skip to Main Content

টেকসহি I দর্শনের দিনলিপি

নভেম্বরের তৃতীয় বৃহস্পতিবার। বিশ্ব দর্শন দিবস। চিন্তা শাণিত করার প্রেরণায় উদ্‌যাপিত হয় দুনিয়াজুড়ে

খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতাব্দীর কথা। তখনকার গ্রিক সমাজে দেব-দেবীর কাহিনি, অলৌকিক শক্তি আর ধর্মীয় আচারই ছিল জীবনের সব ব্যাখ্যার কেন্দ্রবিন্দু। বৃষ্টি কেন হয়, বজ্রপাত কেন ঘটে, পৃথিবী কীভাবে টিকে আছে—সব প্রশ্নের উত্তরেই তখন পাওয়া যেত দেবতাদের ইচ্ছার কথা। এই প্রেক্ষাপটে উঠে এলেন এক সাহসী চিন্তাবিদ—থেলিস অব মিলেটাস। তিনি বলেছিলেন, ‘প্রকৃতির প্রতিটি ঘটনার পেছনে কোনো দেবতা নয়, একটি কারণ আছে।’
থেলিস প্রথম মানুষ, যিনি পৃথিবী ও জীবনের রহস্যকে যুক্তি ও পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে বোঝার চেষ্টা করেছিলেন। তিনি বিশ্বাস করতেন, সবকিছুরই একটি প্রাকৃতিক কারণ আছে এবং সেই কারণ অনুসন্ধান করাই মানুষের জ্ঞানের প্রকৃত পথ। আরও বিশ্বাস করতেন, পৃথিবীর সবকিছু এক মৌলিক উপাদান থেকে সৃষ্টি হয়েছে, সেটি হলো পানি। তার মতে, পানি ছাড়া কোনো জীবিত প্রাণ টিকে থাকতে পারে না। পানি কঠিন বরফে পরিণত হয়, আবার বাষ্পে রূপ নেয়। অর্থাৎ, এটি নানা রূপ নিতে পারে। তাই তিনি ধারণা দেন, পানি হলো সেই মৌলিক উপাদান, যা থেকে বিশ্বজগতের সৃষ্টি।
যদিও আধুনিক বিজ্ঞানের দৃষ্টিতে এই ধারণা সঠিক নয়; কিন্তু ইতিহাসে এটাই ছিল প্রথম বৈজ্ঞানিক ও দার্শনিক প্রচেষ্টা, যেখানে মানুষ প্রকৃতির রহস্য বুঝতে যুক্তি ব্যবহার করেছে, কুসংস্কার নয়। এই দৃষ্টিভঙ্গিই পরবর্তীকালে দর্শনের জন্ম দেয়। এটি এমন এক বিদ্যা, যা প্রশ্ন করতে এবং যুক্তি দিয়ে ভাবতে শেখায়; অন্ধবিশ্বাসের বদলে অনুসন্ধানের আলো জ্বালায়।
মানুষের চিন্তা, প্রশ্ন আর সত্য অনুসন্ধানের ইতিহাস যত পুরোনো, দর্শনের জন্মও ততই প্রাচীন। মানবসভ্যতার শুরু থেকে মানুষ নিজের অস্তিত্ব, জীবনের উদ্দেশ্য, নৈতিকতা, ন্যায়-অন্যায়, সুখ-দুঃখ—এসব নিয়ে ভাবতে শুরু করে। এই চিন্তার উত্তরাধিকারকেই স্মরণ ও উদ্‌যাপন করা হয় প্রতিবছর নভেম্বর মাসের তৃতীয় বৃহস্পতিবার, বিশ্ব দর্শন দিবস (ওয়ার্ল্ড ফিলোসফি ডে) হিসেবে। চলতি বছরের ২০ নভেম্বর বিশ্বব্যাপী পালিত হবে দিবসটি।
২০০২ সালে ইউনেসকো প্রথমবারের মতো বিশ্ব দর্শন দিবস উদ্‌যাপন করে। পরে ২০০৫ সালে এই উদ্যোগকে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দেওয়া হয়। ইউনেসকোর উদ্দেশ্য ছিল দর্শনের প্রতি বিশ্বব্যাপী আগ্রহ জাগানো, যুক্তিবাদী চিন্তা ও সমালোচনামূলক বিশ্লেষণকে উৎসাহিত এবং সমাজে সহনশীলতা ও মানবতার মূল্যবোধ জোরদার করা। সহজ ভাষায় কী, কেন, কীভাবের উত্তর থেকে উৎপত্তি হয় দর্শনের। যার পীঠস্থান ছিল প্রাচীন গ্রিস। খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকে জন্ম এই বিদ্যার। মূলত মানুষের ‘কেন?’ প্রশ্ন থেকে। গ্রিক শব্দ ‘ফিলোসোফিয়া’র বাংলা রূপ ‘দর্শন’। ‘ফিলো’ অর্থ ‘ভালোবাসা’ এবং ‘সোফিয়া’ অর্থ ‘জ্ঞান’। অর্থাৎ দর্শন মানে ‘জ্ঞানপ্রেম’।
প্রাচীন দর্শন অনেকটাই ছিল গুরুমুখী বিদ্যা। এ ক্ষেত্রে বলা যায় সক্রেটিস-প্লেটো-অ্যারিস্টটলের কথা। পশ্চিমা দর্শনের পথিকৃৎ হিসেবে উঠে আসে সক্রেটিসের নাম। তারই শিষ্য প্লেটোর হাত ধরে গ্রিসে গড়ে উঠেছিল বিশ্বের প্রথম দর্শন স্কুল প্লেটোর একাডেমি। প্লেটোর শিষ্য অ্যারিস্টটল যুক্তিবিদ্যা, নীতিশাস্ত্র, প্রাণিবিদ্যা, রাজনীতি, সমাজনীতিসহ আরও অসংখ্য শাখায় অবদান রেখেছেন।
দর্শন মানুষকে স্বাধীন চিন্তা করতে, প্রশ্ন তুলতে এবং বহুমাত্রিক দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণে সাহায্য করে। তাই নভেম্বর মাসের তৃতীয় বৃহস্পতিবার দিনটি শুধু কোনো আনুষ্ঠানিকতা নয়; এই দিনে স্মরণ করা হয় মানবচিন্তার যাত্রা, সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য আর প্রত্যেক মানুষের ভেতরে থাকা প্রশ্ন করার ও ভাবার ক্ষমতাকে।
দর্শন এমন এক বিদ্যা, যা কেবল বইয়ের পাতায় সীমাবদ্ধ থাকে না। এটি এক অনুশীলন, যা আমাদের জীবন ও সমাজকে বদলে দিতে পারে। দর্শন শেখায় কীভাবে ভিন্নমতকে বুঝতে এবং যুক্তির আলোয় একে অপরের সঙ্গে কথা বলতে হয়। পৃথিবীর নানা জায়গার বুদ্ধিবৃত্তিক ধারাকে একত্র করে দর্শন আমাদের শেখায়—ভিন্নতা মানেই সৌন্দর্য, আর চিন্তার স্বাধীনতাই মানবতার ভিত্তি।
দর্শন জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। আমাদের নৈতিক সিদ্ধান্ত, রাজনৈতিক মতামত, এমনকি দৈনন্দিন জীবনের আচরণেও এর ছোঁয়া রয়েছে। সক্রেটিস যেমন বলেছিলেন, ‘পরীক্ষিত নয়—এমন জীবন বেঁচে থাকার অযোগ্য।’ এই উক্তি দর্শনের মূল চেতনার প্রতিফলন—নিজেকে ও সমাজকে প্রশ্ন করা, উত্তর খোঁজা এবং নতুন চিন্তা সৃষ্টি করা। দর্শন মানুষকে যুক্তি, ন্যায় ও সহানুভূতির সমন্বয়ে পৃথিবী দেখতে শেখায়।
প্রযুক্তির বিস্তার, তথ্যপ্রবাহ, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের যুগে মানুষ আগের চেয়ে অনেক বেশি তথ্যপ্রবাহে ডুবে আছে। কিন্তু তথ্যের প্রাচুর্য মানেই জ্ঞানের প্রাচুর্য নয়। এখানে দর্শন গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। কারণ, এটি শেখায়, কীভাবে সমালোচনামূলকভাবে চিন্তা করতে, সত্য ও মিথ্যার পার্থক্য গড়তে এবং মানবিক মূল্যবোধ ধরে রাখতে হয়। বর্তমান সময়ের তরুণেরা তথ্যপ্রযুক্তির যুগে বেড়ে উঠছেন। তারা দ্রুত তথ্য পান, দ্রুত মতামত দেন; কিন্তু গভীরভাবে চিন্তা করার সময় বা অভ্যাস অনেক ক্ষেত্রে থাকে না। দর্শনচর্চা এই প্রজন্মকে শেখাতে পারে, কীভাবে তথ্যকে বিশ্লেষণ করতে এবং যুক্তির আলোকে সিদ্ধান্ত নিতে হয়। তরুণদের জন্য দর্শন মানে জীবনের বাস্তব প্রশ্নগুলোর মুখোমুখি হওয়া। ‘আমি কে?’, ‘আমার কাজের নৈতিক ভিত্তি কী?’, ‘আমি সমাজে কী অবদান রাখছি?’—এসব প্রশ্নই আত্মপরিচয়ের পথে এগিয়ে নেয়।
দর্শন হলো সমাজের আয়না। একটি সমাজের সংস্কৃতি, আইন, নৈতিকতা, রাজনীতি—সবকিছুর ভিত্তি দর্শন থেকে এসেছে। ইউরোপে দর্শন যেমন গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের ধারণা দিয়েছে, তেমনি প্রাচ্যের দর্শন মানুষকে শিখিয়েছে শান্তি, সহনশীলতা ও সামঞ্জস্যের মূল্য। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে আমরা যদি লালন, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কিংবা কাজী নজরুল ইসলামের দিকে তাকাই, তাহলে দেখতে পাব, তারা দর্শনকে কেবল তত্ত্ব নয়; বরং জীবনের অংশ করে তুলেছিলেন। তাদের ভাবনা সমাজে বার্তা দিয়েছে মানবিকতা, সমতা ও স্বাধীন চিন্তার। লালন ফকিরের ‘খাঁচার ভেতর অচিন পাখি, কেমনে আসে যায়’ গানের কথাই বরং ধরা যাক। এই গান কি কোনো পাখির গল্প বলেছে, নাকি গানের অন্তর্নিহিত অর্থ হিসেবে লুকিয়ে আছে দেহতত্ত্ব দর্শনের কথা? বুঝতে হলে ঢুকতে হবে দর্শনচর্চার অন্দরে।
কিন্তু দর্শনচর্চার ফল বরাবরই কি মধুর ছিল? উত্তর হলো, ‘না’। সক্রেটিসের দিকে তাকালেই তা স্পষ্ট হয়ে যায়। ৩৯৯ খ্রিস্টপূর্বাব্দে রাজনীতিবিদ আনুতুস অভিযোগ এনেছিলেন, সক্রেটিস যুবসমাজকে বিপথে নিয়ে যাচ্ছেন এবং তিনি রাষ্ট্রস্বীকৃত দেবতাদের বিরোধী। এই অভিযোগের ভিত্তিতে সক্রেটিসকে হেমলক পানে মৃত্যুদণ্ড মেনে নিতে হয়েছিল। বস্তুত সক্রেটিস ছিলেন একজন প্রকৃত স্বাধীনচেতা চিন্তাবিদ। তিনি কোনো কিছুকেই অন্ধভাবে মেনে নিতেন না; সবকিছুর গুরুত্ব, ন্যায় ও পবিত্রতা নিয়ে প্রশ্ন তুলতেন। গণতন্ত্রের প্রতিষ্ঠান, সমাজের নিয়মকানুন—সবকিছুর সমালোচনামূলক বিশ্লেষণই তাকে রাষ্ট্রের কাছে ‘বিপজ্জনক’ ব্যক্তি হিসেবে উপস্থাপন করেছিল।
দর্শন কেবল কোনো বিমূর্ত তত্ত্ব নয়; এটি জীবনের পথপ্রদর্শক। বিশ্ব দর্শন দিবস আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয়, চিন্তা করা মানেই বেঁচে থাকা, প্রশ্ন তোলা মানেই উন্নতি করা, আর মতের ভিন্নতা মানেই শেখার নতুন সুযোগ। আজকের দ্রুতগতির দুনিয়ায় যেখানে বিভাজন ও সহিংসতা বেড়ে চলেছে, সেখানে দর্শন পারে মানুষের মধ্যে সহমর্মিতা ও শান্তি ফিরিয়ে আনতে। ফরাসি দার্শনিক ভলতেয়ার বলেছেন, ‘আমি তোমার কথার সঙ্গে দ্বিমত করতে পারি; কিন্তু তোমার কথা বলার অধিকারের জন্য আমার জীবন দিতে প্রস্তুত।’ অর্থাৎ দর্শনমুক্ত বাক্‌চর্চার অধিকার সম্পর্কে জানতে ও বুঝতে শেখায়। এই দর্শন দিবসে তাই আমাদের অঙ্গীকার হোক—নিজের চিন্তাকে স্বাধীন রাখা, অন্যের মতামতকে শ্রদ্ধা করা এবং মানবতার কল্যাণে যুক্তির আলো জ্বালিয়ে রাখা।
দার্শনিকদের জীবনে নির্লিপ্ততা প্রায়শই তাদের চিন্তা ও দৃষ্টিভঙ্গিতে নতুন মাত্রা যোগ করেছে। এই প্রেক্ষাপটে দার্শনিক সক্রেটিস একটি উৎকৃষ্ট উদাহরণ হিসেবে উল্লেখযোগ্য। সক্রেটিস এবং তার স্ত্রী জ্যানথিপেকে নিয়ে প্রচলিত একটি মজার গল্প দিয়ে বরং আজকের লেখা শেষ করা যাক।
এক রাতে ঘরে নেই কোনো খাবার। ছেলে-মেয়েরা কেঁদেকেটে ঘুমিয়ে পড়েছে। দার্শনিক সক্রেটিস বসে আছেন নীরবে, ধ্যানে মগ্ন। স্ত্রী জ্যানথিপের সহ্য হলো না। শুরু করলেন বকাঝকা। যে-সে বকা নয়, তীব্র ক্রোধের বহিঃপ্রকাশ ছিল সেটি। তাতে অবশ্য সক্রেটিসের কোনো পরিবর্তন হলো না। উত্তর না দিয়ে ধীরে ধীরে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। বাইরে এসে চাঁদের আলোয় বসে শুরু করলেন বই পড়া। জ্যানথিপে জানালার ফাঁক দিয়ে দেখলেন, সেই চুপচাপ মানুষটা এখনো শান্তভাবে পড়ছেন! রাগে ফুঁসে উঠলেন তিনি। ছুটে গেলেন ভেতরে। এক গামলা ভর্তি ময়লাপানি তুলে এনে ঢেলে দিলেন সক্রেটিসের মাথায়! সক্রেটিস তখনো রাগ করলেন না; বরং হাসলেন। মৃদু হেসে বললেন, ‘আহা! এত গুরুগম্ভীর মেঘের গর্জনের পর একপশলা বৃষ্টি না হলে কি আর শোভা পায়?’

 সুস্মিতা চক্রবর্তী মিশু
ছবি: ইন্টারনেট

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top