টেকসহি I তাপে তালগোল
বিশ্বজুড়ে তাপমাত্রার তারতম্য ছাড়াচ্ছে রেকর্ড। এর প্রভাবে গলছে চিরচেনা মেল্টপ্রুফ মেকআপ, উবে যাচ্ছে পারফিউমের সুঘ্রাণ, গলে ঘেঁটে যাচ্ছে সলিড ফর্মুলার সাজ প্রসাধনী, কার্যকারিতা হারাচ্ছে সৌন্দর্যপণ্য। এমন কঠিন বাস্তবতায় সবচেয়ে বড় প্রশ্ন—উষ্ণতার এই অস্বাভাবিক ঊর্ধ্বমুখিতার সঙ্গে খাপ খাওয়াতে প্রস্তুত তো সৌন্দর্যবিশ্ব?
ফুল ফেস টিপটপ মেকআপ নিয়ে বাইরে বেরোনোর কিছুক্ষণ পর সাজ আর সাজ থাকে না, হয়ে ওঠে সঙ। হিট ওয়েভে এই সমস্যা এখন নিতান্তই মামুলি, মাঝেমধ্যে তো সাধারণ গরমের দিনেও। কারণ, হিট ফোরকাস্ট বলছে, এখনকার গরম আর আগেকার গরমের মধ্যে ফারাক বিস্তর। অন্তত গত দুই গ্রীষ্মে সে প্রমাণই মিলেছে। আর সমস্যাটা সর্বজনীন, বিশ্বজুড়ে। ফল—পাল্টাচ্ছে ভোক্তার অভ্যাসও।
মেল্টিং আন্ডার প্রেশার
সাধারণত ট্র্যাডিশনাল বিউটি প্রোডাক্টগুলো তৈরি হয় ঘরের ভেতর কিংবা একটা নির্দিষ্ট তাপমাত্রা অব্দি সংরক্ষণ উপযোগী করে। এখন পুরো বিশ্বকে প্রতিনিয়ত যে তীব্র এবং অস্থির তাপমাত্রার মুখোমুখি হতে হচ্ছে, সেটার জন্য নয়। ক্রিম, লিপস্টিক আর সেরামের মতো ইমালশন বেসড প্রোডাক্টগুলো সাধারণত তেল আর পানি মিলিয়ে তৈরি। উচ্চ তাপমাত্রায় এই ইমালশনগুলোর আলাদা হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা বাড়ে। ফল—পণ্য হারায় টেক্সচার, নষ্টও হয়ে যেতে পারে। তাপমাত্রা ৯৯ ডিগ্রি ফারেনহাইটের ঊর্ধ্বে উঠলেই হায়ালুরনিক অ্যাসিড আর পেপটাইডের মতো হিট সেনসিটিভ অ্যাকটিভ উপাদানগুলো কার্যকারিতা হারাতে শুরু করে। এমনকি জনপ্রিয় সব এসেনশিয়াল অয়েল যেগুলোর ত্বক উপকারী গুণগানে মুখর গোটা বিশ্ব, অতিরিক্ত তাপমাত্রায় অক্সিডাইজ করে। কার্যকারিতা কমে, ত্বকে জ্বালাপোড়ার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। এমনকি সানস্ক্রিন, গরমের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপাদানও থাকে ঝুঁকিতে। তেল এবং ইউভি ফিল্টারের মতো উদ্বায়ী উপাদানের মিশ্রণে তৈরির দায়ে। আরও দুশ্চিন্তার বিষয় হলো, পণ্য বাইরে থেকে খোলা চোখে একদম ঠিকঠাক দেখায় বটে, কিন্তু তাদের অভ্যন্তরীণ রসায়নের বারোটা হয়তো আগেই বেজে গেছে। বিপদ হচ্ছে, খালি চোখে দেখা যায় না বলে ভোক্তারা না জেনেই এসব অকার্যকর আর অস্বস্তি সৃষ্টিকারী পণ্য ব্যবহার করে ফেলেন। জলবায়ুর এমন চরম পরিবর্তনের ফলে তাপ প্রতিরোধী, স্থিতিশীল ফর্মুলেশনের চাহিদা এখন আর কোনো বিশেষায়িত বিষয় নয়, হয়ে উঠছে প্রয়োজন। ফলে সৌন্দর্য ব্র্যান্ডগুলো এখন একটি স্পষ্ট চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি—উষ্ণায়নের এ বিশ্বে নিজেকে সংস্কার করা অথবা অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়ার ঝুঁকি মেনে নেওয়া।
বিয়ন্ড দ্য প্রিটি প্যাকেজ
তাপ কেবল কৌটার ভেতরের জিনিসের ওপরই প্রভাব ফেলে না, প্রোডাক্টের প্যাকেজিংয়েরও দফারফা করে দিতে পারে। বেশির ভাগ কসমেটিক কনটেইনার; বিশেষ করে যেগুলো প্লাস্টিকে তৈরি, সেগুলো সাধারণত উচ্চ কিংবা হুটহাট ওঠানামা করা তাপের কথা মাথায় রেখে ডিজাইন করা হয় না। বেশি তাপে প্যাকেজিং রং পরিবর্তন করে হয়তো বিকৃত হবে; ফেটেও যেতে পারে। এমনকি ভেতরকার পণ্যে মাইক্রোপ্লাস্টিক ঢুকে যাওয়ার শঙ্কাও থাকে। এ ছাড়া তাপে কৌটার ভেতরের বাতাস প্রসারিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে অভ্যন্তরীণ চাপ পণ্যের তরল অংশকে চিপে বাইরে বের করে দেয়। সিনেরেসিস নামের এ প্রক্রিয়ার দরুন প্রোডাক্টের সারফেসে ঘামের মতো দেখতে তেল অথবা ময়শ্চার ড্রপলেট চোখে পড়ে। এটি পণ্যের কার্যকারিতা নষ্ট করে, শেলফ লাইফ কমিয়ে দেয়। এ সমস্যা থেকে উতরে উঠতে এখন অনেক ব্র্যান্ড সিল করা, হিট রেজিস্ট্যান্ট কনটেইনার ডিজাইন করছে। এনক্যাপসুলেশন প্রযুক্তি নিয়েও বিস্তর নিরীক্ষা চলছে, যেখানে পণ্যের অ্যাকটিভ উপাদানগুলো মাইক্রো ক্যাপসুলে সংরক্ষিত থাকে, ত্বকে সরাসরি সংস্পর্শের আগপর্যন্ত। সমস্যা হচ্ছে, প্যাকেজিংয়ের এমন আধুনিকীকরণের খরচ কিন্তু বেশ চড়া। কারণ, এ ক্ষেত্রে গবেষণার কাজে প্রচুর বিনিয়োগের প্রয়োজন হয়, যা উৎপাদন খরচ বাড়ায়। স্বাভাবিকভাবে অনেক ব্র্র্যান্ড এখন অব্দি এমন ঝুঁকি নিতে দ্বিধায় ভোগে। কিন্তু সৌন্দর্যবিশ্ব যদি ইতিবাচক পরিবর্তনের পুরো ব্যাপারটা গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করে থাকে, তাহলে প্যাকেজিং নিয়ে হেলাফেলার কোনো সুযোগ নেই। জলবায়ু পরিস্থিতির পরিবর্তন যদি অব্যাহত থাকে, তাহলে সৌন্দর্যকে নিরাপদ, কার্যকর আর সাসটেইনেবল রাখতে স্মার্ট উপাদানের মতো স্মার্ট প্যাকেজিংয়ের গুরুত্ব এড়ানোর উপায় নেই।
লো-ওয়াটার লাক্সারি
জলবায়ুর পরিবর্তন শুধু তাপের তারতম্যের সঙ্গে সম্পর্কিত নয়, পানিও এ ক্ষেত্রে খুব গুরুত্বপূর্ণ। বিশ্বব্যাপী ক্রমবর্ধমান পানির অভাব আর খরা সৌন্দর্যবিশ্বের ওপর বাড়তি চাপই বটে; যা এর ওয়াটার ফুটপ্রিন্ট কমানো নিয়ে প্রতিনিয়ত ভাবাচ্ছে। ব্র্যান্ডগুলোর পাশাপাশি ভোক্তাদের মধ্যে ফর্মুলার পুনর্বিবেচনা নিয়ে সচেতনতা বাড়ছে। কারণ, ৬০ শতাংশের বেশি ট্র্র্যাডিশনাল স্কিন কেয়ার পণ্য এমন সব ফর্মুলেশনের ওপর নির্ভরশীল, যেগুলো তৈরিতে প্রচুর পানির দরকার। পরিবর্তনের পদক্ষেপ হিসেবে ওয়াটারলেস বিউটি নিয়ে উদ্ভাবন বেড়েছে উল্লেখযোগ্য হারে। ফলাফল—ড্রাই শ্যাম্পু, পাউডারড ক্লিনজার, সলিড ময়শ্চারাইজার থেকে ফেস মাস্ক ট্যাবলেট। এই পণ্যগুলো কেবল দীর্ঘস্থায়ী এবং ভ্রমণবান্ধবই নয়, ওয়াটার-বেসড ফর্মুলাগুলোতে তাপের ফলে যে তারতম্যের সৃষ্টি হয়, তা এড়াতেও সহায়ক। এরই মধ্যে কিছু ব্র্যান্ড তাদের ফর্মুলেশনে স্বাদু পানির পরিবর্তে অ্যালগি বেসড ওয়াটার ব্যবহার শুরু করেছে, যা মেরিন ইন্ডাস্ট্রি থেকে পাওয়া সাসটেইনেবল বাই-প্রোডাক্ট। ফর্মুলা ছাড়াও ভোক্তারা এখন ঝুঁকতে শুরু করেছেন মাল্টি-ফাংশনাল, রিন্জ-ফ্রি প্রোডাক্টে। যেগুলো ব্যবহারে পানি কম প্রয়োজন হয়; যেমন: মাইসেলার ওয়াটার বা থ্রি-ইন-ওয়ান ক্লিনজিং বার। এই পরিবর্তন একটি গভীর সচেতনতার প্রতিফলন ঘটায়। সৌন্দর্যবিশ্বকে এখন শুধু প্যাকেজিং আর ব্র্যান্ডিংয়ের ক্ষেত্রে নয়, পানির উৎসের মতো প্রতিটি স্তরে জলবায়ু-সচেতন হবে। পানি যত মূল্যবান হবে, সৌন্দর্যবিশ্বকেও আরও কার্যকরী হয়ে উঠতে হবে। প্রখর গরম আর শুষ্কতার সমস্যার জর্জরিত এ পৃথিবীতে লো-ওয়াটার ফর্মুলেশন তাই শুধু ইকো-ফ্রেন্ডলিই নয়, ফিউচার প্রুফও বটে।
বিউটি ডেস্ক
ছবি: সংগ্রহ
