টেকসহি I যুবসমাজের জয়গান
আন্তর্জাতিক যুব দিবস। প্রতিবছরের ১২ আগস্ট উদ্যাপিত হয়। মূল উদ্দেশ্য—তরুণদের অংশগ্রহণ ও নেতৃত্বকে আরও বেশি জায়গা করে দেওয়া। কেবল ভবিষ্যতের নেতৃত্ব নয়; যেন তারা হয়ে ওঠে বর্তমান বিশ্বের বিভিন্ন সংকট সমাধানের অপরিহার্য শক্তি। বিস্তারিত লিখেছেন সুস্মিতা চক্রবর্তী মিশু
বই পড়ে কি একটি পুরো গ্রামের চেহারা বদলে দেওয়া সম্ভব? যদি বিশ্বাস না হয়, তবে শুনুন আফ্রিকার মালাউইয়ের এক কিশোরের গল্প। তার নাম উইলিয়াম কামকামবা। মাত্র ১৪ বছর বয়সে, ভয়াবহ খরা ও দারিদ্র্যের মধ্যে বেড়ে ওঠা এই কিশোরের সামনে ছিল শুধুই সংকট আর অনিশ্চয়তা। খাবার নেই, বিদ্যুৎ নেই; আলোর আশাও যেন বিলাসিতা। পরিবারের আর্থিক অনটনে বন্ধ হয়ে যায় স্কুলে যাওয়া; কিন্তু থেমে যাননি উইলিয়াম। পড়াশোনা থেকে দূরে থাকলেও শেখার আগ্রহ ছিল তীব্র। তাই গ্রামের একটি ছোট্ট গ্রন্থাগারই হয়ে ওঠে তার বিদ্যালয়। সেখান থেকে হাতে তুলে নেন একটি পুরোনো বিজ্ঞান বই, যাতে লেখা ছিল—বায়ুশক্তি ব্যবহার করে বিদ্যুৎ উৎপাদনের উপায়। বই পড়ে কোনোরকমে কারিগরি প্রশিক্ষণ ছাড়াই তিনি জোগাড় করেন কাঠ, পুরোনো সাইকেলের চাকা, লোহালক্কড়। সেগুলো দিয়ে তৈরি করেন একখানা ছোট্ট বায়ুচালিত টারবাইন। ফল? প্রথমে তার নিজের বাড়িতে জ্বলে ওঠে আলো; এরপর সেই বিদ্যুৎ পৌঁছে যায় আশপাশের বাড়িঘরেও।
কিংবা গ্রেটা টিনটিন ইলেওনোরা এর্নম্যান থুনবার্গ, ওরফে গ্রেটা থুনবার্গের কথা নিশ্চয় শুনেছেন। ২০১৫ সালে পুরো পৃথিবী যখন জলবায়ু পরিবর্তনের ভয়াবহতায় কাঁপছিল, তখন এই কিশোরী একা হাতে একটি সাদামাটা প্ল্যাকার্ড নিয়ে দাঁড়িয়ে গিয়েছিলেন সুইডিশ সংসদ ভবনের সামনে। প্ল্যাকার্ডে লেখা ছিল: `Skolstrejk för Klimatet’; অর্থাৎ ‘জলবায়ুর জন্য স্কুল ধর্মঘট’। তার এই একক প্রতিবাদ ছিল নিজ দেশের সরকারের কাছে কার্যকর জলবায়ু পদক্ষেপের আহ্বান। সেই ছোট্ট পদক্ষেপই অল্প সময়ের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে বিশ্বের নানা প্রান্তে; রূপ নেয় এক বিশ্বব্যাপী তারুণ্যের আন্দোলনে। যার নাম ‘ফ্রাইডে’স ফর ফিউচার’। এই আন্দোলন প্রমাণ করে, বয়স নয়; পরিবর্তনের জন্য প্রয়োজন দৃঢ় মন, সাহসিকতা আর অঙ্গীকার। তাই উইলিয়াম কিংবা গ্রেটার মতো যুবাদের এই সাহসিকতা ও অঙ্গীকার নিয়ে যুবসমাজকে উদ্বুদ্ধ করতে উদ্যাপন করা হয় ইন্টারন্যাশনাল ইয়ুথ ডে বা আন্তর্জাতিক যুব দিবস। বিশ্বজুড়ে তরুণসমাজের ভূমিকা, অধিকার ও সম্ভাবনাকে স্বীকৃতি জানানোর একটি গুরুত্বপূর্ণ উপলক্ষ এটি।
১৯৯১ সালে অস্ট্রিয়ার ভিয়েনায় অনুষ্ঠিত জাতিসংঘের বিশ্ব যুব ফোরামে অংশগ্রহণকারী তরুণদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৯৮ সালে পর্তুগালের রাজধানী লিসবনে অনুষ্ঠিত হয় জাতিসংঘের ‘ওয়ার্ল্ড কনফারেন্স অব মিনিস্টারস রেসপনসিবল ফর ইয়ুথ’। এই সম্মেলনে ১২ আগস্টকে আন্তর্জাতিক যুব দিবস হিসেবে উদ্যাপনের প্রস্তাব করা হয়। ১৯৯৯ সালে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ প্রস্তাবের প্রতি সমর্থন জানায়। এরই ধারাবাহিকতায় ২০০০ সাল থেকে জাতিসংঘের উদ্যোগে ১২ আগস্টকে আন্তর্জাতিক যুব দিবস হিসেবে উদ্যাপন করা হয়। বর্তমান বিশ্বে যুবসমাজ শুধু আগামী দিনের নয়; বরং বর্তমান সময়েরও সক্রিয় অংশীদার। তাই সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও পরিবেশগত ক্ষেত্রে তাদের পালন করা চাই সক্রিয় ভূমিকা। আন্তর্জাতিক যুব দিবস তরুণদের এই অমূল্য অবদানকে সম্মান জানায় এবং তাদের ক্ষমতায়ন ও অংশগ্রহণের সুযোগ সৃষ্টিতে উদ্বুদ্ধ করে।
শুরুর দিকে এই দিবস উদ্যাপনের মূল লক্ষ্য ছিল বিশ্বজুড়ে তরুণদের চ্যালেঞ্জগুলোর প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ। পরবর্তী সময়ে দিবসটি একটি গুরুত্বপূর্ণ প্ল্যাটফর্ম হয়ে উঠেছে; যেখানে সংলাপ, কার্যক্রম ও সচেতনতা বৃদ্ধির মাধ্যমে তরুণদের অধিকার ও অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা হয়; যা শান্তি, মানবাধিকার, টেকসই উন্নয়ন ও গণতান্ত্রিক অংশগ্রহণে তাদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা তুলে ধরে।
বাংলাদেশের দিকে যদি তাকাই, দেখা যাবে ইতিবাচক অর্জন, বিজয়, সংস্কার, বিভিন্ন আন্দোলন ও সংগ্রামে ছাত্রসমাজ, তরুণ ও যুবসমাজই মূল নেতৃত্ব দিয়েছে। ব্রিটিশবিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলন, ভাষা আন্দোলন, গণ-অভ্যুত্থান, মহান মুক্তিযুদ্ধ এবং মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী গণতান্ত্রিক আন্দোলন এই সত্যের প্রমাণ। দেশের সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রায় সবচেয়ে বড় চালিকাশক্তি যুব জনগোষ্ঠী। জাতিসংঘের সংজ্ঞা অনুযায়ী, ‘যুব’র ব্যাপ্তি ১৫ থেকে ২৪ বছর বয়স পর্যন্ত। তবে বাংলাদেশে ১৮ থেকে ৩৫ বছর বয়স পর্যন্ত নরনারীকে যুবক-যুবতী হিসেবে গণ্য করা হয়। যেভাবেই সংজ্ঞায়িত করা হোক না কেন, যুবসমাজকে নিজ নিজ অধিকারের বিষয়ে সচেতন করা এবং তাদের একটি শক্তি হিসেবে কাজে লাগানো জরুরি। বিশ্বের মোট জনসংখ্যার এক বিশাল অংশ তরুণ; যাদের বয়স ১৫ থেকে ৩৫ বছরের মধ্যে। বাংলাদেশে এ সংখ্যা ৫ কোটির বেশি। এই বিশাল যুব জনশক্তি যদি যথাযথভাবে পরিকল্পিত ও সক্রিয় অংশগ্রহণের মাধ্যমে সম্পৃক্ত হয়, তাহলে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) অর্জন সহজতর হবে।
২০১৫ সালে জাতিসংঘ ঘোষিত টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা হলো এমন একটি বৈশ্বিক রূপরেখা, যার মাধ্যমে ২০৩০ সালের মধ্যে একটি ন্যায্য, সমতাভিত্তিক, পরিবেশবান্ধব ও শান্তিপূর্ণ পৃথিবী গড়ে তোলার লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। এই ১৭টি লক্ষ্যমাত্রা বাস্তবায়নে রাষ্ট্র, সরকার, প্রতিষ্ঠান ও নাগরিক সমাজের পাশাপাশি যুবসমাজের ভূমিকা অনস্বীকার্য। এসডিজির মূল ভিত্তি হলো ‘কাউকে পেছনে ফেলে নয়’। এ লক্ষ্য পূরণে যুবসমাজই হতে পারে সবচেয়ে বড় শক্তি।
তরুণ উদ্যোক্তারা আজ দেশের দারিদ্র্য দূরীকরণ ও খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখছেন। ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা, কৃষিভিত্তিক স্টার্টআপ, সামাজিক উদ্যোগ কিংবা ডিজিটাল মার্কেটিংয়ের মতো বিভিন্ন খাতে তারা নিচ্ছেন সাহসী পদক্ষেপ। প্রযুক্তি ব্যবহার করে খাদ্য সরবরাহ চেইনের উন্নয়ন, কৃষকদের তথ্যভিত্তিক সহায়তা প্রদান এবং সামাজিক ব্যবসার মাধ্যমে কর্মসংস্থান তৈরি করা—এসব কার্যক্রমে তরুণদের উদ্ভাবনী চিন্তা ও কর্মক্ষমতা দৃশ্যমান। তাদের এই অবদান শুধু অর্থনৈতিক অগ্রগতিতেই নয়; সামাজিক উন্নয়নেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।
বর্তমান ডিজিটাল যুগে প্রযুক্তিগত বিপ্লবের অন্যতম চালিকাশক্তি যুবসমাজ। মাত্র ১৯ বছর বয়সে মার্ক জাকারবার্গ ফেসবুক প্রতিষ্ঠা করে বৈশ্বিক যোগাযোগের নতুন দিক উন্মোচন করেন। বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও এর ব্যতিক্রম নয়। তরুণ শিক্ষার্থী আইমান সাদিকের উদ্যোগে গড়ে ওঠা ‘১০ মিনিট স্কুল’ শিক্ষা প্রসারে প্রযুক্তির ব্যবহারকে নতুন মাত্রা দিয়েছে। একইভাবে তরুণদের গড়া ‘পাঠাও’, ‘শপআপ’-এর মতো স্টার্টআপগুলো দেশের উদ্যোক্তা পরিবেশ ও ডিজিটাল অর্থনীতিকে শক্তিশালী করছে। এ ছাড়া তরুণেরা নারীর ক্ষমতায়ন, শিশুর অধিকার এবং লৈঙ্গিক বৈষম্য দূরীকরণে সোচ্চার।
বর্তমানে টেকসই শিল্প ও অবকাঠামো গঠনের জন্য প্রয়োজন উদ্ভাবন ও প্রযুক্তির কার্যকর ব্যবহার। আইটি, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, ব্লকচেইন, কৃষি প্রযুক্তি প্রভৃতি ক্ষেত্রে উদ্ভাবনী ধারণা নিয়ে কাজ করছে যুবসমাজ। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, ব্লগ, ক্যাম্পেইন ও মঞ্চের মাধ্যমে শান্তি, সহনশীলতা ও মানবাধিকারের পক্ষে আওয়াজ তুলছেন তারা। নির্বাচনী অধিকার, তথ্যের অধিকার ও দুর্নীতিবিরোধী উদ্যোগে তাদের ভূমিকা স্পষ্ট। তারা স্থানীয় সরকার, এনজিও, যুব সংগঠন বা স্বেচ্ছাসেবী কার্যক্রমে অংশ নিয়ে সুশাসনের ভিত্তি গড়ছেন। পাকিস্তানের মালালা ইউসুফজাই নারী শিক্ষার পক্ষে সোচ্চার হয়ে শান্তিতে নোবেল পুরস্কার অর্জন করেন মাত্র ১৭ বছর বয়সে। বিশ্বের যুদ্ধ-বিক্ষুব্ধ অঞ্চলগুলোতে তরুণদের নেতৃত্বে গড়ে উঠছে ‘পিস ক্লাব’, ‘গার্লস ফর চেঞ্জ’ বা ‘ইয়ুথ ফর জাস্টিস’-এর মতো আন্দোলন।
জলবায়ু ন্যায্যতা বিষয়টি বর্তমানে বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জ। তরুণেরাই পারেন এখন পরিবেশ রক্ষা, সচেতনতা বাড়ানো ও টেকসই জীবনধারার পক্ষে কাজ করতে। অন্যদিকে, সামাজিক সমতা প্রতিষ্ঠার জন্য তরুণদের রাজনৈতিক সচেতনতা, লৈঙ্গিক সমতা, শিক্ষা ও কর্মসংস্থানে সমান অংশগ্রহণ নিশ্চিত করাও গুরুত্বপূর্ণ।
বাংলাদেশে যুবসমাজ দেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় এক-তৃতীয়াংশ। তাদের পক্ষে দেশ গঠনে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখা সম্ভব। তারা কৃষি থেকে প্রযুক্তি, সংস্কৃতি থেকে সাংবাদিকতা—সবখানে সক্রিয়। তবে বাস্তবতা অনেক জটিল। দেশের শিক্ষিত তরুণদের বড় অংশই বেকার। সরকারি চাকরির সীমিত সুযোগ, বেসরকারি চাকরির অনিশ্চয়তা এবং দক্ষতার ঘাটতির কারণে অনেকে হতাশায় ভোগেন। আবার কেউ কেউ মাদকাসক্তি, সহিংসতা, ধর্মীয় উগ্রতা কিংবা প্রযুক্তির অপব্যবহারের শিকার হন। তবে এর বিপরীতে কিছু উদাহরণ বেশ উজ্জ্বল। বাংলাদেশের তরুণ ফ্রিল্যান্সাররা আজ বিশ্ববাজারে সুপরিচিত। যুব উদ্যোক্তারা স্থানীয় পণ্য নিয়ে আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ড তৈরি করছেন। তরুণ সাংবাদিকেরা সোশ্যাল মিডিয়ায় জনসচেতনতা বাড়াতে রাখছেন অপরিসীম ভূমিকা। তাই আমাদের মনে রাখা চাই, আন্তর্জাতিক যুব দিবস কেবল উদ্যাপনের দিন নয়; এটি একটি জাগরণের আহ্বান। এটি আমাদের মনে করিয়ে দেয়, তরুণেরা শুধু ভবিষ্যতের নেতা নন; তারা ইতিমধ্যে নেতৃত্ব দিচ্ছেন। জলবায়ু সংকট থেকে শুরু করে সামাজিক বৈষম্য পর্যন্ত—সব সমস্যার সমাধানে তাদের সম্পৃক্ততা অপরিহার্য।
ছবি: ইন্টারনেট
