ফিচার I কুকুরপ্রেমী নাদিয়া শিকদার
পশুপ্রেমী নাদিয়া শিকদার কুকুরকে চার দেয়ালের মধ্যে বন্দি রাখতে চান না; বরং পোষ্যটিকে সঙ্গী হিসেবে বাইরে নিয়ে যাওয়ার প্রচারণা চালাচ্ছেন। সে জন্য গড়ে তুলেছেন একটি ক্লাব, ঢাকার হাতিরঝিলে
প্রাণীদের উত্ত্যক্ত করা একশ্রেণির মানুষের বদভ্যাস। রাস্তায় যেতে যেতে খামোখাই কুকুরের গায়ে ঢিল ছোড়ার দৃশ্য চোখে পড়ে প্রায়শই। বেওয়ারিশ কুকুরদের জীবন এমনই করুণ। তবে ওয়ারিশ কুকুরদের যাপন যে খুব সুখকর, তা-ও কিন্তু নয়। শখের বশে কুকুর কেনেন অনেকেই। শখ মিটে গেলে তারা আর যত্নআত্তি করেন না। অযত্ন ও অনাদরে মারা যায় অসহায় পোষ্য।
গত বছর রাজধানীর রামপুরায় দুটি মা কুকুরসহ ১৪টি ছানা জীবন্ত মাটি চাপা দেওয়া হয়। অপরাধীদের সাজা অবশ্য হয়েছে। তাদের ছয় মাসের কারাদন্ড দিয়েছিলেন আদালত।
চলতি বছর নতুন একটি আইনের খসড়া অনুমোদিত হয়েছে। তা কার্যকর হলে পোষা কুকুর আর ঘরবন্দি করে রাখা যাবে না। বাইরে নিয়ে যেতে হবে। ২৪ ঘণ্টার বেশি সময় ধরে বেঁধে রাখলে জরিমানা গোনাসহ ঢুকতে হবে চৌদ্দ শিকে। কুকুরকে হাঁটানো নিয়ে বেসরকারিভাবেও উদ্যোগী হয়েছেন অনেকে। নাদিয়া শিকদার তাদের একজন। ‘কুকুর নিয়ে হাঁটুন, সুস্থ থাকুন’ স্লোগানে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে গড়ে তুলেছেন ‘হাতিরঝিল ডগ ওয়াকার্স ক্লাব’।
বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত আমেরিকান নাদিয়া। ছোটবেলাতেই দেশছাড়া। তাই বাংলা ভাষা রপ্ত হয়নি। এক সন্ধ্যায় তাঁর সঙ্গে কথা হলো হাতিরঝিলে। ইংরেজিতে। ঝিলের পাশের বেঞ্চে বসে। সঙ্গে ছিল তাঁর পোষা আদুরে কুকুর ‘স্কুবি’। সাদা লোমশ স্কুবির গলায় বেল্ট। নাদিয়ার হাতে সরু শিকল। আরেক হাতে লাঠি। তাতে লাল রঙের স্কচটেপ প্যাঁচানো। এ লাঠি কুকুর পেটানোর জন্য নয়; রাস্তাঘাটের কুকুর ও অসভ্য মানুষের কবল থেকে নিজের কুকুর ও নিজেকে সামলে নিতে। তবে এটি দিয়ে কাউকে আঘাত করেন না। বললেন, ‘এর উপর লাল রঙের স্কচটেপ পেঁচিয়েছি। লাল রঙ সতর্কতার। এটি আমি হাতে রাখি। যাতে দুষ্ট মানুষ ও কুকুর সতর্ক থাকে এবং আমি সুরক্ষিত থাকতে পারি।’
স্কুবির সহোদর ‘সিম্বা’। যমজ। নাদিয়ার সঙ্গে যখন কথা হচ্ছিল, সিম্বা তখন বাড়িতে। একেক বেলায় একেকটিকে নিয়ে হাতিরঝিল এলাকায় হাঁটতে বেরোন। দুটিকেই সমান ভালোবাসেন। যত্নআত্তি করেন সমানে সমান। কুকুর নিয়ে হাঁটার মধ্যে কী বিশেষত্ব থাকতে পারে— এর জবাবে নাদিয়া বললেন, ‘বাংলাদেশে, বিশেষ করে ঢাকায় কুকুর পোষেন— এমন অনেকেই আছেন। কিন্তু এই কুকুরগুলো বাইরে দেখা যায় না। এদের জীবন কাটে চার দেয়ালের মধ্যে। বন্দিদশায়। কেউ কেউ অবশ্য কুকুর নিয়ে বের হন। কিন্তু তাদের সংখ্যা নগণ্য। যাদের কাছে পোষা কুকুর আছে, তাদের প্রত্যেকের উচিত কুকুরটিকে নিয়ে হাঁটতে বের হওয়া। এতে কুকুরের শরীর ও মন ভালো থাকে। ঘরে বন্দি রাখলে কুকুরগুলো খিটখিটে স্বভাবের হয়ে যায়। পরিবেশের সঙ্গে পোষ্যর দূরত্ব তৈরি হয়।
নিয়মিত হাঁটলে কুকুরের পাশাপাশি নিজের স্বাস্থ্যও ভালো থাকবে। ক্যালরি বার্ন হবে। হাঁটার জন্য কুকুর বেশ উপযুক্ত সঙ্গী। এদিকে, ঢাকা শহরে ঘোরাঘুরি কিংবা হাঁটাহাঁটির জায়গা অপ্রতুল। মাঠ ও পার্কের সংখ্যা কম। শিশুরা ঘরকুনো হয়ে পড়ছে। স্মার্টফোন কিংবা কম্পিউটারে মুখ গুঁজে তাদের দিন কাটে। এতে করে শিশু-কিশোরেরা প্রকৃতি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছে। ওরা যদি কুকুর নিয়ে হাঁটার প্রতি আগ্রহী হয়, তাহলে বিনোদনের পাশাপাশি ভালো শরীরচর্চাও হবে, বললেন প্রাণী অধিকারকর্মী নাদিয়া শিকদার।
পোষা প্রাণীর প্রতি তাঁর সহমর্মিতা ছোটবেলা থেকেই। সালটাও বলে দিলেন। ১৯৯৫ সাল থেকে কুকুর পালনের প্রতি তাঁর আসক্তি বাড়ে। অবশ্য কুকুর নিয়ে হাঁটার পথ খুব সহজ ছিল না। মানুষের থেকে নানা ধরনের ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ শুনতে হয়েছে তাঁকে। ‘কুত্তাওয়ালী’, ‘পাগলী’— এ ধরনের মন্তব্যও এসেছে পথ চলতে গিয়ে। তাতে বিচলিত নন নাদিয়া। বলেন, ‘আই ডোন্ট কেয়ার।’ কখনো কখনো মানুষের অত্যাচার তীব্র আকার ধারণ করে। ২০১১ সালে ঘটেছিল তেমনি এক ঘটনা। কুকুর নিয়ে হাঁটার সময় তাঁকে ও তাঁর কুকুরকে বাজেভাবে উত্ত্যক্ত করা হলে তিনি হাতের লাঠি নিয়ে উত্ত্যক্তকারীকে ‘দৌড়ানি’ দিয়েছিলেন।
‘দৌড়ানি’ শব্দটি নাদিয়ার মুখ থেকে শুনে ভড়কে গিয়েছিলাম কিছুটা। মন্তব্য করলাম, বাংলা জানেন তাহলে। উত্তরে নাদিয়া বললেন, ‘একটু একটু।’
যা হোক, মানুষের কটূক্তি শুনে নিজের লক্ষ্য থেকে পিছিয়ে পড়েননি নাদিয়া। তাঁর ভাষ্য, পরিবর্তনমূলক কাজের সূচনালগ্নে নানা ধরনের বাধা আসবে, এটাই স্বাভাবিক। তবে মানুষের মনোভাব ধীরে ধীরে বদলে যাবে। তখন আর কোনো সমস্যা থাকবে না।
সব প্রাণী পছন্দ করেন নাদিয়া। তবে কুকুরের প্রতি তাঁর আসক্তি বেশি। ‘বিড়াল প্রায় সব জায়গাতেই দেখা যায়। তা ছাড়া বিড়াল নিয়ে হাঁটার চেয়ে কুকুর নিয়ে হাঁটা আরামদায়ক। পাখি নিয়ে তো হাঁটাই যাবে না। ছোটবেলা থেকে কুকুর পালন করতে গিয়ে এ বোধ তৈরি হয়েছে। এ কারণে কুকুর ভালোবাসি। অন্যান্য প্রাণীও ভালোবাসি’, বলেন নাদিয়া।
কুকুর নিয়ে হাতিরঝিলে হাঁটতে বেশ স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন তিনি। চান, তাঁর সঙ্গী বাড়ুক। হাতিরঝিল এলাকায় কেউ তাঁর নিজস্ব কুকুর নিয়ে যদি নাদিয়ার হাঁটার সঙ্গী হতে চান, তাহলে তাঁর অনলাইন প্ল্যাটফর্ম হাতিরঝিল ডগ ওয়াকার্স ক্লাবের মাধ্যমে যোগাযোগ করতে পারেন। বর্তমানে এ ক্লাবের সদস্য ১২৫ জন। দেশজুড়ে ছড়িয়ে আছেন তারা। সংখ্যা বাড়াতে ইভেন্টের আয়োজন করেন নাদিয়া। সেখানে দেশি তারকাদের সম্পৃক্ত করার চেষ্টা করেন। ফেসবুকে তারকাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। বিশেষ করে যেসব তারকা প্রাণী ভালোবাসেন, তাদের সঙ্গে। কোন কোন তারকা তাঁর ইভেন্টে আগ্রহ দেখিয়েছেন, এ প্রশ্নের জবাব এড়িয়ে গেলেন। বললেন, ‘কনফিডেনশিয়াল। তবে বাংলাদেশের অভিনেত্রী জয়া আহসান পোষা প্রাণী বেশ ভালোবাসেন।’
কুকুর পোষা খুব সহজ নয়। নাদিয়ার স্কুবি ও সিম্বা জাপানি প্রজাতি। ওদের খাবারও জাপানি। মাসে একবার শ্যাম্পু দিয়ে গোসল করানোর প্রয়োজন পড়ে। কামড় ও আঁচড়ের ক্ষতি এড়ানোর জন্য ভ্যাকসিন প্রয়োগ করা হয়েছে।
এ সবকিছু মেনেই প্রাণী পোষেন নাদিয়া। এর প্রসারও ঘটাতে চান। তিনি চান আমেরিকার মানুষ দেখুক বাংলাদেশ কতটা এগিয়ে গেছে। বাংলাদেশে শুধু মডেল ও তারকাদের ফটোশুটে কুকুর নিয়ে হাঁটতে দেখা যায়। তিনি এ বলয়কে বিস্তৃত করতে চান। সাধারণ মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে চান কুকুর নিয়ে হাঁটা। বাংলাদেশে আপাতত এ-ই তাঁর কাজ। জানালেন, আমেরিকায় আর না ফিরে যাওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। প্রাণী অধিকারের বাইরে মানবাধিকার, পরিবেশ সুরক্ষার বিষয়েও কাজ করছেন নাদিয়া শিকদার।
শিবলী আহমেদ
ছবি: সৈয়দ মাহামুদুর রহমান