skip to Main Content

কুন্তলকাহন I দেশি বেণির বৈশ্বিক বান

পেছনে টেনে তেল মাখানো পরিপাটি বেণি, এটাই নাকি এখনকার ‘জিম-কোর’ নান্দনিকতার চূড়ান্ত প্রকাশ। অথচ এক দশক আগেও স্কুল করিডরে এই একই চুলের সাজের জন্য শুনতে হতো ‘বেহেন-জি’ তকমা। ফ্যাশনের চক্র আবর্তিত হয়; কিন্তু কে জানত, এই আবর্তন এতটা ব্যক্তিগত হয়ে উঠবে

লম্বা চুলের স্বাস্থ্যরক্ষার প্রথম শর্তই ছিল তেল ও বেণি। পনিটেইল মানে ছিল স্প্লিট এন্ডসের ভয়; আর খোলা চুল মানে ‘নজর’ লাগার চিরাচরিত শঙ্কা! ফলে বন্ধুরা যখন লম্বা উইকেন্ডের পর নতুন ফ্রিঞ্জ কেটে স্কুলে এসে আসর জমাত, তখনো সেই তেলচুপচুপে টান টান বেণিতেই আটকে থাকতে হতো কাউকে না কাউকে।
সময়টা ছিল চলতি শতকের দশের দশক। সে সময় পরিপাটি হয়ে থাকার অলিখিত নিয়ম ছিল কপাল ঢাকা ব্যাঙ্গস আর কাঁধজুড়ে ছড়িয়ে থাকা একরাশ এলোমেলো, ভলিউমনাস চুল। সমাজের সঙ্গে, ট্রেন্ডের সঙ্গে মিশে যাওয়ার এক আপ্রাণ প্রয়াস ছিল তখন। ফ্রেঞ্চ বেণি, ফিশটেইল, ডাচ ব্রেইড, গডেস ব্রেইড—বাদ যায়নি কিছুই। এমনকি বন্ধুদের পাল্লায় পড়ে সেই ভয়ংকর উঁচু ‘পাফ’ করার দুঃসাহসও দেখানো হয়েছিল। কিন্তু ফ্যাশনের অলিখিত বইয়ে লেখা ছিল অন্য গল্প। সেখানে রাজত্ব ছিল মসৃণ স্ট্রেইট অথবা ঢেউখেলানো বাউন্সি চুলের। কে জানত, যে হেয়ারস্টাইলকে স্কুলজীবনে একপ্রকার এড়িয়ে চলার ইচ্ছা ছিল, সেটিই একদিন বেলা হাদিদ, হেইলি বিবারদের হাত ধরে রানওয়ে আর এ-লিস্ট তারকাদের কাছে প্রিয় জিম-কোর ট্রেন্ড হয়ে উঠবে?
ট্রেন্ডের পালাবদল: অ্যাথলিজার থেকে টিকটক
আজ অ্যাথলিজার স্টাইলের জনপ্রিয়তা আকাশছোঁয়া। জিমওয়্যার এখন আর শুধু শরীরচর্চার পোশাক নয়; একটি পূর্ণাঙ্গ লাইফস্টাইল। এর সঙ্গে নিখুঁতভাবে মিশে গেছে পরিপাটি, মসৃণ বেণি। যে বেণিকে একসময় ‘সাদামাটা’ বলা হতো, সেটিই আজ ‘স্লিকড-ব্যাক ব্রেইড’ নামে পরিচিত এবং পরিশীলিত রুচির পরিচায়ক।
গেল বছর টিকটকে ‘হেয়ার অয়েলিং’ ভাইরাল হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এই ধারার পালে নতুন হাওয়া লাগে। ভারতীয় উপমহাদেশের হাজার বছরের পুরোনো এই কেশচর্চা সারা বিশ্বে সমাদৃত হতে শুরু করে। এর হাত ধরেই সেই তথাকথিত ‘বেহেন-জি’ বেণি পরিণত হয় এক স্টেটমেন্ট লুকে। মনে আছে, স্কুলে লাল ফিতা দিয়ে বাঁধা দুটি বেণি করা মেয়েদের দেখে কেমন হাসাহাসি করা হতো? এখন সেই একই লুক ‘কোকেট ব্যাডি’ ভাইব নামে পরিচিত, যা সারল্য আর আত্মবিশ্বাসের অদ্ভুত মিশেল।
এক বেণি, যা পরিশ্রমের প্রতীক
ফিটনেসপ্রেমী, অভিনেতা থেকে মডেল—সকলেই এই লুক আপন করে নিচ্ছেন। কারণ বহুবিধ। প্রথমত, এটি অবিশ্বাস্যভাবে ব্যবহারিক। শরীরচর্চার সময় চুল মুখের ওপর এসে পড়ে না, ঘামে চটচটে হয় না এবং ঘণ্টার পর ঘণ্টা একই রকম পরিপাটি থাকে। দ্বিতীয়ত, এটি চুলের জন্যও স্বাস্থ্যকর। তেল দিয়ে বেণি করে রাখলে চুল গোড়া থেকে মজবুত হয়, ফ্রিজিনেস কমে এবং রুক্ষতার হাত থেকে রক্ষা পায়। তৃতীয়ত, এটি স্টাইলিশ। হাই-এন্ড অ্যাথলিজার পোশাকের সঙ্গে এই মিনিমালিস্টিক হেয়ারস্টাইল একধরনের মার্জিত আবহ তৈরি করে। ঘাম-প্রতিরোধী, লো-মেইনটেন্যান্স এবং আভিজাত্যপূর্ণ এই হেয়ারস্টাইলের প্রেমে না পড়ার কোনো কারণ নেই! তাই সময় এসেছে ফ্রিঞ্জ আর খোলা চুলের ঝক্কিকে বিদায় জানানোর; বিশেষ করে আমাদের মতো ব্যস্ত শহুরের জীবনে, যেখানে মসৃণ চুল ধরে রাখা প্রায় অসম্ভব।
ট্রেন্ডকে নিজের করে তোলা
স্টাইলটি সাদামাটা হলেও এর উপস্থাপনায় বৈচিত্র্য আনা সম্ভব। সে প্রসঙ্গে রইল কয়েকটি জরুরি টিপস।
নিখুঁত স্লিক লুকের জন্য
চুল সামান্য ভিজিয়ে নিয়ে ভালো মানের হেয়ার জেল বা মুজ ব্যবহার করলে সেই মসৃণ, চকচকে ভাব পাওয়া যায়। বেবি হেয়ার সামলাতে একটি স্পুলিতে হেয়ার স্প্রে করে, আঁচড়ে নেওয়া যেতে পারে।
সঠিক তেল ব্যবহার
শুধু নারকেল তেল নয়; চুলের ধরন অনুযায়ী তেল বেছে নেওয়া শ্রেয়। হালকা চুলের জন্য জোজোবা বা আমন্ড অয়েল এবং রুক্ষ চুলে ক্যাস্টর বা অলিভ অয়েল ভালো কাজ করে। তেল সামান্য গরম করে নিলে স্ক্যাল্পে ভালোভাবে শোষিত হয়।
বেণিতে নতুনত্ব
একটিমাত্র মোটা বেণির বদলে দুটি বেণি, বাবল ব্রেইড অথবা ফিশটেইল ব্রেইড করা যেতে পারে। বেণির শেষে রঙিন ফিতা, মেটালিক কাফ বা স্ক্রাঞ্চি যোগ করলে লুকে আসে নতুন মাত্রা।
জিম থেকে পার্টি
একই হেয়ারস্টাইল নিয়ে জিম থেকে পার্টিতে যেতে হলে শুধু চাই সামান্য পরিবর্তন। কানে এক জোড়া স্টেটমেন্ট ইয়াররিংস, ঠোঁটে গাঢ় রঙের লিপস্টিকই যথেষ্ট।
প্রস্তুতি পর্ব: নিখুঁত শুরুর জন্য
এই ‘স্লিকড-ব্যাক ব্রেইড’ বা পরিপাটি বেণির স্টাইলটি দেখতে সহজ হলে নিখুঁতভাবে ফুটিয়ে তুলতে কিছু কৌশল জানা প্রয়োজন। জিম থেকে পার্টি—যেকোনো অনুষ্ঠানের জন্য এই হেয়ারস্টাইলকে কীভাবে আরও আকর্ষণীয় করে তোলা যায়, তার জন্য রইল পরামর্শ।
চুলের ধরন বুঝে প্রস্তুতি
চুল যদি খুব শুষ্ক বা ফ্রিজি হয়, তাহলে স্টাইলিং শুরুর আগে হাইড্রেটিং কন্ডিশনার বা সেরাম ব্যবহার জরুরি। এটি চুল মসৃণ করতে সাহায্য করবে। তৈলাক্ত চুলের ক্ষেত্রে, লাইট-ওয়েট জেল বা মুজ ব্যবহার করলে চুল চিটচিটে না হয়ে পরিপাটি থাকবে।
ভেজা, নাকি শুকনো চুল
পুরোদস্তুর ভেজা চুলে স্টাইলিং না করাই মঙ্গল। চুল প্রায় ৮০% শুকিয়ে যাওয়ার পর বা সামান্য ভেজা অবস্থায় এই স্টাইল করলে সবচেয়ে ভালো ফল মেলে। এতে চুল মসৃণভাবে আঁচড়ানো যায় এবং স্টাইলিং পণ্য ভালোভাবে কাজ করে।
সিঁথির গুরুত্ব
এই স্টাইলের সৌন্দর্য অনেকটাই নির্ভর করে নিখুঁত সিঁথির ওপর। র‌্যাট-টেইল চিরুনি (সরু হাতলযুক্ত) ব্যবহার করে মাঝখানে বা পাশে পরিষ্কার একটি সিঁথি কাটলে লুকে পেশাদার ছোঁয়া আসে।
পেশাদার স্টাইলিং কৌশল
সঠিক ব্রাশ ব্যবহার
চুল পেছনে টেনে বাঁধার জন্য সাধারণ চিরুনি নয়; বরং ‘বোর ব্রিসল ব্রাশ’ ব্যবহার করলে উড়ো চুল বা বেবি হেয়ার সহজে বসে যায় এবং একটি মসৃণ ফিনিশ আসে।
প্রসাধনের সঠিক লেয়ারিং
হেয়ারস্টাইলকে দীর্ঘস্থায়ী করতে কয়েকটি পণ্য ধাপে ধাপে ব্যবহার করা চাই। প্রথমে সেরাম, তারপর হেয়ার জেল বা মুজ এবং সবশেষে একটি ফ্লেক্সিবল হোল্ড হেয়ার স্প্রে ব্যবহার করলে চুল ঘণ্টার পর ঘণ্টা একই রকম থাকবে।

বাবল ব্রেইড
সাধারণ বেণির বদলে আরও আধুনিক লুক চাইলে বাবল ব্রেইড চেষ্টা করা যেতে পারে। পনিটেইল বেঁধে এক বা দুই ইঞ্চি পরপর ছোট ছোট স্বচ্ছ বা রঙিন ইলাস্টিক ব্যান্ড দিয়ে বাঁধুন এবং মাঝের অংশগুলো আঙুল দিয়ে হালকা টেনে ফুলিয়ে দিন। এটি খুব সহজ; কিন্তু দেখতে দারুণ স্টাইলিশ।
নতুনত্ব ও ব্যক্তিগত ছোঁয়া
স্টাইলে নতুনত্ব আনতে এবং নিজস্ব ছোঁয়া নিশ্চিত করতে কিছু কৌশল অবলম্বন করা যেতে পারে।
 সাদামাটা বেণিকেও আকর্ষণীয় করে তোলা যায় সঠিক অ্যাকসেসরিজের মাধ্যমে।
 বেণির মাঝে বা শেষে গোল্ডেন বা সিলভার মেটালিক কাফ যোগ করলে লুকে আধুনিকতা আসে।
 বেণির সঙ্গে একটি সরু রেশমি ফিতা বা স্কার্ফ জড়িয়ে নিলে বোহিমিয়ান বা রোমান্টিক লুক তৈরি হয়।
 বেণির ওপর দিয়ে হেয়ার চেইন পরলে একটি জমকালো ভাব আসে, যা সন্ধ্যাকালীন অনুষ্ঠানের জন্য উপযুক্ত।
 মুখমণ্ডলের দুই পাশ দিয়ে চুলের দু-একটি সরু গোছা বের করে রাখলে কঠোর, টানা টানা লুকের পরিবর্তে একটি কোমল ও রোমান্টিক ভাব আসে।
যত্ন ও রক্ষণাবেক্ষণ
স্ক্যাল্পের যত্ন
এই হেয়ারস্টাইল যেহেতু চুল টেনে করা হয়, তাই প্রতিদিন একটানা এর প্রয়োগ ঘটালে চুলের গোড়া দুর্বল হতে পারে। তাই সপ্তাহে কয়েক দিন চুলকে বিশ্রাম দেওয়া শ্রেয়। বেণি খোলার পর আঙুল দিয়ে আলতো করে স্ক্যাল্প মাসাজ করলে রক্তসঞ্চালন বাড়বে।
রাতের যত্ন
যদি তেল দিয়ে বেণি করে রাতে ঘুমানোর পরিকল্পনা থাকে, তবে একটি সিল্ক বা সাটিনের স্কার্ফ বা বনেট দিয়ে চুল ঢেকে নিলে ঘুমের সময় ঘষা লেগে চুল ভেঙে যাওয়ার ঝুঁকি থাকে না।
বেণি খোলার পর
বেণি খোলার পর চুলে যে স্বাভাবিক ঢেউ তৈরি হয়, সেটিকেও একটি নতুন স্টাইল হিসেবে কাজে লাগানো সম্ভব। পরের দিন চুল না ধুয়ে সামান্য ড্রাই শ্যাম্পু ব্যবহার করে সেই ‘ব্রেইড ওয়েভস’ নিয়ে বেরিয়ে পড়া যেতে পারে।

 স্বর্ণা রায়
মডেল: প্রমা
মেকওভার: পারসোনা
ছবি: জিয়া উদ্দীন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top