skip to Main Content

ফিচার I বরষা পরবে

বাংলার প্রকৃতিতে বর্ষা এক আশীর্বাদ। এই মৌসুমের উৎসবগুলো কৃষিনিবিড় বাংলার লোকযাপনের সঙ্গে সম্পৃক্ত। লিখেছেন অতনু সিংহ

‘আকাশে আষাঢ় এলো; বাংলাদেশ বর্ষায় বিহ্বল/ মেঘবর্ণ মেঘনার তীরে তীরে নারকেল সারি/ বৃষ্টিতে ধূমল’ —বুদ্ধদেব বসু।

বাংলাদেশকে ফুলে-ফলে সাজিয়ে তোলার ঋতু বর্ষা। বঙ্গমৃত্তিকার উর্বরতারও অধিকাংশ ক্ষেত্রে এটি আশীর্বাদ। কৃষিনিবিড় বাংলায় তাই বর্ষাকে কেন্দ্র করে ব্যাপ্ত হয় ফার্টিলিটি কাল্ট। এই অঞ্চলের লৌকিক যাপনে বর্ষা তাই উৎসবের গুরুত্বপূর্ণ একটি সময়ও বটে।

অম্বুবাচীর মেলা

বারোমাসে তেরো পার্বণের অধিকাংশই লৌকিক। বর্ষাকালীন পূজা-অর্চনা ঘিরে যে পার্বণগুলো রয়েছে, সেগুলো দেখলে মনে হবে ধর্মীয় বিশ্বাস-সংক্রান্ত। কিন্তু এসব পূজা-অর্চনার দেবদেবী আদৌ বৈদিক ধর্মের প্রাতিষ্ঠানিক দেবদেবী নয়, বরং বাংলায় বৈদিক সংস্কৃতির আগমনের অনেক আগে এখানকার প্রকৃতিনিবিড় টোটেমগুলো থেকে প্রতীকীভাবে কিছু দেবদেবীর ধারণা তৈরি হয়েছে, যেগুলো প্রাতিষ্ঠানিক হিন্দুত্বের সমান্তরাল বিশ্বাসের জায়গায় এসবের ঠাঁই হয়েছে। বাংলার লোকজীবন, লোককাব্য এগুলোর উৎস।
বাংলায় বর্ষাকালে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ লৌকিক উৎসব অম্বুবাচী। এর আরেক নাম অমাবতী। সূর্য যখন মিথুন রাশিতে স্থিত আদ্রানক্ষেত্রে প্রবেশ করে, তখনই বর্ষা নেমে আসে ধরাধামে। বর্ষার এই আগমনে প্রকৃতি হয়ে ওঠে রজঃস্বলা, এর তিন দিনেই অম্বুবাচী উৎসব। তবে কোথাও কোথাও পাঁচ দিন ধরেও এই উৎসব চলে। নিরয়ণ পঞ্জিকামতে, আষাঢ়ের ৭ তারিখ অম্বুবাচী উৎসবের সূচনা, চলে ১১ তারিখ পর্যন্ত। অম্বুবাচীকে এখন হিন্দু উৎসব বলা হলেও, এর সঙ্গে ধর্মের কোনো সম্পর্ক নেই। বরং এটি বাংলার আদি লৌকিক উৎসবগুলোর একটি। বাংলার প্রকৃতির রজঃস্বলা হয়ে ওঠার এই উৎসবের সঙ্গে একসময় মেয়েদের ঋতুমতী হওয়ার বিষয়টির আনন্দ উদযাপনের যোগ ছিল।

রথযাত্রা

নারীই প্রকৃতি, তাই নারী আর এই বৃহৎ বঙ্গের প্রকৃতির ফার্টিলিটি কাল্ট হলো অম্বুবাচী উৎসব।যদিও ব্রাহ্মণ্যবাদী সমাজের পিতৃতন্ত্রে ঋতুমতী মেয়েদের নিজস্ব এই উৎসবকে ট্যাবুকেন্দ্রিক বিধিনিষেধের সঙ্গে সম্পৃক্ত করে তোলা হয়। বিধবাদের এই সময় ফলাহার বিধানসহ জনসম্মুখে না আসার জন্য বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়। আসলে এই উৎসব মূলত নারী ও প্রকৃতির রজঃস্বলা হয়ে ওঠার উৎসব। প্রকৃতির সম্মানার্থে জমিতে লাঙল চালানো বন্ধ রাখা হয় এই সময়। লক্ষণীয়, লাঙল শব্দটিও লিঙ্গ শব্দ থেকে উদ্ভূত। মেয়েরা রজঃস্বলার সময় তাদের এই শারীরিক অবস্থাকে উদযাপন করবে, কোনো কাজ করবে না এই সময় এবং ঋতুমতী রজঃস্বলা কৃষিজমিতেও এই কয়দিন বন্ধ থাকবে কর্ষণ। তার বদলে নৃত্যগীতে, খাওয়াদাওয়ায় মেতে উঠবে মাতৃতান্ত্রিক লোকসমাজ। বাংলার প্রাচীন মাতৃতান্ত্রিক ব্যবস্থায় এই ছিল অম্বুবাচী। পরে নানাভাবে উৎসবটির হিন্দুত্বকরণ হয়েছে এবং কোথাও কোথাও মাতৃতান্ত্রিক ও প্রকৃতিমুখর এই উৎসব পিতৃতন্ত্রের বিধিনিষেধ আয়োজনের উপলক্ষে পরিণত হয়েছে। অসমের কামরূপ-কামাখ্যায় এই উৎসব হলো প্রধান উৎসব। সেখানকার মন্দিরে রয়েছে নারীর যোনির ভাস্কর্য। বোঝা যাচ্ছে, এই তীর্থের সঙ্গে সম্পর্কিত হয়ে রয়েছে যোনি, কাম, ঋতু ইত্যাদি। এটি মূলত প্রাচীন সময়ে বৃহৎবঙ্গে তন্ত্রচর্চার মূল জায়গা ছিল। বাংলায় বৌদ্ধধর্মের সময়কালেরও আগে থেকে এই তন্ত্রচর্চার চল রয়েছে।

শরীয়তপুরের মনসার প্রাচীন মন্দির

কামরূপ-কামাখ্যা তন্ত্রপীঠের সবচেয়ে বড় তীর্থস্থান। এই তীর্থের কেন্দ্রীয় ভূমিকাও পালন করতেন মেয়েরাই। কেননা, তাদের শরীরের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গটাই এর আধার। সে কারণেই বাংলার বিশেষ ফার্টিলিটি কাল্ট অম্বুবাচী এই অঞ্চলের প্রধান উৎসব। বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গেও এর চল রয়েছে। বাংলার আদিবাসী সমাজের কাছেও উৎসবটি দারুণ জনপ্রিয়। এবং সেখানে এই উৎসবের কোনো রকম পিতৃতান্ত্রিক রূপ বদল হয়নি। আদিবাসী সমাজ যেমন মাতৃতান্ত্রিক, তেমনই অম্বুবাচী উৎসবও তাদের কাছে নারীত্বের উদযাপন। আজকে যখন সামাজিক স্তরে নতুন করে আলোচিত হচ্ছে যে ঋতুস্রাব কোনো লজ্জার ব্যাপার নয়, বরং তা নারীর গর্ব; তখন অম্বুবাচীর মতো উৎসবের আদি ভাষ্য নতুন করে পাঠ করা দরকার। এবং অম্বুবাচীকে পিতৃতন্ত্রের হাত থেকে ফিরিয়ে এনে নারী ও প্রকৃতির সঙ্গে পুরুষের একাত্মতার নয়া-দার্শনিক অভিমুখ তৈরি হতে পারে। এই উৎসব ঘিরে লৌকিক বিশ্বাস— অম্বুবাচীর তিন দিন আকাশ ও পৃথিবীর মিলন হয় এবং বৃষ্টির পানিতে সিক্ত হয় মাটি, যা কৃষিকাজে উপযোগী।

কবি বিজয় গুপ্তর প্রাচীন মনসামূর্তি

বাংলায় বর্ষাকালীন উৎসব-পরবের মধ্যে মনসাপূজা গুরুত্বপূর্ণ। যে মনসাকে ঘিরে রচিত হয়েছে বাংলা সাহিত্যের গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ মনসামঙ্গলকাব্য। হরি দত্ত, কেতকাদাস ক্ষেমানন্দ, বিপ্রদাস পিপলাই এবং অতি অবশ্যই বিজয় গুপ্তের মতো কবিরা বাংলার লৌকিক দেবী মনসাকে ঘিরে মঙ্গলকাব্য রচনা করেছিলেন। অনার্য পরিচিতিসত্তার আইকন। যে অনার্যদের কালো, মানুষ, শূদ্র, ছোটলোক ইত্যাদি অভিধায় হেয় করা হয়েছে, মনসা তাদেরই পূজনীয়া। জল-জঙ্গল-মালভূমি-পাহাড়ে ঘেরা বাংলাকে দখল করতে চেয়েছে আর্যীয় ব্রাহ্মণ্যবাদী সমাজ, যুগযুগান্ত ধরে। তাদের প্রতিহত করার ক্ষেত্রে অনার্য সমাজের গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাসের মিথিক্যাল এক্সপ্রেশন কালী কিংবা মনসার মতো দেবী। উচ্চবর্ণ ও উচ্চবিত্তের প্রতিনিধি শৈব বণিক চাঁদ সওদাগরের হাত থেকে অঞ্জলি নিতে চেয়েছিলেন মনসা। কিন্তু শিবের পূজারি চাঁদ বণিক স্বয়ম্ভু শিবকে ছাড়া আর কাউকেই পূজার অঞ্জলি দিতে নারাজ ছিলেন। অন্যদিকে তার হাত থেকেই অঞ্জলি পাওয়ার জন্য মনসা নাছোড়বান্দা। পরিস্থিতি জটিল আকার নিল। মনসা তার সর্পবাহিনীকে দিয়ে বণিক চাঁদ সওদাগরের বিত্তবৈভবসহ সব ধ্বংস করলেন। চাঁদের আদরের পুত্র লখিন্দরকেও দংশন করেছিল বিষধর কালনাগিনী। অবশেষে নতি স্বীকার করেন চাঁদ সওদাগর। ভাঙব তবু বাঁকব না, এমন ভাব নিয়ে বাম হস্তে মনসার পূজা করেন তিনি। কিন্তু বাম হস্তে হলেও পূজা তাকে করতেই হয়। এই যে পূজা ও অঞ্জলি, এটা আসলে অনার্য দেবী মনসার ক্ষমতার কাছে আর্য সমাজের স্থানীয় প্রতিনিধি চাঁদ বণিকের বশ্যতা স্বীকারের উপাখ্যান। মনসা একদিকে নারীশক্তি, অন্যদিকে বাংলার বাস্তুতন্ত্রের সঙ্গে নিবিড়ভাবে সম্পৃক্ত সরীসৃপ এবং বাংলার জল-জঙ্গল-ভূপ্রকৃতির মানুষের ক্ষমতা ফিরে পাওয়ার মতো অনেক বিষয়ের সম্মিলিত প্রতীক। এর মর্মভাব আজও ব্যাপ্ত হয়ে আছে নিখিল বাংলায়। এই বর্ষাকালে বাংলায় মনসাপূজা হয় লৌকিক স্তরে। মনসা অনার্য, লৌকিক, অবৈদিক দেবী হলেও বাংলার ব্রাহ্মণ্যসমাজ এই দেবীকে মেনে নিতে বাধ্য হয়েছিল। সেই লোক-ঐতিহ্য ধারণ করে বাংলায় মনসার পূজা হয় আজও বর্ষার শুরুতেই। বেদে-বেদিনী সমাজে সর্পের দেবী মনসা প্রধানতম আরাধ্যা দেবী। মনসার প্রতিমায় তাকে সর্প পরিবেষ্টিত এক নারী হিসেবে দেখা যায়, যিনি অধিষ্ঠিত রয়েছেন পদ্মফুলের উপর। তার মাথার উপরে থাকে সাতটি গোখরো সাপের ফণা। তবে নিখিল বাংলার অধিকাংশ জায়গাতেই মনসার প্রতিমা পূজা হয় না। ফণীমনসা নামের ক্যাকটাসে অথবা সীজ বৃক্ষের শাখায় কিংবা ঝাঁপিতে সাপ এঁকে মনসা রূপে পূজা করা হয়। নিম্নবর্ণের হিন্দুদের মধ্যে এই পূজা জনপ্রিয় হলেও বর্ণহিন্দুদের মধ্যে মনসার প্রতিমা পূজার চল রয়েছে, বিশেষ করে চাঁদ সওদাগরের ঐতিহ্য অনুসরণে বণিক সমাজে। বাংলাদেশ ও অসমে আষাঢ়-শ্রাবণ মাসের নাগপঞ্চমীতে অনেকে মনসাপূজা করেন, আবার পশ্চিমবঙ্গে বর্ষার শুরুতেই মনসাপূজার রীতি রয়েছে। মনসাপূজা এবং মনসামঙ্গলকাব্যের জেরে বাংলায় বহুকাল ধরে মনসার পালাগান, মনসাকেন্দ্রিক যাত্রাপালার প্রচলন রয়েছে। বেহুলা-লখিন্দরকে ঘিরেও পালাগান ও যাত্রাপালার সংখ্যা অনেক। মনসা অবৈদিক দেবী হলেও তিনি জায়গা করে নিয়েছেন মহাভারতে, তাকে নিয়ে রচিত হয়েছে পদ্মপুরাণ।

কামাখ্যার দেবীমূর্তি

বাংলায় বর্ষাকালীন আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ উৎসব রথযাত্রা। ওডিশার পুরীর জগন্নাথ মন্দিরের রথযাত্রার মতোই বাংলায় রথযাত্রা খুব জনপ্রিয়। তবে রথযাত্রার রথের মধ্যে অধিষ্ঠিত দেবতা জগন্নাথ হিন্দু দেবতা নয়। শবর দেবতা। শবররা হিন্দু নয়। অনার্য ভূমিপুত্র জগন্নাথের দারুবিগ্রহের সঙ্গে রথে বলরাম ও সুভদ্রাকে নিয়ে রথ নগর প্রদক্ষিণ করে। চৈতন্যের ভাবান্দোলন সূত্রেই বাংলায় জগন্নাথের রথযাত্রার সূচনা। ঢাকার ধামরাই উপজেলায় প্রাচীন আমল থেকে রথযাত্রা হয়ে আসছে। এ ছাড়া সাভার, পুরান ঢাকা, সিলেট, চট্টগ্রাম, কুষ্টিয়া, যশোরসহ গোটা বাংলাদেশেই রথযাত্রা বিরাট এক উৎসব। পশ্চিমবঙ্গের হুগলি জেলার শ্রীরামপুরে মাহেশের রথযাত্রাও বিখ্যাত। এ উপলক্ষে রথের মেলা আর গানবাজনার আসর বসে বাংলাদেশসহ বৃহত্তর বঙ্গে।
এ ছাড়া বর্ষায় আরও নানা পরব রয়েছে বাংলার কৌমসমাজে। রয়েছে বৃষ্টি নামানোর গান, ব্যাঙের বিয়ে দেওয়ার মতো প্রকৃতিনিবিড় নানা মজার লোকজ বিষয়। আর বড় কোনো দুর্যোগ ছাড়া বৃষ্টি নামলেই বর্ষণমুখর বাংলা হয়ে ওঠে রূপবতী।

ছবি: ইন্টারনেট

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top