ফিচার I সেথা একঘর পড়শি বসত করে
কলকাতার জনজীবনে বহু বছর ধরে মিশে থাকা কাবুলিওয়ালারা নিজেদের সংস্কৃতি থেকে অবিচ্ছিন্ন আজও। কেমন তাদের ইফতার আর ঈদ? লিখেছেন অতনু সিংহ
এমন কিছু নগর আছে, যেগুলোর ভেতর থেকে যায় অনেক শহরের নিদর্শন। নতুন করে সেজে ওঠা বিশ্বায়িত কলকাতার অন্দরে আজও কেবলই দৃশ্যের জন্ম হয়। কারণ, এখনো জীবিত রয়েছে হরেক রকম সংস্কৃতি, পেশা ও অর্থনৈতিক সম্পর্কের মানুষ। তাই এখনো উত্তর আর মধ্য কলকাতার আলো-আঁধারি অলিগলিতে নানা রকম টোনাল ফ্রেম তৈরি হয়ে চলে। একই সঙ্গে উৎসব, আচার আর জীবনপ্রণালিতে জ্যান্ত থাকে শহর। পড়শির দিনযাপনের ভেতর থেকে উপমহাদেশ কথা বলে ওঠে কসমোপলিটন কলকাতায়।
যেমন পবিত্র রমজান মাসের চিত্র। পশ্চিমবঙ্গের বাঙালি মুসলমানের একটা অংশের পাশাপাশি উত্তর ও মধ্য ভারতীয় মুসলিমদের জন্য ইফতারের পসরায় সেজে ওঠে কলকাতার রাস্তা আর অলিগলি। নির্জন রাস্তায় দেখা যায় তারাবিহ পড়ে ফিরে আসছেন মুসল্লিরা। সেহ্রির আগে মুসলমানদের বাড়ির আলো জ্বলে ওঠে। কিন্তু চেনা কলকাতার মধ্যে যেমন আরও অনেক কলকাতা আছে, তেমনই চেনা রমজান মাস ঘিরে ধর্মাচারের পরিচিত ছবির পাশাপাশি আছে আরও কিছু ছবি। কিছু দৃশ্য আজও জ্যান্ত হয়ে রয়েছে খান সাহেবদের জন্য। যারা এসেছিলেন সুদূর আফগানিস্তান থেকে। তাদের নিয়ে ছোটগল্প লিখেছেন রবীন্দ্রনাথ আর তা অবলম্বনে চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছেন তপন সিনহা। হ্যাঁ, তাদের আমরা বলি কাবুলিওয়ালা। কলকাতায় খান সাহেব নামে তাদের কদর। যারা একসময় শহরের অলিগলিতে ঘুরতেন রান্নার সুগন্ধি মসলা, আতর কিংবা পোশাক নিয়ে। অবশ্য আজও তারা ঘুরে বেড়ান। পাশাপাশি যাদের হাত দিয়ে এখনো সচল ব্যাংকিং ব্যবসার পুরোনো রূপ। আজও মাথায় পাগড়ি আর গায়ে জোব্বা পরা কাবুলিওয়ালারা চোখে সুরমা লাগিয়ে ঘোরেন কলকাতার অলিগলি ধরে।
কলকাতার রমজান মাস ও ঈদ আরও বর্ণময় হয়ে ওঠে এই কাবুলিওয়ালাদের পাড়ায় পাড়ায়। মধ্য কলকাতার পার্ক স্ট্রিটের পেছনে বাটামোড় ছুঁয়ে গোটা রফিক আহমেদ কিদওয়াই রোড, রিপন স্ট্রিট, পার্কসার্কাসের ফিলিপস মোড়, বাংলাদেশ ডেপুটি হাইকমিশন অফিসের আশপাশে—এ রকম নানা জায়গায় কাবুলিওয়ালাদের বসবাস। রমজান মাসে কলকাতার কাবুলিওয়ালারা তেমন কোনো কাজ করেন না। রোজা রাখেন, সন্ধ্যায় ইফতার সেরে তারাবিহ পড়েন। সারা রাত চলে প্রার্থনা। স্থানীয় রেস্তোরাঁগুলো ইফতারের আয়োজন করে থাকে। সেখানে অথবা নিজ বাসায় ইফতার সারেন খান সাহেবরা।
রফিক আহমেদ কিদওয়াই রোড-সংলগ্ন সেকেন্ড রোডের গলিতে প্রাচীন একটি বাড়িতে গিয়ে দেখা হলো খান সাহেবদের সঙ্গে। তখন তারা ইফতারে বসেছেন। আমরা ইফতারি বলতে যেমন ছোলা, খেজুর, ফলমূল, চপ-কাটলেট, হালিম, মিষ্টি, শরবত ইত্যাদি বুঝি, কাবুলিওয়ালাদের ইফতারের খানাদানা এত কিছু নয়। এমনকি খেজুরও থাকে না। তা যেকোনো দিনের রাতের খাবারের মতোই। সেকেন্ড লেনে খান সাহেবদের বাসায় গিয়ে দেখা গেল বিরাট সাইজের রুটি, গরুর মাংসের ভুনা, সঙ্গে কাঁচা কিছু সবজি দিয়ে বানানো স্যালাড ও নরম পানীয় দিয়ে তারা ইফতার সারছেন। একসঙ্গে ৯-১০ জন গোল হয়ে বসেছেন। দেখা গেল, ভুনায় ডুবিয়ে ডুবিয়ে বিরাট সাইজের রুটি খাচ্ছেন খান সাহেবরা। সবচেয়ে যেটা আকর্ষণীয় লাগল—একটি পাত্র দুজনের জন্য বরাদ্দ। এভাবে সবাই ইফতার সারছেন। কাবুলিওয়ালাদের এই বান্ধবযাপন ও একটি পাত্র থেকে নিয়ে দুজনের খাওয়ার মধ্য দিয়ে মৈত্রী, সম্প্রীতি ও সমবণ্টনের চিত্র ফুটে ওঠে, যা রমজানের শিক্ষাও বটে।
তো খান সাহেবদের সঙ্গে ইফতারে শামিল হওয়া গেল। লা জবাব সেই মাংসের স্বাদ। তাদের বিশাল রুটিতে ভাগ বসিয়ে জমে উঠল সান্ধ্য ভোজন। ইফতার সেরে কথাবার্তা শুরু হলো মোহাম্মদ রশিদ, হজরত খান, শারবুল খানের সঙ্গে।
সেকেন্ড লেনের একটি প্রাচীন বাসায় এই খান সাহেবদের ১২ জন থাকেন। ব্যাংকিং ব্যবসা বা সুদের কারবারে এখন আর তেমন লাভের মুখ দেখেন না। তাই কাপড়ের ব্যবসা, দর্জির দোকান, মসলা বিক্রি—এসবের মাধ্যমে দিন গুজরান করতে হয় তাদের। কাবুলিওয়ালাদের অনেকেই পশতুন। কেউ কেউ পাঠান। এবং বেশির ভাগের মাতৃভাষাই পশতু। অনেকে আবার ফার্সি ভাষাও জানেন। তবে পশতু ভাষায় নিজেদের মধ্যে কথা বলতেই তারা বেশি স্বচ্ছন্দ বোধ করেন। যাদের বয়স সর্বোচ্চ ৪৫, তাদের স্ত্রী-সন্তানেরা এখানেই থাকেন। কিন্তু যারা আরেকটু প্রবীণ, তাদের অনেকের স্ত্রী-সন্তান রয়ে গেছেন আফগানিস্তানে। বছরের পর বছর কোনো দেখা-সাক্ষাৎ হয় না পরিবারের সঙ্গে। খান সাহেবদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, ভারতে দীর্ঘ সময় বাস করলেও এই দেশের সরকার নাগরিকত্ব দেয়নি। উল্টো নিজ দেশে ঘুরতে গেলে কলকাতায় ফিরে আসার ক্ষেত্রে সমস্যা হতে পারে বলে বেশির ভাগ কাবুলিওয়ালাই স্বভূমির মায়া ত্যাগ করে পড়ে রয়েছেন কলকাতায়। তবে এখানে বসবাস করলেও, তারা নিজেদের ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, খাবার ও পোশাকের ব্যাপারে সজাগ। তাদের বাসায় গেলে এক টুকরো আফগানিস্তান দৃশ্যমান হয়ে ওঠে অন্দরসজ্জায়। এই কাবুলিওয়ালাদের জন্যই বছর দুয়েক আগে কলকাতার পার্কসার্কাসে চালু হয়েছিল কাবুল কলকাতা নামের একটি রেস্তোরাঁ। তবে পরে নানা কারণে সেটি বন্ধ হয়ে যায়।
ঈদের দিন অন্য মুসল্লিদের সঙ্গে কাবুলিওয়ালারাও নামাজ পড়তে যান রেড রোডের জামাতে। সেদিন বিশেষ খানাপিনার ব্যবস্থা থাকে। তারপর পরিবারের সদস্যদের নিয়ে ঘুরে বেড়ান গড়ের মাঠ, চিড়িয়াখানা আর ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল পার্কে। ঈদের পরদিন ঘরোয়া পরিবেশে বসে কাবুলিওয়ালাদের গানবাজনার আসর। গানে গানে তারা নিজ দেশের কথা মনে করেন। তখন তাদের চোখের কোণ জলে চিকচিক করে ওঠে। তাতে শৈশবের স্মৃতি, ফেলে আসা স্বজন আর মাতৃভূমির মায়া। তারা কলকাতায় কাবুলকে খোঁজেন।
ছবি: মাসুদুর রহিম রুবাই