কভারস্টোরি I বর্ষামঙ্গল
স্নিগ্ধ শ্যামলিমাময় সময়, কিন্তু সৌন্দর্যের জন্য অশনিসংকেত। সামান্য অসতর্কতা মানেই অনাসৃষ্টি। তাই প্রয়োজন পারফেক্ট মনসুন ম্যানুয়াল। জানাচ্ছেন জাহেরা শিরীন
আকাশভাঙা বৃষ্টি, বাতাসে সোঁদা সুবাস। প্রকৃতির অদ্ভুত সুন্দর রূপ। কিন্তু এই দারুণ আবহাওয়ার নিদারুণ প্রভাবে ঠিক বিপরীত চিত্র ত্বকে আর চুলে। ম্যাড়ম্যাড়ে অনুজ্জ্বল ত্বক, চুল উষ্কখুষ্ক আর জটাধরা। অন্যদিকে অবিরত বৃষ্টি ও বাতাসের আর্দ্রতার ফলে ঘাম— এ দুয়ের জন্য বর্ষাকালে মুখে মেকআপ টিকিয়ে রাখাও রীতিমতো চ্যালেঞ্জের ব্যাপার। আর যদি একদম অনপয়েন্ট পারফেক্ট মেকআপ করেও নেওয়া হয়, বিপত্তি কিন্তু কমবে না। বাইরে বেরোলেই দেখা যাবে আকাশের মুখ ভার। একদম প্রস্তুত মেকআপের বারোটা বাজানোর জন্য। কারণ, এক পশলা বৃষ্টির এক ছাটই যথেষ্ট পুরো সাজ মাটি করে দিতে। তাই বর্ষার কটা দিন বাড়তি যত্নআত্তি প্রয়োজন ত্বক আর চুলের। দরকার পড়বে সতর্কতার। সঙ্গে ঠিকঠাক সংরক্ষণ করতে হবে সৌন্দর্যচর্চার সব পণ্যও। বাছাইও করা চাই বুঝেশুনে। তাই আগেভাগেই আটঘাট বেঁধে রাখা চাই। বর্ষাকে বাগ মানানোর জন্য। তবেই দেখবেন, যত ঝড়ঝাপটাই আসুক না কেন, সৌন্দর্য আর সাজ থাকবে নিখুঁত।
বছরের অন্য সব সময়ের মতো বর্ষাতেও জরুরি ত্বক পরিষ্কার করা। কিন্তু হুড়োহুড়ি করে ক্লিনজিং ওয়াইপ ব্যবহারের বুদ্ধি বাদ দেওয়াই ভালো। বরং ডাবল ক্লিনজিং সবচেয়ে ভালো। অয়েল বেসড, সোপ ফ্রি ক্লিনজার ত্বকের প্রাকৃতিক তেল নষ্ট করবে না। কিন্তু পরিষ্কার করবে পরিপূর্ণভাবে।
দিনে তিন থেকে চারবার ত্বক পরিষ্কার করা উচিত। এতে বৃষ্টির পানি বসতে পারবে না ত্বকে। সেই সঙ্গে ব্যাকটেরিয়া থেকে মুক্ত থাকবে। বর্ষায় বাতাসের বাড়তি আর্দ্রতার ফলে ঘাম বেশি হয়। তাই ত্বকের লোমকূপ খোলা থাকে বেশির ভাগ সময়। তা বন্ধের ব্যবস্থা করা চাই। অ্যালকোহল ফ্রি, অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট উপাদান— যেমন গ্রিন টি কিংবা গ্লাইকোলিক অ্যাসিডে পরিপূর্ণ টোনার এ ক্ষেত্রে দারুণ কার্যকর; যা লোমকূপের মুখ বন্ধ করে দেয়, প্রতিরোধ করে ব্লেমিশ আর ব্রণ। মাইক্রোডার্মাব্রেশন অথবা কেমিক্যাল পিলের মতো ট্রিটমেন্ট দিয়ে ত্বক এক্সফোলিয়েট করতে হবে নিয়মিত। এতে করে জীবাণু আর মৃতকোষ জমতে পারবে না। ময়শ্চারাইজও করতে হবে। এ ক্ষেত্রে বর্ষায় অ্যালোভেরা, গ্রেপ সিডের মতো প্রাকৃতিক উপাদানে তৈরি লাইট, নন-গ্রিসি ময়শ্চারাইজার রাখা চাই তালিকার শীর্ষে। এগুলো ত্বককে বাড়তি তেলে আর চ্যাটচ্যাটে ভাব থেকে রক্ষা করবে। দূরে রাখবে দূষণ থেকে। সপ্তাহে এক দিন ব্যবহার করা যেতে পারে মাস্ক। মাড, টি ট্রি অথবা গ্রিন টি এক্সট্র্যাক্টযুক্ত এসব মাস্ক ত্বকের মৃতকোষ তো সারাবেই, সঙ্গে লোমকূপ রাখবে ব্যাকটেরিয়ামুক্ত। ফলে সুস্থ থাকবে ত্বক। সানস্ক্রিন ব্যবহারের কথা ভোলা যাবে না একদমই। নিদেনপক্ষে এসপিএফ ৩০ যুক্ত, নন-স্টিকি, লাইটওয়েট আর ম্যাট ফিনিশের সানস্ক্রিন বর্ষায় বেশি স্বস্তিকর। হাত, পা এবং শরীরের ত্বকেরও নিতে হবে একই রকম যত্ন।
শুধু ত্বকের যত্ন নিয়েই নিশ্চিত হয়ে গেলে চলবে না, যত্নে রাখা চাই পণ্যগুলোও।
বর্ষায় তা আরও বেশি প্রয়োজন। প্রথমেই সূর্যের আলো থেকে দূরে রাখা চাই পণ্যগুলো। কারণ, এই আলো তাপমাত্রার তারতম্য ঘটিয়ে পণ্যের কার্যকারিতা নষ্ট করে ফেলে। তাই ক্যাবিনেট কিংবা ড্রয়ার এ ক্ষেত্রে উপযুক্ত জায়গা। কিন্তু বাথরুমের কথা ভুলেও চিন্তা করা যাবে না। একে তো ব্যাকটেরিয়ায় পরিপূর্ণ, তার ওপর গোসলের ফলে রুমজুড়ে যে ভাপ সৃষ্টি হয়, তা পণ্যের উপাদানগুলোকে সহজে নষ্ট করে দেয়, করে তোলে অক্সিডাইজ। ফ্রিজে সংরক্ষণ করা যেতে পারে প্রাকৃতিক কিংবা অর্গানিক উপাদানে তৈরি ময়শ্চারাইজার, আই ক্রিম, ফেস মিস্ট, টোনার আর শিট মাস্ক। ভিটামিন সি, রেটিনয়েডের মতো লাইভ অ্যাকটিভ উপাদানও রেফ্রিজারেটরে বেশি নিরাপদ। অয়েল বেসড প্রডাক্টগুলো রুম টেম্পারেচারেই বেশি ভালো থাকে।
বর্ষা এলেই চুলের স্বাস্থ্যের চিন্তায় বৃষ্টিকে অনাসৃষ্টি মনে হতেই পারে। অবিরাম বৃষ্টিতে মাঝেমধ্যে ভিজতে হয়, তাতে চুলের সমস্যা তো হবেই। আসলে বৃষ্টির পানিতে রয়ে যাওয়া বিভিন্ন কেমিক্যাল ও অত্যধিক দূষিত পদার্থ আসল বিপত্তির কারণ। আর তাই বর্ষায় বাড়ে চুল পড়া আর খুশকি। শুরু হয় মাথার ত্বকে যন্ত্রণাদায়ক সংক্রমণ। চুল সহজে শুকায় না, স্যাঁতসেঁতে থাকার ফলে সৃষ্টি হয় অস্বস্তিকর দুর্গন্ধ। এ ক্ষেত্রে পরিচ্ছন্নতাই সমাধানের শেষ কথা। বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ, এ সময়টাতে চুলেও জরুরি বাড়তি যত্নআত্তি। নিয়মিত হট অয়েল ট্রিটমেন্ট করার পাশাপাশি সঠিক শ্যাম্পু আর কন্ডিশনারে চুলের প্রাণোজ্জ্বলতা বজায় থাকে। ব্যবহার করা যেতে পারে ভালো হেয়ার সেরাম। গোড়া মজবুত থাকে, চুলে আসে চমক। ম্যাড়ম্যাড়ে ভাব দূর করতে দরকার হবে হাইড্রেটিং মাস্ক। বর্ষায় চুল কালার করা থেকে বিরত থাকলেই ভালো। আর হেয়ারস্টাইলিং টুল এড়িয়ে যেতে পারলে তো দারুণ। চিরুনি পরিষ্কার রাখা চাই প্রতিদিন। এতে ব্যাকটেরিয়া সংক্রমিত হবে না।
বর্ষায় মেকআপ ব্যবহারেও চাই সতর্কতা। মুখভর্তি মেকআপ একদমই মানানসই নয় এ সময়ে। বরং সহজ কিছু কৌশলেই সেরে নেওয়া যাবে মনসুন ফ্রেন্ডলি মেকআপ। ময়শ্চারাইজার মেখে নেওয়া চাই প্রথমে। কারণ, ওয়াটারপ্রুফ মেকআপ ত্বককে শুষ্ক করে তোলে। সে ক্ষেত্রে ময়শ্চারাইজার মাস্ট। তারপর প্রয়োজন হবে প্রাইমার। দৃশ্যমান লোমকূপ সারাবে, দীর্ঘস্থায়ী করবে মেকআপ। তৈরি করবে নিখুঁত ত্বকের ক্যানভাস। ফাউন্ডেশন মাখার দরকার নেই, বরং সানস্ক্রিন আর পাউডারে বেজ তৈরি করে নেওয়া যায়। আর যদি ফাউন্ডেশন ছাড়া না-ই চলে, সে ক্ষেত্রে টিন্টেড অথবা ইলিউমিনেটিং ফর্মুলাগুলোর বেশি জুতসই। চোখের সাজে ক্রিমি আইশ্যাডো, ওয়াটারপ্রুফ লিকুইড বা জেল লাইনার আর মাসকারাতেই তৈরি করে নেওয়া যাবে লুক। লিপস্টিকের বদলে লিপ লাইনার ব্যবহার হবে বুদ্ধির কাজ। গালে ক্রিম ব্লাশঅনে চেহারায় প্রাণময়তা ফিরে আসবে। সবশেষে ওয়াটারপ্রুফ ফিনিশিং মিস্ট দিয়ে মেকআপ সেট করে নিলেই তৈরি মনসুনপ্রুফ লুক। এ সময় বাড়তি নজর দিতে হবে মেকআপ পণ্য সংরক্ষণে। পাউডারি প্রডাক্টগুলো বাতাসযুক্ত শুষ্ক স্থানে রাখা যেতে পারে। লিকুইড বা জেল ফর্মুলার মেকআপ সংরক্ষণের জন্য রুম টেম্পারেচারই যথেষ্ট। প্রতিবার মেকআপ ব্যবহারের পর অবশ্যই ভালো করে ঢাকনা বন্ধ করা দরকার। নয়তো বর্ষার আর্দ্র আবহাওয়ায় স্যাঁতসেঁতে হয়ে কার্যকারিতা নষ্ট হয়ে যাওয়া সময়ের ব্যাপার শুধু। সব সময় ওয়াটারপ্রুফ ব্যাগ অথবা স্লিপ পাউচ সঙ্গে রাখা উচিত। হঠাৎ বৃষ্টিতে টুপ করে সব মেকআপ প্রডাক্ট পুরে নেওয়া যাবে এতে। যদি ভিজেও যায়, চটজলদি হেয়ারড্রায়ার দিয়ে শুকিয়ে নেওয়া চাই। কদিন পরপর মেকআপ প্রডাক্টগুলো পরীক্ষা করে নিতে হবে। জমাট বেঁধে গেলে, রঙ উবে গেলে কিংবা আঁশটে গন্ধ এলেই বুঝতে হবে উপযোগিতা হারিয়েছে মেকআপ প্রডাক্ট। সাবধান! ব্যবহার করা যাবে না এগুলো। আর মেকআপ সারার পর বারবার মুখে হাত দেওয়ার অভ্যাস খুব বাজে। মেকআপ স্মাজ তো হবেই। হাতের ময়লা লেগে ত্বকের ক্ষতিও হবে।
মডেল: ওশিন
মেকওভার: পারসোনা
ওয়্যারড্রোব: শাড়ী ক্লাব
ছবি: সৈয়দ অয়ন