ফিচার I কলকাতা মুছে ফেলেছে আলীর ট্র্যাডিশন
বাঙালিকে বৈশ্বিক করে তোলার পেছনে যে কজন মনীষী অবদান রেখেছেন, তিনি তাঁদের একজন। মনেপ্রাণে বাঙালি জাতীয়তাবাদী এই চিন্তাবিদ মূলত আজকের পশ্চিমবঙ্গের হুগলি জেলার মানুষ। কিন্তু তিনি বসবাস করেছেন শিলং ও কলকাতায়। তিনি ও তাঁর পরবর্তী প্রজন্মের মানুষেরা কলকাতায় বসবাস করলেও সেই ঠিকানা আজ প্রায় অবলুপ্ত। ঝাউতলা রোডে অবস্থিত এস ওয়াজেদ আলীর বাড়ি ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। পরিবারটি ছিল অভিজাত ও সংস্কৃতিমান। অথচ তাঁদের স্মৃতিচিহ্নটুকু মুছে ফেলছে কলকাতা। এই নিয়ে লিখছেন অতনু সিংহ
বাঙালি তার ইতিহাস, ঐতিহ্য, গৌরবগাথা সংরক্ষণে আদৌ যত্নশীল নয়। এই আত্মঘাতী প্রবণতাই বাঙালির ট্র্যাডিশনে পরিণত হচ্ছে। সেই নজির কলকাতায়, এস ওয়াজেদ আলীর বাড়ির ধ্বংসস্তূপে দৃশ্যমান।
আজকের পশ্চিমবঙ্গের হুগলি জেলার তাজপুরে ১৮৯০ সালে জন্মগ্রহণ করেন এস ওয়াজেদ আলী বা শেখ ওয়াজেদ আলী। বাঙালিকে বৈশ্বিক করে তোলার কাজটা যেসব বুদ্ধিজীবী, সাহিত্যিক, শিল্পী, বিদ্বজ্জনদের হাত ধরে শুরু হয়েছিল, তিনি তাঁদেরই একজন। তাঁর শিক্ষাজীবন কৃতিত্বপূর্ণ। শিলংয়ের মোখার হাইস্কুল থেকে তিনি ১৯০৬ সালে স্বর্ণপদকসহ এন্ট্রান্স পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। আলীগড় কলেজ থেকে ১৯০৮ সালে আইএ এবং এলাহাবাদ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯১০ সালে বিএ ডিগ্রি লাভ করেন। ১৯১২ সালে তিনি উচ্চশিক্ষার জন্য ইংল্যান্ডে যান এবং কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পুনরায় বিএ ডিগ্রি ও বার-অ্যাট-ল সম্পন্ন করেন। ১৯১৫ সালে কলকাতা হাইকোর্টে আইন ব্যবসার মধ্য দিয়ে তাঁর কর্মজীবন শুরু হয়। ১৯২৩ সালে তিনি কলকাতা প্রেসিডেন্সির ম্যাজিস্ট্রেট নিযুক্ত হন এবং ১৯৪৫ সালে ওই পদ থেকে অবসর গ্রহণ করেন। কলকাতার সাহিত্য জগতে তিনি ছিলেন একজন দিকপাল। প্রমথ চৌধুরীর সবুজপত্র পত্রিকায় তাঁর প্রথম গল্প ছাপা হয়। তিনি Bulletin of the Indian Rationalistic Society নামে একটি ইংরেজি জার্নাল ও গুলিস্তা নামে একটি বাংলা পত্রিকা সম্পাদনা করতেন। চিন্তাভাবনায় তিনি ছিলেন প্রগতিশীল বাঙালি জাতীয়তাবাদী। তাঁর উল্লেখযোগ্য সাহিত্যকর্মের মধ্যে রয়েছে: প্রবন্ধ— জীবনের শিল্প (১৯৪১), প্রাচ্য ও প্রতীচ্য (১৯৪৩), ভবিষ্যতের বাঙালী (১৯৪৩), আকবরের রাষ্ট্র সাধনা (১৯৪৯), মুসলিম সংস্কৃতির আদর্শ; গল্প— গুলদাস্তা (১৯২৭), মাশুকের দরবার (১৯৩০), বাদশাহী গল্প (১৯৪৪), গল্পের মজলিশ (১৯৪৪); উপন্যাস— গ্রানাডার শেষ বীর (১৯৪০); ভ্রমণকাহিনি— পশ্চিম ভারত (১৯৪৮), মোটর যোগে রাঁচী সফর (১৯৪৯) প্রভৃতি।
হুগলি, শিলং, কলকাতা, এলাহাবাদ ও কেমব্রিজে বিস্তৃত হয়েছে তাঁর জীবন। আলী পরিবার ছিল কলকাতার বনেদি সমাজের অংশ। পরবর্তী প্রজন্মের আহমেদ আলি ছিলেন বিখ্যাত ফটোগ্রাফার ও চিত্রসাংবাদিক। আহমেদ আলীর কন্যা ভারতের সৌন্দর্য প্রতিযোগিতায় শ্রেষ্ঠত্বের সম্মান অর্জন করে হয়েছিলেন ফেমিনা মিস ইন্ডিয়া। শুধু তা-ই নয়, বিশ্বসুন্দরী প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করে দ্বিতীয় রানারআপ হয়েছিলেন। তাঁর গৌরবগাথার কথা সরিয়ে রাখলেও শুধু এস ওয়াজেদ আলীর পরিচিতিও আলী পরিবারের খ্যাতির জন্য যথেষ্ট। কিন্তু তাঁদের বাড়িটি কোথায়?
কলকাতার শিল্প-সাহিত্য জগতের কেউই বলতে পারেন না, কোথায় এস ওয়াজেদ আলীর বাড়ি। অবশেষে ‘পূবের কলম’ নামক দৈনিক পত্রিকা অফিসে গিয়ে খোঁজ করে পাওয়া গেল ঝাউতলা রোডে বাড়িটির ঠিকানা। কিন্তু সেই সড়কে গিয়ে কৃষ্ণনগরের রাজপরিবারের বাগানবাড়ির সন্ধান পাওয়া গেলেও এস ওয়াজেদ আলীর বাড়িটির খোঁজ প্রায় কারোর কাছেই নেই। কারণ, ওই বাড়ির কিছুই আর অবশিষ্ট নেই। সবটাই আজ ধ্বংসস্তূপ। একটি প্রায় ধ্বংসপ্রাপ্ত বড়সড় প্রবেশদ্বারের ভেতরে গিয়ে বোঝার উপায় নেই, এখানে অভিজাত একটি বাড়ি ছিল একসময়। ঝাউতলা রোডে কেবল বাড়িটির প্রবেশদ্বারের একটা অংশ বাদে আর কিছুই অক্ষত নেই। ভেতরে ঝোপঝাড়-আগাছা এবং পুরোনো ইট-সুরকি আর মাটির স্তূপ। এটিই যে ওয়াজেদ আলীর বাড়ি, তা কে বুঝবে? মূল ফটকের বাইরের বোর্ডে লেখা তথ্য থেকে জানা গেল, বর্তমানে এই সম্পত্তি রয়েছে পশ্চিমবঙ্গের মুসলিমদের ওয়াক্ফ প্রপার্টির অধীনে, যার দেখভাল করছে গোলাম রসুল মসজিদ। বাড়ির অদূরেই রয়েছে মসজিদটি। এটি মোগল ও ইরানি স্থাপত্যের সমন্বয়ে গড়ে তোলা হয়েছিল। কিন্তু সংস্কারের নামে আদি কাঠামো ভেঙে নতুন করে যে মসজিদ নির্মাণ করা হয়েছে, তা কোনোভাবেই ঐতিহ্যকে বহন করছে না। বরং ঐতিহ্য ঝেড়ে-মুছে পশ্চিমা কায়দায় পুনর্নিমিত হয়েছে। যা হোক, ওই মসজিদে এস ওয়াজেদ আলী এবং তাঁর বাড়িটির ব্যাপারে কথা বলার মতো কাউকে পাওয়া গেল না।
অবশেষে যোগাযোগ করা হলো ভারতের রাজ্যসভার সাংসদ ও দৈনিক পূবের কলম পত্রিকার সম্পাদক আহমদ হাসান ইমরানের সঙ্গে। তিনি ওই এলাকারই বাসিন্দা, বুদ্ধিজীবী। জানা গেল নব্বই দশকে, নাফিসা আলীরা কলকাতা ছেড়ে মুম্বাই চলে যাওয়ার পর নানা কৌশলে বাড়িটি দখল নিয়ে প্রমোটিং শুরু করেছিলেন এক মাড়োয়ারি ব্যবসায়ী। ওই বাড়িটার দখল নিয়েই তা ভেঙে ফেলেন ওই ব্যবসায়ী। পরে স্থানীয় মানুষ এ নিয়ে সরব হয়। মামলা মোকদ্দমা, সংবাদপত্রে লেখালেখি শুরু হয়। ইমরান জানান, তিনি নিজেও এ নিয়ে লেখালেখি করেছেন। এ রকম নানা চেষ্টায় অতঃপর ওই জায়গাকে ওয়াক্ফ বোর্ডের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসা হয়।
তবে ওইখানে এস ওয়াজেদ আলীর কোনো স্মৃতিচিহ্ন নেই। এমনকি বাড়িটির ইতিহাস সম্পর্কেও কোনো তথ্য লিপিবদ্ধ নেই। নতুন প্রজন্ম ভুলতে বসেছে এস ওয়াজেদ আলীকে। নাফিসা আলী যে ওই পরিবারের মেয়ে, সেটাও অনেকেই জানেন না। এ ব্যাপারে পশ্চিমবঙ্গের ওয়াক্ফ বোর্ড, বাঙালি মুসলিম সমাজ ও রাজ্য সরকার— কোনো পক্ষ থেকেই কোনো উদ্যোগ আপাতত চোখে পড়েনি। তবে হাসান ইমরানের আশা, পশ্চিমবঙ্গ সরকার হয়তো এ ব্যাপারে কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করবে।
ছবি: মাসুদুর রহিম রুবাই