছন্ন যন্ত্রপাতি ব্যবহার—এসবই ত্বকের জন্য ক্ষতিকর। এ ছাড়া হরমোনাল পরিবর্তন, বিশেষ কিছু ওষুধের ব্যবহার (যেমন জন্মনিয়ন্ত্রণ পিল) এবং ভিটামিন সি ও ই-এর ঘাটতিও এই সমস্যাকে ত্বরান্বিত করতে পারে।
প্রতিরোধের কৌশল
ওয়াক্সিং-পরবর্তী কালো দাগ প্রতিকারের চেয়ে প্রতিরোধে ব্যবস্থা নেওয়াই উত্তম। তাই প্রস্তুত থাকতে হবে ওয়াক্সিং করার আগে থেকেই। প্রতিটা ধাপে সময়মতো এবং সঠিক ব্যবস্থা নিলে সহজে এই সমস্যা থেকে পরিত্রাণ সম্ভব।
প্রস্তুতিমূলক ব্যবস্থা
সঠিক প্রস্তুতি কালো দাগ প্রতিরোধের প্রথম ধাপ। এক্সফোলিয়েশন এই প্রস্তুতির অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অংশ। ওয়াক্সিংয়ের ২৪ থেকে ৪৮ ঘণ্টা আগে ত্বক ভালোভাবে এক্সফোলিয়েট করা উচিত। এতে ত্বকের মৃতকোষ দূর হয় এবং লোমের গোড়া পরিষ্কার থাকে। ফলে ওয়াক্সিংয়ের সময় কম টান পড়ে। এক্সফোলিয়েশনের জন্য আলফা হাইড্রক্সি অ্যাসিড-সমৃদ্ধ প্রোডাক্ট বিশেষ উপকারী। গ্লাইকোলিক অ্যাসিড বা ল্যাকটিক অ্যাসিড (৫-১০%) সমৃদ্ধ লোশন ব্যবহার করা যেতে পারে। যাদের ইনগ্রোন হেয়ারের সমস্যা আছে, তাদের জন্য বিএইচএ (বিটা হাইড্রক্সি অ্যাসিড) যেমন স্যালিসাইলিক অ্যাসিড (২%) বেশি কার্যকর। প্রাকৃতিক বিকল্প হিসেবে চালের গুঁড়া এবং দুধ বা ওটমিল ও মধুর স্ক্রাবও ব্যবহার করা যায়।
ত্বকের হাইড্রেশনও সমান গুরুত্বপূর্ণ। ওয়াক্সিংয়ের আগের রাতে ত্বক ভালোভাবে ময়শ্চারাইজ করা উচিত। হায়ালুরনিক অ্যাসিড-সমৃদ্ধ সেরাম ব্যবহার করলে ত্বক পর্যাপ্ত আর্দ্রতা পায় এবং ওয়াক্সিংয়ের সময় কম জ্বালাপোড়া করে। এ ছাড়া ওয়াক্সিংয়ের অন্তত ১২ ঘণ্টা আগে থেকে ত্বকে কোনো ক্রিম বা লোশন ব্যবহার না করাই মঙ্গল। কারণ, এটি ওয়াক্সের কার্যকারিতা কমিয়ে দিতে পারে।
বিশেষ সতর্কতা
ওয়াক্সের ধরন বেছে নেওয়ার সময় সতর্কতা অবলম্বন জরুরি। সেনসিটিভ ত্বকের জন্য কোল্ড ওয়াক্স বা সুগারি ওয়াক্স সবচেয়ে ভালো বিকল্প। এগুলো ত্বকে কম জ্বালাপোড়া সৃষ্টি করে এবং তুলনামূলক কম আঘাত দেয়। ওয়াক্সের ধরনের মতোই একটা ভালো আর প্রফেশনাল স্যালন বেছে নেওয়া গুরুত্বপূর্ণ। একজন প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত থেরাপিস্টই জানেন, কীভাবে সঠিক কৌশলে ওয়াক্স করতে হয়, যাতে ত্বকে কম আঘাত লাগে। লোম যেদিকে বাড়ে, সেদিকে টানা উচিত; বিপরীত দিকে নয়। এ ছাড়া ওয়াক্সের তাপমাত্রাও গুরুত্বপূর্ণ। অত্যধিক গরম ওয়াক্স ত্বকে পোড়া ক্ষত সৃষ্টি করতে পারে, তাই ওয়াক্স ব্যবহারের আগে তা হাতের পিঠে পরীক্ষা করে নেওয়া শ্রেয়।
জরুরি যত্ন
ওয়াক্সিংয়ের পর প্রথম ২৪ ঘণ্টা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। এই সময়ে গরম পানি এড়িয়ে চলা জরুরি। এতে ত্বকের জ্বালাপোড়া বেড়ে যেতে পারে। সুগন্ধিমুক্ত, হাইপো-অ্যালার্জেনিক ময়শ্চারাইজার ব্যবহার করা ভালো। এই সময়ে সান এক্সপোজার সম্পূর্ণ এড়িয়ে চলা চাই। কারণ, ত্বক এই সময়ে অত্যধিক সংবেদনশীল থাকে। ৪৮ ঘণ্টা পর থেকে হালকা এক্সফোলিয়েশন শুরু করা যেতে পারে এবং এসপিএফ ৩০ যুক্ত সানস্ক্রিন বাধ্যতামূলকভাবে ব্যবহার করতে হবে। শুধু বাইরে যাওয়ার সময়ই নয়, ঘরেও ব্যবহার করা উচিত। কারণ, ইউভি রশ্মি জানালার কাচ ভেদ করে আসতে পারে। পাশাপাশি রান্না করার আগেও সানস্ক্রিন ব্যবহার করা জরুরি; কারণ, চুলার তাপেও ত্বকের ক্ষতি হতে পারে।
দাগ দূরে
টপিক্যাল ট্রিটমেন্ট
প্রেসক্রিপশন স্ট্রেন্থের টপিক্যাল ট্রিটমেন্টের মধ্যে হাইড্রোকুইনোন ২-৪% সবচেয়ে কার্যকর; তবে এটি অবশ্যই ডাক্তারের তত্ত্বাবধানে ব্যবহার করা উচিত। অন্যান্য কার্যকরী উপাদানের মধ্যে ভিটামিন সি সেরাম, নিয়াসিনামাইড ৫-১০%, আলফা আরবুটিন ২%, কোজিক অ্যাসিড এবং লিকোরাইস এক্সট্র্যাক্ট উল্লেখযোগ্য। এই উপাদানগুলো মেলানিন উৎপাদন কমায় এবং বিদ্যমান দাগ ফিকে করতে সাহায্য করে। তবে এর যেকোনো ট্রিটমেন্ট ব্যবহার করার আগে ডার্মাটোলজিস্টের পরামর্শ নেওয়া ভালো।
প্রফেশনাল ট্রিটমেন্ট
কেমিক্যাল পিলের মধ্যে গ্লাইকোলিক অ্যাসিড পিল (২০-৭০%) সবচেয়ে জনপ্রিয়, যা ত্বকের ওপরের স্তর সরিয়ে নতুন কোষ তৈরিতে সাহায্য করে। স্যালিসাইলিক অ্যাসিড পিল বিশেষভাবে তৈলাক্ত ত্বক এবং ইনগ্রোন হেয়ারের জন্য উপকারী। লেজার থেরাপির মধ্যে কিউ সুইচড লেজার গাঢ় ত্বকের জন্য সবচেয়ে নিরাপদ। ফ্র্যাক্সেল লেজার ত্বকের টেক্সচার উন্নত করতে সহায়ক। অন্যদিকে ইনটেন্স পালসড লাইট হালকা থেকে মাঝারি দাগের জন্য ভালো কাজ করে। এ ছাড়া মাইক্রোনিডলিং, ডার্মাব্রেশন এবং প্লাটিলেট রিচ প্লাজমা থেরাপিও কার্যকর বিকল্প হতে পারে।
প্রাকৃতিক ও ঘরোয়া উপায়
অ্যালোভেরা জেল সরাসরি তাজা অ্যালোভেরা পাতা থেকে সংগ্রহ করে দিনে ২-৩ বার দাগের ওপর প্রলেপ দিলে প্রদাহ কমে এবং দাগ ফিকে হয়। শসার প্যাক তৈরির জন্য শসা ব্লেন্ড করে পেস্ট তৈরি করে তাতে ১ চা-চামচ লেবুর রস মিশিয়ে ১৫-২০ মিনিট রেখে ধুয়ে ফেলা যেতে পারে। হলুদ ও দুধের প্যাকের জন্য ১ চা-চামচ কাঁচা হলুদগুঁড়ার সঙ্গে ২ চা-চামচ কাঁচা দুধ মিশিয়ে এই প্যাক ১০ মিনিট মুখে লাগিয়ে রাখা যেতে পারে। ব্যবহৃত গ্রিন টি ব্যাগ ফ্রিজে রেখে ঠান্ডা করে দাগের ওপর ১০ মিনিট রাখলে জ্বালাপোড়া কমে। এই প্রাকৃতিক উপায়গুলো নিয়মিত ব্যবহার করলে ধীরে ধীরে দাগের তীব্রতা কমে আসতে পারে।
দীর্ঘমেয়াদি সুরক্ষায়
সান প্রোটেকশন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দীর্ঘমেয়াদি কৌশল। বাইরে বের হলে এসপিএফ ৩০-৫০ যুক্ত সানস্ক্রিন ব্যবহার করা আবশ্যক এবং ৩-৪ ঘণ্টা পরপর রিঅ্যাপ্লাই করে নেওয়া যেতে পারে। শারীরিক সানপ্রোটেকশন যেমন ছাতা, হ্যাট ব্যবহার করাও জরুরি। লেজার হেয়ার রিমুভাল একটি কার্যকর বিকল্প, যা দীর্ঘমেয়াদি ফল দেয়। শেভিং বা ডিপিলেটরি ক্রিমও তালিকায় রাখা যেতে পারে; তবে এগুলোও সঠিকভাবে ব্যবহার না করলে জ্বালাপোড়া সৃষ্টির ঝুঁকি থাকে।
যদি ৬-৮ সপ্তাহ পরেও উন্নতি না দেখা দেয়, তাহলে ডার্মাটোলজিস্টের পরামর্শ নেওয়া উচিত। দাগের সঙ্গে যদি চুলকানি, ব্যথা বা পুঁজ থাকে, সেটাও চিকিৎসকের দেখার বিষয়। দাগের রং যদি গাঢ় কালো বা নীলচে হয়, বা দাগের আকার ক্রমাগত বাড়তে থাকে, তাহলে দ্রুত চিকিৎসা নেওয়া প্রয়োজন। এ ছাড়া হঠাৎ প্রচুর নতুন দাগ দেখা দিলেও যত দ্রুত সম্ভব ডার্মাটোলজিস্টের শরণাপন্ন হওয়া শ্রেয়। কারণ, এটি ত্বকের অন্য কোনো সমস্যার লক্ষণ হতে পারে।
ওয়াক্সিং-পরবর্তী কালো দাগ দূর করতে ধৈর্য ধরা চাই। কারণ, এটি একটি ধীর প্রক্রিয়া। সাধারণত দাগ সম্পূর্ণভাবে দূর হতে ৩ থেকে ৬ মাস সময় লাগে। মনে রাখতে হবে, প্রতিরোধই সর্বোত্তম চিকিৎসা। সঠিক ওয়াক্সিং পদ্ধতি, নিয়মিত ত্বকের যত্ন এবং সানপ্রোটেকশন মেনে চললে এই সমস্যা থেকে মুক্তি সম্ভব। যদি ঘরোয়া পদ্ধতিতে উন্নতি না দেখা দেয়, তাহলে অবশ্যই একজন ভালো ডার্মাটোলজিস্টের পরামর্শ নেওয়া জরুরি।

 শিরীন অন্যা
মডেল: জুঁই
মেকওভার: পারসোনা
ছবি: কৌশিক ইকবাল

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top