ছুটিরঘণ্টা I পাথরে রচিত মহাকাব্য
স্টোন ফরেস্ট। চীনের কুনমিং শহর থেকে প্রায় ৯০ কিলোমিটার পূর্বে, প্রাগৈতিহাসিক এক বিশাল পাথুরে অরণ্য। ইউনেসকো বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থান হিসেবে স্বীকৃত। ঘুরে এসে লিখেছেন এলিজা বিনতে এলাহী
চীনমুখী হলাম প্রায় দশ বছর পর। দেশটির নাম মনে এলেই প্রথমে মাথায় আসে ২০১৪ সালের কথা। সেবার প্রায় দেড় দিন পানি পান ছাড়া ছিলাম ভাষার জটিলতায়! এবার আমার মূল ভ্রমণ গন্তব্য ছিল তিব্বত। যাত্রাপথে বিরতি নিয়েছি কুনমিং শহরে; ফেরার পথেও। দশ বছরে বেশ বদলেছে কুনমিং। তবে ভাষার জটিলতা খুব বদলেছে বলে মনে হলো না!
চীন বলতেই আমাদের চোখের সামনে সাধারণত ভেসে ওঠে কর্মপ্রিয় সুশৃঙ্খল একটি দেশ। বর্তমান বিশ্বে যাকে অর্থনীতির একটি পরাশক্তি বিবেচনা করা হয়। শুধু অর্থনীতিতেই নয়; শিক্ষা-দীক্ষাসহ বিজ্ঞানচর্চা, স্থাপত্যবিদ্যায় অনেক এগিয়ে। কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে লক্ষ্যে পৌঁছানোই তাদের মূলমন্ত্র। আজ এই একবিংশ শতাব্দীতে প্রযুক্তির একচ্ছত্র অধিপতি তারা।
চিরবসন্তের শহর কুনমিং। এ শহরে রয়েছে লক্ষাধিক বছরের পুরোনো এক পাথরের বন। একে অনায়াসে বলা যায় পাথরের গোলকধাঁধা। তিব্বতের লাসা শহর থেকে কুনমিংয়ে এলাম। আগে বারকয়েক এ শহরে আসা হলেও স্টোন ফরেস্টটি দেখা হয়নি। তাই এবার সেই সুযোগ হাতছাড়া করতে চাইনি। দেশটির ইউনান প্রদেশের গভীরে লুকিয়ে আছে এই পাথুরে অরণ্য। প্রতিটি পাথরের রয়েছে নিজস্ব নাম ও গল্প। শুধু দর্শনীয় স্থান নয়; এ এক হারানো রাজ্যের ইতিহাস আর প্রেমের উপাখ্যান।
সকাল ৯টায় হোটেল লবিতে অপেক্ষা করছি। বেশ লম্বা এক মেয়ে এসে জানতে চাইলেন, ‘আর ইউ ফ্রম বাংলাদেশ? আই অ্যাম ইউর গাইড রিদিনা।’ তার উচ্চতা ও ইংরেজি বলার ধরন দারুন লাগল। গ্রুপের সবাই তখনো লবিতে আসেননি। এই ফাঁকে আমি রিদিনার সঙ্গে খানিক গল্প করলাম। উচ্চতার বিষয়টি উল্লেখ করেছি; কারণ, রিদিনার হাইট চায়নিজ গড় উচ্চতার চেয়ে বেশি। ডাচদের মতো। চীন ভ্রমণে ভাষার জটিলতায় একেবারে নাস্তানাবুদ হয়ে আছি। সেই দশ বছর আগে যেমনটি পেয়েছিলাম, তেমনি রয়েছে। তাই রিদিনার ইংরেজি শুনে আশ্বস্ত হলাম। নামটিও চায়নিজ নয়। তাই জানতে চাইলাম, ‘হোয়াট ইজ ইউর চায়নিজ নেম?’ বিষয়টি আমি ধরতে পেরেছি বলে বেশ অবাক হলেন রিদিনা। আসলে নেদারল্যান্ডসে বসবাসের কারণে নামের বিষয়টি আমি জানি। চীনারা নিজেদের দুটো নাম রাখেন—একটি চায়নিজ, যা জন্মের সময় দেওয়া হয়; তারপর একটি ইংরেজি নাম। বিশেষভাবে যারা প্রথম বিশ্বের দেশগুলোতে বসবাস করেন কিংবা ট্রাভেল-ট্যুরিজম সেক্টরে যুক্ত। হয়তো উচ্চারণ জটিলতা কমানোর জন্য এরূপ পদ্ধতির অবতারণা হয়েছে। রিদিনার চায়নিজ নাম কৈ মুই।
আমাদের গ্রুপের দশজন জমায়েত হলেন। দেখলাম, হোটেলের বাইরে একটি ট্যুরিস্ট বাস আমাদের জন্য দাঁড়িয়ে রয়েছে। বাসটি বেশ আধুনিক ও পরিচ্ছন্ন। আমাদের দশজনের সঙ্গে গাইড হিসেবে রয়েছেন রিদিনা। পথজুড়ে তিনি নানা তথ্য দিচ্ছিলেন স্টোন ফরেস্ট ও কুনমিংয়ের ইতিহাস সম্পর্কে। আমি ড্রাইভারের পাশের সিটে বসেছি বলে খুব বেশি কানেক্ট করতে পারছিলাম না তার কথার সঙ্গে। আমি আসলে কুনমিং শহর দেখছিলাম। কুয়াশার ফাঁকে ফাঁকে পাহাড়ি পথ বড়ই মনকাড়া। পাহাড়ি পথেও দূরের আধুনিক স্থাপত্য, উড়ালসড়ক বেশ মনোরম। পথের দুধারে ফসলের খেত, ফুলের বাগান দেখতে দেখতে যাচ্ছি। ঘণ্টাদেড়েক পর এলাম গন্তব্যে।
রিদিনা আমাদের একটি চত্বরে রেখে টিকিট কিনতে গেলেন। চত্বরটিও বেশ বড় আর ফুলে ফুলে ভরা। টিকিট করে আসার পর রিদিনার পিছু নিলাম সবাই। টিকিট চেক হওয়ার পর অপেক্ষা করতে লাগলাম একটি বাহনের জন্য। একধরনের শাটল বাহন। স্টোন ফরেস্ট চত্বরটি ঘুরিয়ে দেখানোর জন্য কিছু বাহনের ব্যবস্থা রয়েছে এখানে। কিছু পথ অবশ্য হেঁটে দেখারও রয়েছে। শাটল গাড়িটি দিয়ে যাওয়ার সময় পথের দুপাশে জঙ্গলে ঢাকা পাথর চোখে পড়ল।
গাড়ি এসে থামল একটি নির্দিষ্ট স্থানে। প্রথম গন্তব্য স্টোন পার্ক। এখানে আধুনিক ও পুরোনো জিনিসের মিশেল দেখতে পেলাম। ভূমিতে মাঝেমধ্যে জেগে ওঠা প্রাচীন পাথরখণ্ডগুলো প্রাকৃতিক। কিন্তু পাথরকে ঘিরে সাজসজ্জাগুলো আধুনিক; যেমন কৃত্রিম লেক, মাটিতে বিছানো ঘাস, চারদিকে ফুলের বাগান। আমি খুব বেশি উপভোগ করছিলাম না স্থানটি। সাদা রঙের ব্রিজটি অবশ্য খুব সুন্দর। লেকের পানিতে বেশকতক পাথরখণ্ড রয়েছে। ব্রিজে দাঁড়িয়ে অনেকে নিজের স্মৃতি ধরে রাখলেন। বেশ পর্যটকের সমাগম রয়েছে। ব্রিজের পাড়ে বোট রয়েছে লেকে ঘুরে বেড়াবার জন্য। ব্রিজ ও লেক পেরিয়ে যাওয়ার পর রিদিনা আমাদের একটি বোর্ডের কাছে নিয়ে গেলেন। যেখানে লেখা রয়েছে স্টোন পার্কের ইতিহাস, পাথরের রাজ্য কী করে হয়ে উঠল এই পার্ক। ১৯৩১ সালে ইউনান প্রদেশের তৎকালীন গভর্নর লিং ইউন প্রথম স্টোন ফরেস্ট পরিদর্শনে আসেন। এই গোলকধাঁধার সৌন্দর্যে তিনি অভিভূত হন এবং এই পার্কের নামকরণ করেন ‘দ্য পার্ক অব নেচার’। এই নাম পরে পার্কের একটি পাথরে খোদাই করা হয়। সেই পাথর আরও কিছুটা সামনে গেলে দেখতে পাব। এই পাথরের বাগান যেন পর্যটকেরা উপভোগ করতে পারেন, সে জন্য একটি পথ বা ট্রেইল নির্মাণ করার নির্দেশ দেন তিনি। রিদিনার কাছ থেকে এসব ব্যাখ্যা শোনার পর আরও এগিয়ে গেলাম আমরা।
এক জায়গায় দেখতে পেলাম, চীনা ঐতিহ্যবাহী কিছু পোশাকের প্রদর্শনী। পর্যটকেরা পোশাক ভাড়া করে পরছেন আর ছবি তুলছেন। দাম বেশ চড়া মনে হলো। আমি মোটামুটি কম দামের একটি পোশাক বেছে নিলাম। আমাদের মাঝে চারজন এই একই পোশাক পরলাম। অতঃপর ফটোসেশন। সেই স্থানে একটি বড় পাথর দেখতে পেলাম। রিদিনা পাথরটি দেখিয়ে বললেন, এর নাম ঈগল স্টোন। পাথরের দিকে তাকিয়ে সত্যি মনে হলো, একটি ঈগল যেন পাখা মেলে দাঁড়িয়ে আছে। ফটোসেশনের জন্য আমাদের ১৫ মিনিট সময় বেঁধে দেওয়া হলো। কিন্তু আমরা আধা ঘণ্টা ব্যয় করে ফেলেছি! রিদিনা বারবার তাড়া দিচ্ছিলেন; কেননা, এখনো অনেক কিছু দেখার বাকি।
সেখান থেকে ধীরে ধীরে প্রবেশ করলাম আসল স্থানে। লোকে লোকারণ্য। শুরু হলো স্টোন ফরেস্ট ভ্রমণ। এতক্ষণ ট্রায়াল ছিল আরকি! এই স্থানে একটি পাথরে চায়নিজ ভাষায় লেখা রয়েছে ‘দ্য পার্ক অব নেচার’। পাথর দেখতে দেখতে আমি বারবার দল হারিয়ে ফেলছি। প্রথমে কয়েক মিনিট দাঁড়িয়ে বুঝতে পারছিলাম না কী করব। তারপর রিদিনার হাতে থাকা লাল পতাকা দেখে পিছু নিলাম।
আমার চোখের সামনে চীনের বিখ্যাত ‘স্টোন ফরেস্ট’ বা ‘শিলিন’। ইউনান প্রদেশের রাজধানী কুনমিং থেকে প্রায় ৯০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত এই স্থান প্রকৃতির এক বিস্ময়কর সৃষ্টি। এটি শুধু পর্যটনকেন্দ্র নয়; একটি জীবন্ত ভূতাত্ত্বিক জাদুঘর, যার পেছনে রয়েছে প্রায় ২৭০ মিলিয়ন বা ২৭ কোটি বছরের দীর্ঘ ইতিহাস। স্থানীয়রা এই স্থানকে বলেন ‘শিলিন’, যার অর্থ ‘পাথরের বন’।
ধীরে ধীরে পাথরের ফাঁকে ফাঁকে গলি-তস্যগলি পেরিয়ে কোথায় যাচ্ছি জানি না! মাঝেমধ্যে সিঁড়ি ধরে ওপরে উঠছি; আবার মাঝেমধ্যে কিছুটা নামছি। পাথরের রং ও আকার দেখে চোয়াল ঝুলে যাচ্ছে বারবার! নিজের বিস্মিত হওয়ার অভিব্যক্তি লুকাতে কষ্ট হচ্ছে। বেশির ভাগ সময় নিজেকে আবিষ্কার করছি মুখ হাঁ করা অবস্থায়। টের পাওয়ামাত্রই সামলে নিচ্ছি অবশ্য। এ রকম ঘণ্টাখানেক চলার পর একটু বিশ্রাম নিলাম সবাই। পাথরের ফাঁকে ফাঁকে বসার ব্যবস্থা রয়েছে। এই পুরো চত্বরের শীর্ষ থেকে নাকি পাথরখণ্ডগুলো দেখতে বেশি সুন্দর লাগে, এমনটাই জানালেন রিদিনা। বিশ্রাম নিয়ে আবার চলতে শুরু করলাম।
এই স্টোন ফরেস্ট প্রকৃতির এমন এক টাইম ক্যাপসুল, যা পৃথিবীর অতীত সম্পর্কে জানতে সাহায্য করে। এই বনের চারপাশে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে হাজার হাজার, লক্ষ লক্ষ সুচালো পাথরের স্তম্ভ। কোনোটি দেখতে তলোয়ারের মতো ধারালো, কোনোটি বিশাল আকৃতির পশুর মতো, আবার কোনোটি যেন ধ্যানমগ্ন ঋষি। পুরো চত্বর আদতে পাথরের এক গোলকধাঁধা।
আজ আমরা যে বিশাল পাথরের স্তম্ভগুলো দেখতে পাই, সেগুলো তৈরি হয়েছে লক্ষ লক্ষ, কোটি কোটি বছরের ভূতাত্ত্বিক পরিবর্তন এবং পানি ও বাতাসের নিরলস শিল্পকর্মে। এই জটিল প্রক্রিয়াকে সহজ করে বলার চেষ্টা করা যাক। আজ থেকে প্রায় ২৭০ মিলিয়ন বছর আগে, পারমিয়ান যুগে এই পুরো এলাকা ছিল এক বিশাল সমুদ্রের নিচে। কোটি কোটি বছর ধরে সমুদ্রের তলদেশে সামুদ্রিক প্রাণী, শেওলা, প্রবাল এবং অন্যান্য খনিজ পদার্থ জমে লাইমস্টোন বা চুনাপাথরের এক বিশাল স্তর তৈরি হয়েছে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে, ভূ-আন্দোলনে এই সমুদ্রের তলদেশ ধীরে ধীরে ওপরে উঠতে শুরু করে এবং এক বিশাল মালভূমিতে পরিণত হয়। বৃষ্টি, বাতাস ও পানি এই ক্ষয় প্রক্রিয়ার প্রধান কারিগর। চুনাপাথর তুলনামূলকভাবে নরম হওয়ায় এই পানির প্রবাহ সহজে এর দুর্বল অংশগুলো ক্ষয় করে ফেলে। পাথরের ফাটল বরাবর পানি চুইয়ে ভেতরে প্রবেশ করে এবং ধীরে ধীরে পাথরকে চিনির মতো দ্রবীভূত করতে থাকে। এই নিরন্তর ক্ষয় প্রক্রিয়ার ফলে, পাথরের নরম অংশগুলো ধুয়ে মুছে পরিষ্কার হয়ে যায় এবং কঠিন অংশগুলো স্তম্ভের আকারে দাঁড়িয়ে থাকে। সহজ কথায়, স্টোন ফরেস্ট হলো প্রকৃতির এক বিশাল ভাস্কর্যের বাগান, যার শিল্পী হলো পানি ও বাতাস, আর ক্যানভাস হলো ২৭০ মিলিয়ন বছরের পুরোনো চুনাপাথর।
স্টোন ফরেস্টের কিছু স্থানকে নামকরণ করা হয়েছে মেজর ও মাইনর স্টোন ফরেস্ট, নাইগু স্টোন ফরেস্ট, ঝিইয়ুন গুহা ও লং লেক হিসেবে। মেজর ও মাইনর স্টোন ফরেস্ট পর্যটকদের কাছে সবচেয়ে প্রিয় স্থান। এখানকার পাথরের গঠনগুলো অত্যন্ত ঘন ও উঁচু। এর ভেতরে হাঁটার জন্য সুন্দর রাস্তা তৈরি করা আছে। হাঁটতে হাঁটতে মনে হচ্ছিল, পাথরের গোলকধাঁধায় প্রবেশ করেছি। এখানে প্রতিটি বাঁকে নতুন বিস্ময় অপেক্ষা করছে। কিছু কিছু পাথরকে তাদের আকৃতির জন্য মজার মজার নাম দেওয়া হয়েছে, যেমন ‘গণ্ডারের চাঁদ দেখা’, ‘মা ও ছেলে’ বা ‘পাখির শিকার’। এখানকার সরু পথ আর পাথরের বিশালতা আপনাকে প্রকৃতির শক্তির কাছে নগণ্য অনুভব করাবে।
নাইগু স্টোন ফরেস্ট প্রধান এলাকা থেকে কিছুটা দূরে অবস্থিত। এই অংশ তুলনামূলকভাবে শান্ত ও বন্য। ‘নাইগু’ শব্দের অর্থ হলো ‘কালো’। এখানকার চুনাপাথরে ম্যাগনেশিয়ামের পরিমাণ বেশি থাকায় পাথরগুলোর রং কালচে, যা একে এক গম্ভীর ও রুক্ষ রূপ দিয়েছে। এখানকার পাথরগুলোর গঠন আরও বেশি ধারালো।
ঝিইয়ুন গুহা আদতে এটি একটি বিশাল ভূগর্ভস্থ গুহা, যা লাইমস্টোনের ক্ষয়ের ফলেই তৈরি হয়েছে। এর ভেতরে রয়েছে অসংখ্য স্ট্যালাকটাইট (ছাদ থেকে ঝুলে থাকা পাথরের গঠন) এবং স্ট্যালাগমাইট (মেঝে থেকে গজানো পাথরের গঠন), যা গুহার সৌন্দর্য বহুগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে।
লং লেক বস্তুত পাথরের স্তূপের ভেতরে, প্রায় ৩ কিলোমিটার দীর্ঘ একটি শান্ত ও মনোরম হ্রদ। এর চারপাশের প্রাকৃতিক দৃশ্য এবং শান্ত পরিবেশ পর্যটকদের মন স্নিগ্ধ করে তোলে। এটি কার্স্ট হ্রদ, যা নিচু উপত্যকায় অবস্থিত। এরপর রয়েছে দিয়েশুই জলপ্রপাত। বর্ষাকালে এই জলপ্রপাত তার পূর্ণরূপে আবির্ভূত হয় এবং প্রায় ৯০ মিটার উঁচু থেকে সশব্দে নিচে আছড়ে পড়ে অসাধারণ দৃশ্যের জন্ম দেয়। এখন অবশ্য পানির ধারা দেখতে পাইনি।
এসব দেখতে দেখতে একটি স্টিলের সিঁড়ি ধরলাম আমরা। ওপরে যাচ্ছি তো যাচ্ছি। এখানে বিভিন্ন পাথরে আবার গুল্ম ও লতা জাতীয় উদ্ভিদ জন্মেছে। বেশ অবাক কাণ্ড! লম্বা লম্বা পাথরের শীর্ষে ও গা ঘেঁষে উদ্ভিদ দেখা যাচ্ছে। প্রাণের সঞ্চার খুব অদ্ভুত; কোন খড়কুটো আঁকড়ে ধরে জেগে উঠবে, বলা মুশকিল।
বিশ্রাম নিয়ে নিয়ে শীর্ষে এলাম। পুরো পাথরের রাজ্য আমার চোখের সামনে। পাথরের সুচালো ডগাগুলোকে আরও সুচালো লাগছে। কিছু কিছু জায়গায় একটি পাথরের ওপর আরেকটি ছোট পাথরখণ্ড এমনভাবে রয়েছে যেন এক্ষুনি নিচে পড়ে যাবে। রিদিনা অবশ্য আশ্বস্ত করে জানালেন, এই পাথরগুলো এ রকমই রয়েছে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে।
ওপর থেকে আমরা ধীরে ধীরে নামতে শুরু করলাম। এবার গন্তব্য আশিমা পাথর দেখা। সে এক প্রেম উপাখ্যান বটে! শুধু ভূ-প্রাকৃতিক বিষয় নয়, এই বনের সঙ্গে জড়িয়ে আছে আশিমা নামের এক তরুণীর লোককাহিনিও। তার নামে একটি পাথরের স্তম্ভও রয়েছে। স্টোন ফরেস্টের একটি নির্দিষ্ট পাথরকে ‘আশিমা পাথর’ হিসেবে দেখানো হয়। বলা হয়, এই পাথর দেখতে অবিকল সেই আশিমার মতো, যে নিজের প্রেমিকের জন্য অপেক্ষা করছে। যদি কেউ তার নাম ধরে ডাকে, তবে নাকি পাথরের মধ্য থেকে তার কণ্ঠের প্রতিধ্বনি শোনা যায়! বিজ্ঞানের যৌক্তিক ব্যাখ্যার পাশাপাশি স্থানীয় মানুষের কাছে এই পাথরের বন শুধু কিছু ভূতাত্ত্বিক গঠন নয়; এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে তাদের সংস্কৃতি, ঐতিহ্য ও করুণ লোকগাথা। আশিমা তারই সাক্ষ্য দেয়। স্টোন ফরেস্ট ঘিরে প্রচলিত সবচেয়ে জনপ্রিয় গল্পও এটি।
লোককথা অনুসারে, আশিমা ছিল এক অসামান্য রূপসী ও দয়ালু মেয়ে। আহেই নামের এক সাহসী যুবককে ভালোবাসত সে। কিন্তু এক দুষ্ট ও ক্ষমতাবান ভূস্বামী আশিমার রূপে মুগ্ধ হয়ে তাকে জোর করে বিয়ে করতে চায়। আশিমা রাজি না হওয়ায় ভূস্বামী তাকে অপহরণ করে নিয়ে যায়। আহেই খবর পেয়ে প্রেমিকাকে উদ্ধার করতে ছুটে আসে এবং ভূস্বামীর সঙ্গে এক ভয়ংকর প্রতিযোগিতায় নামে। আহেই তার সাহস ও বুদ্ধিমত্তা দিয়ে ভূস্বামীকে পরাজিত করে আশিমাকে উদ্ধার করে নিয়ে আসে। কিন্তু তাদের মিলন স্থায়ী হয়নি। ফেরার পথে, প্রতিহিংসাপরায়ণ ভূস্বামী ব্যাপক বন্যা সৃষ্টি করে। সেই বন্যার জলে আশিমা ডুবে যায় এবং সেখানেই একটি পাথরে পরিণত হয়।
আশিমার এই হৃদয়বিদারক গল্প এই পাথরের বনকে এক নতুন, মানবিক ও রহস্যময় মাত্রা দিয়েছে। প্রতিবছর চান্দ্র ক্যালেন্ডারের ষষ্ঠ মাসের ২৪ তারিখে, স্থানীয় সানি জনগোষ্ঠী আশিমার সাহস, সৌন্দর্য ও স্বাধীনতার বাসনার স্মরণে টর্চ ফেস্টিভ্যাল আয়োজন করে। এই উৎসবে তারা ঐতিহ্যবাহী পোশাক পরে, লোকসংগীত গায়, নাচে এবং কুস্তি ও ষাঁড়ের লড়াইয়ের মতো বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় অংশ নেয়। এটি তাদের সংস্কৃতির এক জীবন্ত ও বর্ণময় অংশ।
আশিমা পাথর একটি আলাদা চত্বর। এখানে একটি স্যুভেনির ও স্ন্যাকস শপ রয়েছে। ইতিমধ্যে আমরা কিছুটা ক্ষুধার্ত হয়ে পড়েছি। তাই স্ন্যাকস শপ থেকে হালকা নাশতা খেয়ে নিলাম।
স্টোন ফরেস্ট আসলে বিশাল একটি এলাকা। একটি পুরো এলাকা পরিদর্শন করেছি কি না, জানি না। তবে এর গুরুত্বপূর্ণ ও বিশেষ স্থানগুলো দেখেছি, এটুকু হলফ করে বলতে পারি। রিদিনার ভাষ্যমতে অবশ্য আমরা পুরো অঞ্চলই পরিভ্রমণ করেছি। প্রায় ৪০০ বর্গকিলোমিটার এলাকাজুড়ে বিস্তৃত এই বিশাল পাথরের বনকে ২০০৭ সালে ইউনেসকো বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থান হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। চীনের স্টোন ফরেস্ট শুধু কিছু পাথরের সমষ্টি নয়; যেন এটি প্রকৃতির লেখা এক মহাকাব্য!
ছবি: লেখক
