বাংলাদেশের প্রথিতযশা নজরুলসংগীতশিল্পী ফিরোজা বেগম। আজ তাঁর জন্মদিন। ১৯৩০ সালের এই দিনে তিনি গোপালগঞ্জের রাতইল ঘোনাপাড়া গ্রামে সম্ভ্রান্ত মুসলিম জমিদার পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। এরপর তিনি তাঁর জীবদ্দশায় নজরুলসংগীতে অসামান্য অবদান রেখে ২০১৪ সালের ৯ সেপ্টেম্বর রাত ৮টা ২৮ মিনিতে কিডনি-সংক্রান্ত অসুস্থতার কারণে ঢাকার অ্যাপোলো হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন।
ফিরোজা বেগম ভারতীয় উপমহাদেশে নজরুলসংগীতের জন্য বিখ্যাত হয়ে আছেন। ভারতীয় উপমহাদেশের পরবর্তী প্রজন্মের কাছে তিনি বাংলা সংগীতের প্রতীকী রূপে অবিনশ্বর হয়ে আছেন।
শৈশব থেকেই ফিরোজা বেগম ছিলেন সংগীতানুরাগী। ১৯৪০-এর দশকে সংগীত ভুবনে পদার্পণ করেছিলেন ফিরোজা বেগম। ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়াকালীন অল ইন্ডিয়া রেডিওতে গান পরিবেশন করেছিলেন। মাত্র দশ বছর বয়সে তিনি কাজী নজরুল ইসলামের সান্নিধ্যে এসেছিলেন এবং তিনি তাঁর কাছ থেকে তালিম গ্রহণ করেছিলেন।
১৯৪২ সালে ১২ বছর বয়সে বিখ্যাত গ্রামোফোন কোম্পানি এইচএমভি থেকে ৭৮ আরপিএম ডিস্কে ইসলামি গান নিয়ে তাঁর প্রথম রেকর্ড বের হয়েছিল। এর কিছুদিন পরই কমল দাশগুপ্তের তত্ত্বাবধানে উর্দু গানের রেকর্ড করেন তিনি। এ রেকর্ডের গানগুলো ছিল- ‘ম্যায় প্রেম ভরে, প্রীত ভরে শুনাউ’ আর ‘প্রীত শিখানে আয়া’ ইত্যাদি।
নজরুলের গান নিয়ে প্রকাশিত তাঁর প্রথম রেকর্ড বের হয় ১৯৪৯ সালে। কাজী নজরুল ইসলাম অসুস্থ হওয়ার পর ফিরোজা বেগম নজরুলসংগীতের শুদ্ধ স্বরলিপি ও সুর সংরক্ষণের ব্যবস্থা করেছিলেন।
১৯৫৪ সালে তিনি কলকাতায় বসবাস শুরু করেছিলেন। পরের বছর তিনি কমল দাশগুপ্তের সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। কমল দাশগুপ্ত ছিলেন একাধারে সুরকার, গায়ক ও গীতিকার। ১৯৬৭ সালে ঢাকায় ফিরে আসেন এই দম্পতি। তারপর ১৯৭৪ সালের ২০ জুলাই কমল দাশগুপ্ত পরলোকগমন করেন। এ দম্পতির রয়েছে তিন সন্তান। তাহসিন, হামীন ও শাফীন। হামিন ও শাফিন- উভয়েই বর্তমানে রকব্যান্ড দল ‘মাইলস’-এর সদস্য।
পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ফিরোজা বেগম ৩৮০টির বেশি একক সংগীতানুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করেছিলেন। নজরুলসংগীত ছাড়াও তিনি আধুনিক গান, গজল, কাওয়ালি, ভজন, হামদ, নাতসহ বিভিন্ন ধরনের সংগীতে কন্ঠ দিয়েছেন। তিনি তাঁর জীবদ্দশায় ১২টি এলপি, চারটি ইপি, ছয়টি সিডি ও ২০টির বেশি অডিও ক্যাসেট প্রকাশ করেন।
শিল্পচর্চায় অসাধারণ অবদানের জন্য ১৯৭৯ সালে ফিরোজা বেগম দেশের ‘সর্বোচ্চ বেসামরিক পুরস্কার’ হিসেবে পরিচিত ‘স্বাধীনতা পুরস্কার’ লাভ করেন। এ ছাড়া তিনি ‘একুশে পদক’, ‘নেতাজী সুভাষ চন্দ্র পুরস্কার’, ‘সত্যজিৎ রায় পুরস্কার’, ‘নাসিরউদ্দীন স্বর্ণপদক’, ‘বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমী স্বর্ণপদক’, ‘সেরা নজরুল সঙ্গীতশিল্পী পুরস্কার’, ‘নজরুল একাডেমি পদক’, ‘চুরুলিয়া স্বর্ণপদক’ এবং বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্মানসূচক ‘ডিলিট’ লাভ করেন।
এসব ছাড়াও ফিরোজা বেগম জাপানের অডিও প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান সিবিএস থেকে গোল্ড ডিস্ক, ২০১১ সালে মেরিল-প্রথম আলো আজীবন সম্মাননা পুরস্কার অর্জন করেন। ২০১২ সালের ১২ এপ্রিল তিনি পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছ থেকে ‘বঙ্গ সম্মান’ পুরস্কার গ্রহণ করেন।