ফিচার I ওয়ার্ক এটিকেট
ড্রেস কোড, পরিপাটি অফিস, সুসজ্জিত কনফারেন্স রুম, ডেস্কটপ কিংবা ল্যাপটপ, মিটিং—এই সব মিলিয়ে নয়টা-পাঁচটার যে প্রাত্যহিক জীবন, তার অন্দরে আলোকপাত করেছেন রুম্পা সৈয়দা ফারজানা জামান
ভারতীয় চলচ্চিত্র ‘করপোরেট’। তাতে দেখা যায় কী করে একজন সাধারণ মানুষ তারকা হয়, কোন দোলাচলে সে প্রতারণার ফাঁদে পা দেয়। আবার কীভাবে সেই তারকা খসে পড়ে। করপোরেট জীবন অতটা সিনেম্যাটিক না হলেও তাতে নাটকীয়তার অভাব নেই। কারও পৌষ মাস, কারও সর্বনাশ—কথাটা করপোরেটদের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে। বাইরে থেকে মনে হয়, সব সময় অন্যকে মাত করার জন্য করপোরেটরা এক পা এগিয়ে। কিন্তু বাস্তব বলে তাদের জীবন ডেডলাইন আর ডেলিভারিতে আবর্তিত।
পিংক ক্রিয়েটিভের চিফ অপারেশন অফিসার তৌফিকুল আলমও সেটাই বললেন। কথায় কথায় যোগ করলেন, আমাদের জীবনটা চাকচিক্যময় মনে হয়। হয়তো তাই। কিন্তু সে জন্য পরিশ্রম, মেধা ও যোগ্যতার প্রয়োজন। মেধা না থাকলে করপোরেট জীবনে উন্নতি করা বেশ মুশকিল।
তার ব্যাখ্যা বেশ সোজাসাপটা। করপোরেটদের জীবন ছকে বাঁধা। সকালে এসে ই-মেইল চেক করা থেকে শুরু করে বিকেলে কম্পিউটার বা ল্যাপটপ বন্ধ করার আগ পর্যন্ত মনোযোগ এদিক-সেদিক দেওয়ার সুযোগ একচুলও নেই। আর প্রতিযোগিতা? আসলে প্রতিযোগিতা নয়। দিন শেষে কোম্পানি আউটপুট দেখবে। কেউ যদি একাধিকবার বা একবারই প্রয়োজনীয় কাজটা করতে অক্ষম হয়, তখন আরেকজনকে সেই দায়িত্ব দিতেই হবে। কারণ, কাজ তো শেষ করতে হবে। যেমন ধরুন, আমরা যখন টিভিসি প্রোডাকশনে যাই, সেটার ডেলিভারির তারিখ আগেই ঠিক করা থাকে। মাঝে ঝড় হোক কী বৃষ্টি হোক, সে-সময়ের মধ্যেই কাজটি করতে হবে। ব্যাকআপ ভাবতে হবে। কিন্তু কখনোই ডেট মিস করা যাবে না। দায়সারাভাবে কাজটা করা যাবে না। তাতে কোয়ালিটি বা মান থাকবে না।
ডিনেট সোশ্যাল এন্টারপ্রাইজের মানবসম্পদ বিভাগের ডেপুটি ম্যানেজার ফারজানা আহমেদ ফারিয়াও বললেন একই কথা, ‘আমাদের প্রতিষ্ঠান কিছুটা এনজিও টাইপের হলেও এখানে আমরা করপোরেট কালচার মেনে চলি। কে কীভাবে কার সঙ্গে আচরণ করবে, কেমন পোশাক পরা বাঞ্ছনীয়, কোন ধরনের শব্দ নির্বাচন বা এড়ানো দরকার—এসবই মেনে চলি আমরা, কাজের পাশাপাশি।’
দুর্জন বিদ্বান হলেও পরিত্যাজ্য—এমন কথাটি বিশ্বাস করে টেলকোতে কর্মরত শাফায়েত। তিনি বলেন, ‘করপোরেট জগৎ মানেই প্রতিযোগিতা; কিন্তু রাজনীতি নয়। এমন সময় অনেক ভালো, মেধাবী সহকর্মীদের আমরা ত্যাগ করতে বাধ্য হই তাদের আচার-আচরণ, ব্যক্তিগত উপস্থাপনা, অন্যের প্রতি নেতিবাচক ব্যবহারের কারণে। কারণ, যেখানে আমাদের দিনের অধিকাংশ সময় দিতে হয়, সেখানে কোনো রকমের ব্যাঘাত কেউই চায় না।’
একই কথা বলেন আরেক মানবসম্পদ কর্মকর্তা সাবরীনা। করপোরেট মানে শুধু মোটা বেতন নয়। এটা একটা লাইফস্টাইলও। নিজে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে কাজ করে বর্তমানে কর্মশালার মাধ্যমে এসব তথ্যই শিক্ষার্থীদের মধ্যে ছড়িয়ে দিচ্ছেন তিনি। প্রতিষ্ঠানে বিভিন্ন কর্মীর সাদা চোখে সবাইকে এক কাতারে বিচার করার যে প্রবণতা, তাতে যেমন তিনি অসম্মতি জানিয়েছেন, তেমনই করপোরেটদেরও কিছু গাইডলাইন মেনে চলার জন্য অনুরোধ করেছেন।
যেমন, আচরণ। এটা খুব গুরুত্বপূর্ণ এখন প্রতিষ্ঠানগুলোতে। বিশেষ করে নারীর প্রতি আচরণ কেমন হওয়া উচিত, সে নিয়মও আছে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে। নারী সহকর্মীকে কেউ অসম্মান করলে পত্রপাঠ বিদায়ের বিধিও রেখেছে কিছু প্রতিষ্ঠান।
সময়মতো উপস্থিতি এবং কাজ যথাসময়ে শেষ করার ওপর এখন বেশি জোর দেওয়া হয়। তবে দীর্ঘক্ষণ অফিসে থাকলে যে মানবসম্পদের অপব্যবহার হতে পারে, সেটা নিয়ে প্রতিষ্ঠান এখন বেশি সচেতন।
অনেকের মতে, করপোরেটদের জীবনে শুধু উপরে ওঠার মোহ। এ কথা মানতে নারাজ সংশ্লিষ্টরা। তাদের মতে, ওপরে ওঠার জন্য নয়, নিজের অবস্থান শক্ত করার অবিরাম প্রচেষ্টা থাকে সবার। নতুন কাজের জায়গা তৈরি করা, যুগের সঙ্গে মেলানোর অধ্যবসায়ে থাকতে হয় বলেই মনে হতে পারে করপোরেট লোকজন কেবল ওপরে ওঠার জন্য ব্যাকুল। কাউকে কাউকে যান্ত্রিক বা রূঢ় মনে হতে পারে।
করপোরেট জগতের কাজ যতটা শারীরিক, তার চেয়ে বেশি স্নায়বিক। এই চাপ দীর্ঘদিন অব্যাহত থাকলে একরকম অবসাদ তৈরি হয়। তা দূর করার জন্য অফিসের কাজ বাসায় না আনার পরামর্শ দেন এখন সবাই। যত দেরি হোক, অফিসের কাজ অফিসেই শেষ করতে হয়। মানবসম্পদ কর্মকর্তারা তাই বলেন। স্ট্রেস ফ্রি রাখতে কর্মীদের জন্য নানা রকমের বিনোদনের ব্যবস্থাও করছেন এখন তারা।
করপোরেট জীবন মন্দ নয়, বলেন অনেকেই। জীবনযাপনে পরিবর্তন আসবে, যদি নিজেকে উপরে তোলা যায়। কিন্তু অসুস্থ প্রতিযোগিতায় মেতে থাকলে শুধু করপোরেট নয়, ব্যক্তিগত জীবন থেকেও ছিটকে পড়তে হয়।
সময়মতো সিদ্ধান্ত নেওয়ার সামর্থ্য ও চর্চা করপোরেট জীবনে বেশি জরুরি। আবেগের থেকে বিচক্ষণতা এখানকার পেশাগত উন্নয়নে সুফল নিয়ে আসে।
সর্বোপরি নিজের কাজটা ভালোমতো জানতে হবে এবং করতে হবে। অর্পিত দায়িত্ব পালনে মনোযোগী ও কৌশলী হলে করপোরেট জীবনের পথ শুধু মসৃণই নয়, আলোকিতও হবে। আত্মপ্রতিষ্ঠা তাতে ঘটবেই, অন্যদের কাছেও অনুকরণীয় হয়ে ওঠা সম্ভব হবে।
মডেল: তাহমিদ
ওয়্যারড্রোব: ওকোড
মেকওভার: পারসোনা
ছবি: সৈয়দ অয়ন