ফিচার I নানান পেশায় নারী
লোকে বলে, অমুক পেশায় নারী ভালো করবেন। কিংবা নারীর জন্য ওই পেশাটাই ভালো। কিন্তু নারীর পেশা নির্ধারণ করবে কি অন্যরা, নাকি সে নিজে? বিভিন্ন পেশায় নিয়োজিত নারীর সঙ্গে কথা বলে লিখেছেন রুম্পা সৈয়দা ফারজানা জামান
স্বনামধন্য একটি প্রতিষ্ঠানে কিছুদিন আগে মাতৃত্বকালীন ছুটির মেয়াদ বাড়িয়ে নয় মাস করা হয়। সেটা নিয়ে সামাজিক মাধ্যমে যখন প্রশংসার ঝড়, তখনই একজন নারী সেখানে মন্তব্য করেন, ‘ফিরে আসার পর অবধারিত টার্মিনেশন। কারণ, ওই সময়ে তার কাজ নেই, মাতৃত্বকালীন ছুটির কারণে তার কাজের মানও একেবারে শূন্য থাকবে।’ এই মন্তব্যের পর নড়েচড়ে বসেন আরও কয়েকজন। এমন ভুক্তভোগীর অভাব নেই এই দেশে। অনেকের অভিযোগ, এই চর্চাটা করপোরেট জগতে চলছে অনেক আগে থেকেই আড়ালে-আবডালে।
নারী- বিশেষ করে যারা এত বাধা আর প্রতিকূলতার মধ্যেও নিজেদের এগিয়ে নিতে চায়, তাদের পেছনটা টেনে ধরে কখনো অসহযোগিতা, কখনো অবমূল্যায়ন এমনকি মাতৃত্বও। কারণ, একটা সময়ের পর নারীকে কোনো না কোনো ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে পরিবারকেই বেছে নিতে হয়, তার কর্মস্থলের পরিবেশ বৈরী হওয়ার কারণে। ফলে নারীকে বেঁধে দেওয়া হয় এমন সব পেশায়, যেগুলোকে একপর্যায়ে আখ্যায়িত করা হয় ‘নারীর পেশা’ হিসেবে। এমনকি বিশ্ববিদ্যালয় বা স্কুলেও এমন কিছু বিষয় আছে যেগুলোকে বলা হয় ‘মেয়েদের বিষয়’। এই যে ভাগাভাগি এবং জন্ম থেকেই নারীকে একটি সনাতন ধারায় আটকে ফেলা, তার রূপ আজও বদলায়নি। তবু নারী এগিয়ে চলেছে। সমাজ পেছন থেকে টেনে ধরলেও নিজেকে ছাড়িয়ে নিচ্ছে প্রতিদিন। ‘মেয়েদের পেশা’র সামাজিক ব্র্যাকেট থেকে বের হয়ে নানা ধরনের পেশায় নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করে চলেছে।
কেবল চলছে না, উড়ছেও। পৃথুলা রশীদের নাম অনেকেরই জানা। নেপালে উড়োজাহাজ দুর্ঘটনার সময় কো-পাইলট ছিলেন তিনি। মৃত্যুবরণ করেন ঘটনাস্থলে। এরপর সমালোচনা শুরু হয় নারী আসলেই উড়তে পারে কি না। কোনো জবাব তারা দেয়নি। কিন্তু করে দেখিয়েছে। ২০১৮ সালের ২৪ ডিসেম্বর প্রথমবারের মতো একজন নারী পাইলটের পরিচালনায় বাংলাদেশ বিমানের একটি ড্রিমলাইনার উড়ে গেছে ঢাকা থেকে রিয়াদে। এই ফ্লাইটের ফার্স্ট অফিসারও ছিলেন একজন নারী। এটা শুরু নয়। এর আগে জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা মিশনে নারী পাইলট যোগ দিয়েছেন। এই সূচনাও হালের নয়। সৈয়দা কানিজ ফাতেমা রোকসানা বাংলাদেশের সরকারি বিমান সংস্থা বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের প্রথম নারী বৈমানিক। তিনি ক্যাপ্টেন পদাধিকারী ছিলেন। ১৯৭৭ সালে তিনি বাণিজ্যিক বিমান পরিচালনার সনদ লাভ করেন! যারা পৃথুলাকে নিয়ে সমালোচনা করেছিলেন, তারাই পরে আবার নারী বৈমানিকদের প্রশংসায় মুখরিত হয়েছেন। নারীরা প্রমাণ করেছেন কী করে নিজের যোগ্যতা দিয়ে সকল সমালোচনার মুখ বন্ধ করতে হয়। একই কথা বলেন উন্নয়নকর্মী নাজিয়া আফরোজ, ‘সমস্যা কাজের ধরনে বা কাজের ব্যাকরণে নয়, সমস্যা হলো মানসিকতায়। আমাদের সমাজে ধরেই নেওয়া হয় কিছু কিছু কাজ মেয়েরা করতে পারবে না।
অথচ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ঘুরে নারীরা গবেষণা, মানবিক উন্নয়নে কাজ করেই চলেছে। তবু ইন্টারভিউর সময় জানতে চাওয়া হয়, কাজটি আপনি করতে পারবেন কি না, ঢাকার বাইরে যেতে পারবেন কি না ইত্যাদি।’ নাজিয়া আরও যোগ করেন, ‘আমরা যারা উন্নয়ন সেক্টরে কাজ করি, জব ডেসক্রিপশন দেখেই যাই। এ ধরনের অবান্তর প্রশ্ন কিন্তু ইন্টারভিউ টেবিলে একজন নারীকে অপ্রস্তুত করে।’ তরুণ কর্মজীবী সোনিয়া বলেন, ‘সবচেয়ে খারাপ লাগে যখন প্রশ্ন করা হয়Ñ বিয়ে করবেন কবে, বাচ্চা নেবেন কবে। আমার মনে হয় এসব প্রশ্ন খুবই ব্যক্তিগত। বরং আমার গবেষণা ও অর্জন নিয়ে প্রশ্ন করলেই আমি খুশি হতাম।’ আরেক উন্নয়নকর্মী সারা রাত একটি এফএম স্টেশনের অনুষ্ঠানে বলেন, ‘নারীদের বড় বড় পদ দেওয়া হলেও সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতাকে অবমূল্যায়ন করা হয়। আমি অবাক হয়ে যেতাম যখন আমারই এক সহকর্মী কোনো কথা আমার চোখের দিকে তাকিয়ে বলতে পারতেন না।’ নাজিয়া আফরোজ এই প্রসঙ্গে আরও বলেন, ‘সিদ্ধান্ত নেওয়া বা পদের সঙ্গে মিলিয়ে কাজ করার বিষয়টা পুরুষেরা আজও মেনে নিতে পারেননি। তাই আমার মনে হয় ঝামেলা আসলে মানসিকতায়।’
একই সুরে কথা বলেন উপস্থাপিকা শ্রাবণ্য তৌহিদা। তিনি চিকিৎসক, মিডিয়াকর্মী এবং একজন মা। মিডিয়াতে সবাই তাকে এখন চেনেন খেলার অনুষ্ঠানের সঞ্চালক হিসেবে। যে কারণে তাকে সমালোচনার শিকার হতে হয়েছে। শ্রাবণ্য হেসে বলেন, ‘মেয়েরা খেলা বোঝে না- এই একটা অদ্ভুত ধারণা আমাদের আছে। এমনকি ট্রলও দেখেছি এসব নিয়ে। যখন খেলার চুলচেরা বিশ্লেষণ শুরু করলাম, সবাই এটাসেটা বলেছে। আমি শুধু আমার কাজ করে গেছি। একটা পর্যায়ে তারা মানতে বাধ্য হয়েছে যে মেয়েরা খেলা তো বোঝেই, সমালোচনাও করতে পারে। আর খেলার মাঝেই-বা কেন এত লিঙ্গবৈষম্য? ভক্ত শব্দটির তো কোনো লিঙ্গবিভেদ নেই।’ শ্রাবণ্যর কথার সত্যতা প্রমাণ করে চ্যানেলে চ্যানেলে নারী ক্রীড়া সমালোচকদের উজ্জ্বল উপস্থিতি।
বিজ্ঞাপনী সংস্থার ফিল্মমেকার, ভারতের পুনে থেকে সনদপ্রাপ্ত কাজী রওশন জাহান রত্না বলেন, ‘এখনো মানুষ বুঝতেই চায় না যে আমরা দিনরাত কাজ করতে পারি। সারা জীবন ধরে যদি যোগ্যতার প্রমাণ দিতে হয়, তাহলে মনের আনন্দে কাজটা করতে পারবো কখন!’
কাজী রত্নার মতোই বিভিন্ন পেশার নারীরা মনে করেন, কর্মক্ষেত্রে বৈষম্য কেবল ন্যায্য পারিশ্রমিক থেকে বঞ্চিত করা নয় বা যৌন হয়রানি নয়। বরং আরও বিস্তৃত। যৌন হয়রানি তো রয়েছেই। কেবল নারী বলেই। একই কথা বলেন এ সময়ের তরুণ বিজ্ঞাপন নির্মাতা রাকা নওশীন নাওয়ার। সম্প্রতি একটি টেলিকম কোম্পানির বিজ্ঞাপন করে সাড়া জাগানো এই পরিচালক বলেন, ‘একটা টার্মই আছে ডিরেক্টরদের জন্য, সেটা হলো “ডিরেক্টর স্যার”। এবং সেটা বিশ্বব্যাপী। অতএব ধরেই নেওয়া যায়, শুধু বাংলাদেশ বা উপমহাদেশে নয়, সারা বিশ্বেই নারীর সব ধরনের পেশায় নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার ব্যাপারে সংশয় আছে। অথচ এমন কোনো পেশা নেই যেখানে নারীর পদচারণ হয়নি। এই যে আমি বিজ্ঞাপন বানাই, এখানে কোনো সমস্যা চোখে না পড়লেও মানসিকতার টানাপোড়েন চলে আসেই। যেমন আমি মেয়ে বলে সবাই ধরেই নেয় মেয়েদের প্রডাক্ট, যেমন মেকআপ, আনুষঙ্গিক- এগুলোর বিজ্ঞাপন ভালো বানাবো। এই বৈষম্যটা আসলে শিক্ষা থেকেই আসে। অথচ আমি যখন পড়েছি তখন ফিল্ম মেকিংয়ে নারী বা পুরুষের কোনো বিভেদ দেখিনি। কিন্তু কাজ করতে গিয়ে সেটা দেখছি।’
রাকা, রত্না, নাজিয়া বা শ্রাবণ্যর মতো পেশার সনাতনি ধারা ভেঙেছেন এ দেশের সরকারপ্রধান, বিরোধী দলের প্রধান, সংসদের স্পিকার নারী। বাংলাদেশের নারী বিদেশের সংসদে সদস্যপদ পেয়েছেন। এ দেশেরই আরেক নারী নাজমুন নাহার নিজ উদ্যোগে ১২৫ দেশ ভ্রমণ করেছেন। এই ভূখ-ের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে প্রধানের ভূমিকায় আছেন নারীরা। তাই তরুণ নারীরা বিশ্বাস করেন, কেবল নারীদের নয়, পুরুষদেরও সচেতন করবেন নারীর কর্মযজ্ঞে সারথী হতে। নিজের সন্তানকে ছোটবেলা থেকেই কাজে-শিক্ষায় এমনকি খেলার মাঠেও যেন লিঙ্গবৈষম্য না শেখানো হয়, সেদিকে লক্ষ রাখবেন। এবং মনে করেন পুরুষেরাও যেন নারীকে কেবল কয়েকটি পেশার জালেই না আটকে ফেলেন, সে ব্যাপারে সচেতন হওয়ার সময় এসেছে। কেবল যৌনসন্ত্রাসহীন পরিবেশ নয়, নারীর কর্মক্ষেত্র যেন মেধার অনুকূল হয় এই কামনাই করেন আজকের দিনের মিডিয়াকর্মী, সাংবাদিক, বৈমানিক, সৈনিক, চিকিৎসক, লেখকসহ নানা পেশায় মাথা উঁচু করে নিজেকে প্রমাণ করতে থাকা নারীরা।
নিজের যোগ্যতায়, চেষ্টায় নারী এগিয়ে গেছে, এগিয়ে যাচ্ছে এবং তৈরি করছে উদাহরণ- অন্য নারীর জন্য এবং সব পুরুষের জন্য। প্রমাণ করছে নারীর পেশার নির্ধারক সে নিজেই। কেননা, যে কাজে তার অংশগ্রহণ, তাতেই সে সফল হচ্ছে।
ছবি: সংগ্রহ