সেলুলয়েড I দত্ত ভার্সেস দত্ত
অঞ্জন দত্ত। চলচ্চিত্র, সংগীত, থিয়েটারসহ বাংলার শিল্প-সংস্কৃতিতে মধ্যে একটি উজ্জ্বল নাম। কলকাতাকেন্দ্রিক বাংলা চলচ্চিত্র ও সংগীতে অঞ্জন দত্ত একটি বিশেষ ধারাও বলা যেতে পারে। অঞ্জন দত্ত মানেই দার্জিলিং, উত্তর-মধ্য কলকাতার আলো-আঁধারি শহুরে জীবন, বাংলা গানের মধ্যে অবলীলায় ঢুকে পড়া এলভিস প্রিসলি, জন লেনন, বব ডিলানদের জগৎ কিংবা মৃণাল সেনের ছবির গুরুত্বপূর্ণ অভিনেতা। অঞ্জন দত্ত মানেই বাংলা চলচ্চিত্রের নিউ ওয়েভের ধারাকে এগিয়ে নিয়ে চলা…
আর এসবই সবচেয়ে বেশি করে পূর্ণতা পেয়েছিল তার সেমি-অটোবায়োগ্রাফিক ফিল্ম বা প্রায়-আত্মজীবনীমূলক ছবি ‘দত্ত ভার্সেস দত্ত’ ছবিতে। দার্জিলিং ছেড়ে চলে আসা, ব্যারিস্টার বাবা ও ফিউডাল ফ্যামিলি, সত্তর দশক ও নকশালবাড়ি আন্দোলন, সত্তর দশকের ভেতর দিয়ে কলকাতায় ঢুকে পড়া বিট জেনারেশনের কালচারাল মুভমেন্ট ও তাদের গান, ফ্রান্সের ন্যুভেলবার্গ ফিল্ম মুভমেন্ট, গোদার-ত্রুফো, কলকাতার মৃণাল সেন, বাদল সরকার, শ্রেণিশত্রু খতমের রাজনীতি, গ্রাম দিয়ে শহর ঘেরার স্বপ্ন…
ছবিতে দেখা যায়, সেইন্ট পলস স্কুলে টানা আড়াই বছর ফি দিতে না পারার কারণে দার্জিলিং থেকে কলকাতায় চলে আসতে হয় দত্ত পরিবারের সন্তান রণদীপ দত্তকে। তার বাবা বীরেন দত্তের (অঞ্জন দত্ত) আইন ব্যবসায় টান। একটাও মক্কেল নেই। কিন্তু বনেদিয়ানা রয়েছে। কাবুলিওলার কাছ থেকে ধার করে সংসার চালাচ্ছেন। এ ছাড়া রণদীপ কলকাতায় বাড়ি ফিরে দেখে, তার জ্যাঠার সঙ্গে বাবার সম্পত্তি নিয়ে বিবাদ, তা নিয়ে চলে নিত্যদিন ঝগড়াঝাঁটি। মা মদ্যপ, আরও জানতে পারে, দূরসম্পর্কের এক কাকার (শঙ্কর চক্রবর্তী) সঙ্গে মা ও দিদি (অর্পিতা চ্যাটার্জি) দুজনেরই প্রেম চলছে। রণদীপের বাবা তাকে ব্যারিস্টারি পড়াতে চাইলেও সে চায় ফিল্মের অভিনেতা হতে। ইন্টারন্যাশনাল ফিল্ম, থিয়েটার, মিউজিক নিয়ে চর্চা করে- এমন বন্ধুও জুটে যায় তার। পরিচয় হয় ডায়না নামের এক মেয়ের সঙ্গে। তার প্রেমে পড়ে রণদীপ। একদিন জানতে পারে স্থানীয় এক নকশাল নেতাকে (কৌশিক সেন) বিয়ে করেছে দিদি। জানতে পারে, বাবার একমাত্র মক্কেল রুনু মাসির সঙ্গে পরকীয়ার কথা। হঠাৎ একদিন দেখে ছোটবেলার এক বন্ধু, যে কিনা মদ-গাঁজা আর ইয়াঙ্কি কালচারে মেতে ছিল, সে নকশাল হয়ে গেছে। তাকে নিজের বাড়িতে শেল্টার দেয় রণদীপ। তার খোঁজে পুলিশ আসে বাড়িতে। রণদীপের বাবা পুলিশকে বাড়িতে না ঢুকতে দিলে ওই জাঁদরেল ব্যারিস্টার তথা বনেদি কংগ্রেসিকেই তালতলা থানায় তুলে নিয়ে গিয়ে তার ওপর রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস চালায় পুলিশ। কয়েক দিন পর তিনি ছাড়া পান, কিন্তু বাক্শক্তি নষ্ট হয়। সংসারের হাল ধরে রণদীপের জ্যাঠা (বিশ্বজিৎ চক্রবর্তী) এরই মধ্যে দিয়ে রণদীপের বেড়ে ওঠা, ক্রমে মৃণাল সেনের ছবিতে অভিনয়ের সুযোগ- এভাবেই এগিয়েছে ন্যারেটিভ।
এই ছবিতে উঠে এসেছে সত্তর দশকের কলকাতা। ছবির সেট, লোকেশন থেকে শুরু করে চরিত্রদের সাজসজ্জা, পোশাক- সবেতেই সময়ের চিহ্ন ধরা পড়েছে। ঘর-গেরস্থালির গৃহবধূর আটপৌরে শাড়ি থেকে শুরু করে পার্টিতে যাওয়া রণদীপের মায়ের (রীতা কয়রাল) পোশাক বনেদি শাড়ি আর মাথায় খোঁপা আর আধুনিক রুনু মাসির (রূপা গাঙ্গুলী) সিফন শাড়ি, স্লিভলেস ব্লাউজ, ডায়নার (পার্নো মিত্র) স্কার্ট, টপ, কাঁধ অবধি স্ট্রেইট হেয়ার কাট- সব মিলিয়ে যথাযথ। আর নকশালপন্থীদের খাদির পাজামা-পাঞ্জাবি, রণদীপের বাবা বীরেন দত্ত (অঞ্জন দত্ত) গাউন, ব্লেজার, বো, বিস্কোয়ার-ওয়াই ব্যাক বেল্ট সহযোগে সাহেবি বাবুয়ানা দারুণ। রণদীপের পোশাক ছবির পর্বের সঙ্গে চেঞ্জ হয়েছে, দার্জিলিংয়ে ফরমাল প্যান্ট শার্ট, কলকাতায় কখনো ক্যাজুয়াল শার্ট ভেতরে টি-শার্ট, কখনো পার্টি ড্রেসে ব্লেজার-প্যান্ট ইত্যাদি। তবে সত্তর দশক এই সময়টা তার পোশাকেও দারুণভাবে কথা বলেছে।
অভিনয়ে বীরেন দত্তর চরিত্রে অঞ্জন দত্ত অসাধারণ, রণদীপ দত্তর চরিত্রে তরুণ অভিনেতা রণদীপ বসুর অভিনয়ও দারুণ। রীতা কয়রাল, অর্পিতা চ্যাটার্জি দারুণ। পার্নো মিত্র, রূপা গাঙ্গুলী, কৌশিক সেন, বিশ্বজিৎ চক্রবর্তীসহ প্রত্যেকের অভিনয়ই সুন্দর। রণদীপের দাদুর চরিত্রে দীপঙ্কর দে আর পাগল কাকার চরিত্রে শুভাশিস মুখোপাধ্যায় অল্প পরিসরেই দারুণ অভিনয় করেছেন। ছবির ক্যামেরা, মিউজিক, এডিটিং- সবই মানসম্মত। বাবা ও ছেলের প্রেক্ষাপট, পছন্দ, দৃষ্টিভঙ্গির পার্থক্য; পরিশেষে বাবাসহ গোটা পরিবার এবং নিজের শহরের প্রতি অঞ্জন দত্ত তাঁর শিকড়ের টানকে এই ছবিতে প্রকাশ করেছিলেন।
অতনু সিংহ
কুইজ
১। ছবিতে অঞ্জন কোন চরিত্রে অভিনয় করেছেন?
ক. সুজয় দত্ত খ। প্রদীপ দত্ত গ। বীরেন দত্ত
২। রণদীপের বান্ধবীর নাম কী?
ক. ডায়না খ। প্রিয়াঙ্কা। গ। মল্লি
৩। ছবিতে রূপা গাঙ্গুলী কোন চরিত্রে অভিনয় করেছেন?
ক. রণদীপের মা খ। রণদীপের মাসি। গ। রণদীপের বান্ধবীর মা
গত সংখ্যার বিজয়ী
১. জাকিয়া পারভীন, শুক্রাবাদ, ঢাকা।
২. নাজনীন নাহার, চাষাঢ়া, নারায়ণগঞ্জ।
৩. তুষার হালদার, কোটবাড়ী, কুমিল্লা।