ফিচার I বাংলা ভাষায় বিয়ের বই
ভারতীয় পুরাণে বলা আছে, মহর্ষি উদ্দালকের পুত্র শ্বেতকেতু ভারতবর্ষে বিয়ের প্রচলন করেছিলেন। এ ভাষ্যের কোনো সত্যতা নেই। বিয়ে মানবসমাজে কীভাবে প্রচলিত হয়েছে, তা সুনির্দিষ্ট করে বলা যায় না। বিয়ে সামাজিক বন্ধনকে জোরালো করে- এ কথা আজ সমাজস্বীকৃত। বাংলা ভাষায় বিয়ে নিয়ে নানা সময় বেশ কিছু বই প্রকাশিত হয়েছে। আলোচ্য নিবন্ধে বিয়েসংক্রান্ত বাংলা ভাষায় প্রকাশিত তেমন কিছু বইয়ের হদিস দেওয়া হলো।
বাঙালি জীবনে বিবাহ
গ্রন্থকার: শঙ্কর সেনগুপ্ত
প্রকাশক: চিত্তরঞ্জন সেনগুপ্ত
প্রকাশনী: ইন্ডিয়ান পাবলিকেশন্স
নয়টি অধ্যায়ে বিন্যস্ত এ বইয়ে প্রথম অধ্যায়ের শিরোনাম ‘সূচনা: কথারম্ভ’। এখানে বাঙালি সমাজে বিয়ে প্রথার উৎপত্তি ও বিকাশ কীভাবে হয়েছে, তা আলোচনা করা হয়েছে। ‘জাতি, বর্ণ ও শ্রেণী পরিচয়’ শিরোনামের দ্বিতীয় অধ্যায়ে বর্ণের সঙ্গে বিয়ের সম্পর্ক কত গভীর, তা বলা হয়েছে। কৌলীন্য প্রথা একসময় ভারতীয় সমাজে ব্যাপক মাত্রায় ছিল। পঞ্জিকার শাসন মেনে বিয়ে হতো। হিন্দু বিয়ে, বৌদ্ধ বিয়ে, মুসলিম বিয়ে, খ্রিস্টান ও ব্রাহ্মসমাজী বিয়ে, আদিবাসী বিয়ের রীতি-পদ্ধতি নিয়ে ধারাবাহিক আলোচনা করা হয়েছে। বিয়েসম্পর্কিত যাবতীয় চিন্তা, শয্যা-আচরণ, প্রেম-ভালোবাসা, দাম্পত্য সুখ ও পরিবার পরিকল্পনাসম্পর্কিত চিন্তাভাবনা শেষ অধ্যায়ে লেখকের বক্তব্যে উঠে এসেছে। বাংলা ভাষায় বিয়ে নিয়ে এমন বিস্তারিত কাজের উদাহরণ খুব বেশি নেই।
ভারতের বিবাহের ইতিহাস
গ্রন্থকার: অতুল সুর
প্রকাশক: সুবীরকুমার মিত্র
প্রকাশনী: আনন্দ পাবলিশার্স প্রাইভেট লিমিটেড
ভারতীয় সংস্কৃতিতে নানা জাতির মিশ্রণ প্রাচীনকালই দেখা যায়। বিভিন্ন জাতির বিবাহপ্রথা ভিন্ন। বেদ, রামায়ণ, মহাভারতসহ নানা পৌরাণিক ও ঐতিহাসিক গ্রন্থ পাঠ করে লেখক এই গ্রন্থে ভারতের বিবাহপ্রথা তথা যৌনজীবনের ইতিহাস লিপিবদ্ধ করেছেন। গ্রন্থটিকে ভারতের বিবাহপ্রথার আনুপূর্বিক ইতিহাস বলা যায়। লেখক অতুল সুর প্রথমে যৌনজীবনের পটভূমিকা নিয়ে আলোচনা করেছেন। এরপর প্রাচীন ভারতের বিবাহপ্রথা, যৌনাচারের ওপর স্মৃতিশাস্ত্রের প্রভাব ব্যক্ত করেছেন। জ্ঞাতিত্ব ও স্বজন বিয়ের মতন ভারতীয় সমাজে আপাতনিষেধাজ্ঞা রয়েছে এমন বিয়ের বিষয়েও কথা বলেছেন। বিবাহপূর্ব যৌন সংসর্গ অথবা বিবাহবহির্ভূত যৌন সংসর্গের মতো স্পর্শকাতর বিষয় রয়েছে বইটিকে।
বিয়ে
গ্রন্থকার: মাহমুদা ইসলাম
প্রকাশক: মুহম্মদ নূরুল হুদা
প্রকাশনী: বাংলা একাডেমি
ভাষাশহীদ গ্রন্থমালা সিরিজে ১৯৮৫ সালে বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত হয় গ্রন্থটি। লেখক আদিযুগ থেকে বর্তমান যুগ পর্যন্ত দেশ-বিদেশের বিভিন্ন সমাজ ও সময়ে বিয়ের রীতি-প্রথা-আনুষ্ঠানিকতা বিষয়ে তথ্যভিত্তিক বর্ণনা সন্নিবেশ করেছেন। লেখিকা বিয়ের সংজ্ঞা, লক্ষ্য, উৎপত্তি, আচার-অনুষ্ঠান এমনকি ভবিষ্যৎ নিয়ে আলোচনা করেছেন। একই সঙ্গে তিনি বাংলাদেশের বিয়ে বিষয়ে আনুপূর্বিক বক্তব্য উপস্থাপন করেছেন।
বাংলাদেশের লৌকিক আচার-অনুষ্ঠান জন্ম ও বিবাহ
গ্রন্থকার: মোমেন চৌধুরী
প্রকাশক: শামসুজ্জামান খান
প্রকাশনী: বাংলা একাডেমি
মোমেন চৌধুরী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ‘বাঙালি লোকজীবনে ও বাংলা সাহিত্যে লৌকিক আচার : জন্ম ও বিবাহ’ শিরোনামে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন। এটি তারই গ্রন্থবদ্ধ রূপ। মোট চারটি অধ্যায়ে গ্রন্থটি বিন্যস্ত। প্রথম অধ্যায়ে আছে লৌকিক আচারের সংজ্ঞা, তাত্ত্বিক ও আঙ্গিকগত দিক। দ্বিতীয় অধ্যায়ে লৌকিক আচারে মাতৃতান্ত্রিক প্রভাব, পিতৃতন্ত্র ও নারীসমাজ, লৌকিক আচারে আদিবাসী প্রভাব এবং তার বৃদ্ধি ও হ্রাসের কারণসমূহ চিহ্নিত করা হয়েছে। তৃতীয় অধ্যায়ের বিষয় : জন্ম। চতুর্থ অধ্যায়ের বিষয় ‘বিবাহ’। বিয়ের উদ্ভব, বিবর্তন, উদ্দেশ্য এবং কারণসমূহ এখানে আলোচিত হয়েছে। এ ছাড়া সামাজিক গুরুত্ব সম্পর্কেও আলোকপাত করা হয়েছে। সেই সঙ্গে বিবাহসম্পর্কিত শব্দের টীকা, গ্রন্থপঞ্জি, নির্ঘণ্ট ইত্যাদি গবেষণাসংশ্লিষ্ট বিষয়ও আছে।
চীনের ক’টি সংখ্যালঘু জাতির বিবাহপ্রথা
গ্রন্থকার: থিয়েন শিং (সম্পাদিত)
প্রকাশনী: বিদেশি ভাষা প্রকাশনালয়
চীনে বহু জাতির বাস। প্রায় ছাপ্পান্নটি জাতির বাস সেখানে। যাদের সংস্কৃতি, শিল্পকলা, ধর্ম ও সংস্কারের মধ্যে অনেক পার্থক্য রয়েছে। বিভিন্ন জাতির বিয়েসংক্রান্ত প্রথা, রীতিনীতি আর আচার-অনুষ্ঠানের মধ্যে যথেষ্ট পার্থক্য বিদ্যমান। এই বইয়ে পুই, কিনো, হানি, তুং, ইয়াও, তাই, থুচিয়া, সালার, ই, কুইচৌ, নাসি, তাজিক, মিয়াও- এমন বিশটি জাতির বিয়ের বিবরণ দেওয়া আছে। এই বিবরণের মাধ্যমে চীনের সংখ্যালঘু জাতিগুলোর বিয়ে সম্পর্কে প্রাথমিক ধারণা পাওয়া যায়। এসব রীতিনীতি আর আচার-অনুষ্ঠান পর্যালোচনার মাধ্যমে বিবাহ ও পরিবারসংক্রান্ত ইতিহাসকে জানা যায়।
মুসলমান সমাজে বিয়ের গীত
গ্রন্থকার: শক্তিনাথ ঝা
প্রকাশক: অনুপকুমার মাহিন্দার
প্রকাশনী: পুস্তক বিপণি
মুসলমান মেয়েদের বিয়ের গান নারী সমাজের এক গুরুত্বপূর্ণ ভাষ্য। নারীরাই এর রচয়িতা এবং নারীদের মধ্যেই এর প্রচলন। পূর্বতন গবেষকেরা এ গানকে আচার-সংগীত হিসেবে বিচার করেছেন কিন্তু লেখক তা করেননি। তিনি বরং নারীর আত্মপ্রকাশের দৃষ্টিকোণ থেকে গানগুলো সংগ্রহ করেছেন। প্রথমে রয়েছে এ-সংক্রান্ত আলোচনা এবং পরে আছে ২২৫টি বিয়ের গান বা গীত। গানগুলোর বর্ণনাক্রমিক সূচি করা হয়েছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে লৌকিক শব্দের প্রমিত ভাষ্য দেওয়া হয়েছে।
গায়েহলুদ
গ্রন্থকার: শাহীদা আখতার
প্রকাশক: আশফাক-উল-আলম
প্রকাশনী: বাংলা একাডেমি
গায়েহলুদ বাঙালি বিয়ের অতিপরিচিত অনুষ্ঠান। পরিচিত হলেও এ নিয়ে স্বতন্ত্র বই প্রকাশিত হয়নি। সে ঘাটতি পূরণ করতে চেয়েছেন লেখিকা। গায়েহলুদ অনুষ্ঠানের সুলুক সন্ধান করেছেন তিনি। বাঙালি হিন্দু-মুসলিম উভয় সমাজে গায়েহলুদের প্রচলন আছে। তিনি ঢাকা, ফেনী, চট্টগ্রাম, কুড়িগ্রাম, রংপুরের ক্ষেত্রসমীক্ষায় প্রাপ্ত তথ্য ব্যবহার করেছেন।
বিয়ের শব্দকোষ
গ্রন্থকার: হরিপদ ভৌমিক
প্রকাশক: অণিমা বিশ্বাস
প্রকাশনী: গাঙচিল
প্রাচীনকালে প্রতিপক্ষের ওপর আক্রমণ করে তাদের কন্যাদের ধরে-বেঁধে এনে বিয়ে করা হতো। ‘যাকে বেঁধে আনা হয়েছে’ সেই অর্থে তাঁকে বধূ বলা হতো, এই বধূ > বহু > বউ হয়েছে। বৈদিক যুগ থেকে সংহিতার যুগ পর্যন্ত বিয়েতে শাস্ত্রীয় ও লৌকিক নানান অনুষ্ঠানের পরিবর্তন হয়েছে। লৌকিক ও শাস্ত্রীয় আচার তাই ধীরে ধীরে গুরুত্ব হারাচ্ছে। হারিয়ে যেতে বসেছে বিয়ের অনুষ্ঠানের নানান দিক। সেই বিয়ের অনুষ্ঠানের শব্দ নিয়েই রচিত ‘বিয়ের শব্দকোষ’ বইটি, যা বাংলা ভাষায় প্রথম।
বাংলা বিয়ের গান
গ্রন্থকার: রত্না রশীদ বন্দ্যোপাধ্যায়
প্রকাশক: অণিমা বিশ্বাস
প্রকাশনী: গাঙচিল
বিয়ের গানের প্রধান স্রষ্টা ছিল নারী এবং শ্রোতাও ছিল নারী। বাংলার ব্রতপার্বণ ও বিয়ের গানের জগতে পুরুষদের প্রবেশাধিকার ছিল না বললেই চলে। বিয়ের গানের মধ্যে লেখিকা নারীমনের সুলুক সন্ধান করেছেন। তিনি অনেক দিন ধরেই বাঙালি মুসলমান মেয়েদের বিয়ের গান সংগ্রহ করে যাচ্ছেন। বাংলা বিয়ের গানের বিষয়বৈচিত্র্য রীতিমতো চমকে দেওয়ার মতো। লেখিকা সংগৃহীত ‘জৈগুন বানুর বারমাস্যা’ বাংলা বিয়ের গানের অনবদ্য এক গীতিনাট্য। এই গ্রন্থে নারীমনের সন্ধান রয়েছে। তাই এটি প্রথাগত কোনো গানের সংকলন নয়, গ্রামীণ নারীদের কথোপকথনের মাধ্যমে তাঁদের জীবনদর্শন ধরার চেষ্টা করা হয়েছে আন্তরিকতার মাধ্যমে।
বিয়ের তত্ত্ব
গ্রন্থকার: সুভাষ মুখোপাধ্যায়
প্রকাশক: সুমন ভৌমিক
প্রকাশনী: সূত্রধর
ছোট এই পুস্তিকায় লেখক বিয়ের প্রচলন কীভাবে ভারতীয় সমাজে শুরু হয়, তা বর্নণা করতে চেয়েছেন। ‘স্বয়ংবরা’, ‘যার বিয়ে তার দেখা নেই’, ‘অনুষ্ঠানের মানে’, ‘বিবাহ চুক্তি’, ‘নিষিদ্ধ সম্পর্ক’, ‘সবাই মা’, ‘বহুবিবাহ’, ‘আর্য হিন্দু’, ‘দক্ষিণ ভারতের যৌথ বিবাহ’- এমন ছোট ছোট শিরোনামে বিখ্যাত কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের এ পুস্তিকা।
মহাভারতে বিবাহ
গ্রন্থকার: শামিম আহমেদ
প্রকাশক: অণিমা বিশ্বাস
প্রকাশনী: গাঙচিল
বিয়ের শুরু কবে, বিয়ে কত রকমের হতে পারে, কোন কোন বিয়েকে সমাজ অনুমোদন করে আর কোনগুলোকে করে না, পেছনের কারণগুলোই-বা কী- এমন অনেক প্রশ্ন নিয়ে এই গ্রন্থে হাজির হয়েছে মহাভারতের বিয়ে-সম্পর্কিত নানা তথ্য। প্রাক্-বৈবাহিক সম্পর্ক থেকে স্বজনবিবাহ, নারী বা পুরুষের বহুবিবাহ থেকে দাসী, রক্ষিতা ও গণিকার সঙ্গে স্ত্রীর মতো সম্পর্ক, গর্ভাধান, বিবাহবিচ্ছেদ থেকে সতীত্ব-অসতীত্ব নিয়ে নানা বিতর্ক। মহাভারত থেকে যে প্রাচীন ভারতের বিয়ের ইতিহাস পাওয়া সম্ভব, এই গ্রন্থই তার প্রমাণ।
উদয় শংকর বিশ্বাস
লেখক: রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ফোকলোর বিভাগের অধ্যাপক এবং গবেষক