ফিচার I বর্ষার কবিতা ও গান
বাংলার প্রকৃতি বর্ষায় স্নিগ্ধ হয়ে ওঠে। কিন্তু চিত্ত হয় বিহ্বল। ব্যাকুল হয় মন। এরই প্রকাশ ঘটে চলেছে বাঙালির গান ও কবিতায়
মন-মর্জির ওপর বর্ষার প্রভাব গভীর। প্রকৃতির সঙ্গে মানবাত্মার সম্পর্কের রহস্য অনুসন্ধান করেছেন রোম্যান্টিক কবিরা। এমনকি তাঁরা নিজেদের প্রকৃতির অংশ হিসেবে দেখেছেন। এই যে বৃষ্টি হলেই বিশেষ কারও কথা মনে পড়ে, তা রোম্যান্টিক অনুভূতিরই বহিঃপ্রকাশ।
এক পশলা বৃষ্টিতে মন কখনো বিষণ্ন হয়ে ওঠে, কখনো হয় প্রফুল্ল। তাপমাত্রা, বাতাস, সূর্যের আলো, বৃষ্টি, কুয়াশা, বাতাসের চাপ এবং দিনের দৈর্ঘ্যরে ওপর নির্ভর করে মেজাজের হেরফের ঘটে। এর প্রতিক্রিয়ায় সৃষ্টিশীলেরা রচনা করেন কবিতা, গান, চিত্রকর্ম ইত্যাদি।
বাংলা ভাষার প্রাচীন সাহিত্যনিদর্শন চর্যাপদে পাওয়া গেছে বর্ষাবন্দনা। চর্যাপদের পাঁচ নম্বর চর্যায় মেঘমেদুর নদীর বর্ণনায় বর্ষা নিয়ে লেখা হয়েছে, ‘ভবনই গহন গম্ভীর বেঁগে বাহী/ দু’আন্তে চিখিল মাঝে ন যাহী।’
ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ ও রাহুল সাংকৃত্যায়নের মতে চর্যাপদের রচনাকাল খ্রিস্টীয় অষ্টম থেকে দ্বাদশ শতাব্দীতে। ধরে নিতে পারি, বাংলা ভাষায় বর্ষা স্তুতির কাব্যিক সূচনা তখনই।
মধ্যযুগের মঙ্গলকাব্য থেকে শুরু করে ঈশ্বরগুপ্ত পর্যন্ত বন্দনা হয়েছে ভাবরসে রঞ্জিত ঋতু বর্ষার। মধ্যযুগের গীতিকবিতায় বর্ষা ভাসিয়ে নিয়েছে রাধাকে। রাধা-কৃষ্ণের প্রেমে বর্ষা অনুঘটক বা তন্ময় সংশ্লেষক হিসেবে কাজ করেছে।
কবি কালিদাস রচিত ‘মেঘদূত’ কাব্যে অঙ্কিত বর্ষার রূপ অসামান্য। বাদ যাননি চন্ডীদাসও। মেঘের ঘনকালো রূপের সঙ্গে নিজ মনের বিরহ-কাতরতা মিশিয়ে তিনি লিখেছেন, ‘এ ঘোর রজনী মেঘের ঘটা কেমনে আইল বাটে/ আঙিনার মাঝে বধুয়া ভিজিছে দেখিয়া পরাণ ফাটে।’
ঘোর বর্ষায় মনের খোরাকি পেয়েছিলেন বিদ্যাপতি। আগলে রাখা যাতনা প্রকাশ করেছেন এভাবে, ‘এ সখি হামারি দুখের নাহি ওর-এ ভরা ভাদর মাহ বাদর/ শূন্য মন্দির মোর।’
বর্ষার মগ্নতা উপেক্ষা করতে পারেননি কবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত। বর্ষণকে নারীরূপে কল্পনা করে লিখেছেন, ‘গভীর গর্জন করে সদা জলধর উথলিল নদ-নদী ধরনীর উপর/ রমণী রমন লয়ে সুখে কেলি করে দানবাদি দেব যক্ষ সুখিত অনন্তরে।’
আকাক্সক্ষার প্রকাশও ঘটেছে। বর্ষার হদিস না পেয়ে চাতকতুল্য চিত্তে ছন্দের জাদুকর সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত মন্দাক্রান্তা ছন্দে লিখেছেন, ‘পিঙ্গল বিহ্বল ব্যথিত নভতল, কই গো কই মেঘ উদয় হও/ সন্ধ্যার তন্দ্রার মূরতি ধরি আজ মন্দ্র-মন্থর বচন কও।’
বিদ্রোহী কবি নামে পরিচিত হলেও বর্ষার বিরুদ্ধে কোনো বিদ্রোহ ছিল না কাজী নজরুল ইসলামের। ছিল প্রীতি। তাঁর কবিতায় আমরা বর্ষাকে পাই এভাবে, ‘শ্রাবণ নিশিতে ঝড়ের কাঁদন শুনেছ কি কোনো দিন?’
নজরুল বর্ষাঋতুর প্রভাব বর্ণনা করতে গিয়ে আরও লিখেছেন, ‘অঝোর ধারায় বর্ষা ঝরে সঘন তিমির রাতে/ নিদ্রা নাহি তোমার চাহি আমার নয়ন-পাতে।’
বর্ষার দৃশ্য শহুরে আকাশের চাইতে গ্রামের আকাশে বেশি সুন্দর। তাই বর্ষার মগ্নতা পেয়ে বসেছিল পল্লিকবি জসীমউদ্দীনকেও। বর্ষাবন্দি গায়ের নিষ্কর্ম মানুষের কর্মকান্ডের ফিরিস্তি দিয়েছেন তিনি। ‘ধান ক্ষেত’ কবিতায় লিখেছেন, ‘গাঁয়ের চাষীরা মিলিয়াছে আসি মোড়লের দলিজায়/ গল্পের গানে কি জাগাইতে চাহে আজিকার দিনটায়/ কেউ বসে বসে বাখারী চাঁচিছে, কেউ পাকাইছে রসি/ কেউবা নতুন দোয়াড়ীর গায়ে চাঁকা বাঁধে কসি কসি।’
একই কবিতায় বর্ষাকালে গ্রামের বউদের জীবনযাত্রা ফুটিয়ে তুলেছেন এভাবে, ‘বউদের আজ কোনো কাজ নাই, বেড়ায় বাঁধিয়া রসি/ সমুদ্রকলি শিকা বুনাইয়া নীরবে দেখিছে বসি/ কেউবা রঙিন কাঁথায় মেলিয়া বুকের স্বপনখানি/ তারে ভাষা দেয় দীঘল সূতার মায়াবী নকসা টানি/ বৈদেশী কোন্ বন্ধুর লাগি মন তার কেঁদে ফেরে/ মিঠে-সুরি-গান কাঁপিয়ে রঙিন ঠোঁটের বাঁধন ছেঁড়ে।’
ছড়ার অধিপতি সুকুমার রায় বর্ষায় বসে পড়তেন পদ্য লিখতে। কিন্তু কী লিখবেন, সেটা ভেবেই দিন কেটে যেত। মধুময় বিড়ম্বনার প্রকাশ ঘটাতে ছড়া কেটেছেন, ‘কাগজ কলম লয়ে বসিয়াছি সদ্য/ আষাঢ়ে লিখিতে হবে বরষার পদ্য/ কি যে লিখি কি যে লিখি ভাবিয়া না পাই রে/ হতাশে বসিয়া তাই চেয়ে থাকি বাইরে।’
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বর্ষাকে দেখেছেন বিচিত্র মাত্রায়, নানা দৃষ্টিকোণে। লিখেছেন, ‘এমন দিনে তারে বলা যায়/ এমন ঘনঘোর বরিষায়।’ এখানে তিনি বর্ষাকে হয়তো প্রেমের সঙ্গে সম্পৃক্ত করতে চেয়েছেন। আবার, ‘সঘন গহন রাত্রি/ ঝরিতেছে শ্রাবণ ধারা/ অন্ধ বিভাবরী সঙ্গপরমহারা।’ এখানে কেবল বর্ষার রূপ অঙ্কন করেছেন তিনি। এ ছাড়া কবি লিখেছেন, ‘হৃদয়ে আজ ঢেউ দিয়েছে,/ খুঁজে না পাই কূল/ সৌরভে প্রাণ কাঁদিয়ে তুলে/ ভিজে বনের ফুল।’
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাছে বর্ষা কেবল প্রেম, বিরহবেদনার রূপ-প্রকৃতিই বহন করেনি; উল্লাসের প্রতীক হিসেবেও এসেছে। ‘নববর্ষা’ কাব্যে লিখেছেন, ‘হৃদয় আমার নাচেরে আজিকে/ ময়ূরের মত নাচেরে।’ বর্ষণজনিত আতঙ্ককেও বন্দী করেছেন কবিতায়। ‘নীল নবঘনে আষাঢ় গগনে তিল ঠাঁই আর নাহিরে/ ওগো আজ তোরা যাসনে ঘরের বাহিরে।’
এসব তো গেল কবিতা, পদ্য ও ছড়ার কথা। এগুলোর থেকে কিছু কিছু পরবর্তী সময়ে গানে রূপান্তরিত হয়েছে। বর্ষা নিয়ে বাংলা গীতিকবিতার ডালাও সমৃদ্ধ। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে আজও টিকে আছে কিছু গীতিকবিতা। গ্রামের বাসিন্দাদের অনেকেই বিশ্বাস করেন, বিশেষ রীতি মেনে এসব গীতিকবিতা গাইলে বৃষ্টি নামে। এমন কিছু গীতিকবিতা হচ্ছে:
১. ও মেঘ সাজোলো,
কালা কইতম দিমু গো,
চিনা ক্ষেতে চিনচিনানি,
ধান ক্ষেতে আডু পানি,…
২. আল্লাহ মেঘ দে পানি দে
ছায়া দেরে তুই
আল্লাহ মেঘ দে।…
৩. আমের পাতা দিয়ে
ছাইছিলাম ঘর, তাতে মানে না
পানির ভর।…
বাংলাদেশের পাহাড়ি অঞ্চলে বর্ষা নিয়ে আছে ‘হুদমা গান’। মেয়েরা বৃষ্টি নামানোর জান্য গভীর রাতে দল বেঁধে হুদমা গায়। তাদের বিশ্বাস, হুদমা হচ্ছেন মেঘের দেবতা। মেয়েদের পাশাপাশি কৃষক-বধূরাও রাত্রিবেলা কৃষিক্ষেতে নাচ-গান করেন এবং জমিতে পানি ঢেলে কৃত্রিম চাষের অভিনয় করেন।
বর্ষার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে ঘাটু গানের নাম। এটি বিলুপ্তপ্রায় একধরনের লোকগীতি। ঘাটে ঘাটে নৌকা ভিড়িয়ে এ গান গাওয়া হয় বলে এর নাম ঘাটের গান বা ঘাটু গান। রাধাকৃষ্ণের প্রেম এ গানের মূল বিষয়বস্তু। কিশোর বা মেয়ে সেজে এ গান গাইত।
বর্ষা নিয়ে অনেক গান রচিত হয়েছে সাম্প্রতিক কালে। সেগুলোর মধ্যে কিছু গান হচ্ছে, শাওনের গাওয়া ‘যদি মন কাঁদে’, অর্থহীন ব্যান্ডের ‘এপিটাফ’, হাবিবের ‘চলো বৃষ্টিতে ভিজি’, এলিটার ‘বৃষ্টি-রাগা’, আর্টসেল ব্যান্ডের ‘এই বৃষ্টি ভেজা রাতে’, জলের গান ব্যান্ডের ‘বৃষ্টির গান’, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের ‘এই মেঘলা দিনে একলা’, শিরোনামহীন ব্যান্ডের ‘বর্ষা’ ইত্যাদি। বর্ষার অন্যান্য গানের মধ্যে লাকী আখান্দের সুরে নিয়াজ মোহাম্মদ চৌধুরীর গাওয়া ‘আজ এই বৃষ্টির কান্না দেখে’ এবং মান্না দের গাওয়া নজরুলসংগীত ‘শাওন রাতে যদি স্মরণে আসে মোরে’ গান দুটি তুমুল জনপ্রিয়।
তবে বর্ষা নিয়ে বাংলা সাহিত্যের সৃষ্টি যেন একটি বলয়ে আবদ্ধ হয়ে আছে। বলা যায় মধ্যযুগেই আটকে আছে। বিদ্যাপতির ‘এ ভরা বাদর মাহ ভাদর শূন্য মন্দির মোর’, এ পদে যে কাতরতা প্রকাশ পেয়েছে, তা থেকে বাংলা কবিতা ও গান সরে আসতে পারেনি আজও। কবিতা ও গানে এখনো বিরহকাতর মনের প্রতিফলন ঘটে চলেছে।
শিবলী আহমেদ
ইলাস্ট্রেশন: দিদারুল দিপু