ঘরেবাইরে I ব্যাচেলর প্যাড
জীবনধারার সঙ্গে মিলিয়ে অন্দর সাজালে বসবাস হয়ে ওঠে আরামদায়ক। অবিবাহিতদের বেলায় এমনটি বেশি প্রযোজ্য। তেমনই একটি ব্যাচেলর প্যাডের ফিরিস্তি দিচ্ছেন শিবলী আহমেদ
ব্যাচেলরদের ফ্ল্যাটের অন্দর নিয়ে ভাবলে অগোছালো একটি চিত্র ভেসে ওঠে। মেঝেতে ধুলা। দু-একটি আসবাব যা আছে, তা-ও হয়তো অবিন্যস্ত। ব্যবহার্য তৈজসের দিকে তাকালে অব্যবস্থা আরও স্পষ্ট হয়ে ওঠে। কাঠের টেবিলে চায়ের দাগ। ঘরের ভেতর অপরিচ্ছন্নতা ও অযত্নজনিত অস্বস্তিকর গন্ধ। এখানে-সেখানে কাপড় ছড়ানো। বইপত্র অগোছালো। বৈদ্যুতিক সুইচগুলো পুরোনো ও বিপজ্জনক। ছাইদানি উপচে আছে সিগারেটের অবশিষ্টাংশে।
কিন্তু সব ব্যাচেলরের বাসা যে এমন অবিন্যস্ত, তা নয়। ব্যক্তিত্ব ও অভিরুচির মিশেলে নিজের ফ্ল্যাট সাজিয়ে বাস করছেন অনেকেই।
গুলশানের একটি ফ্ল্যাটে একা থাকেন ফ্যাশন ব্র্যান্ড জুরহেমের কো-ফাউন্ডার ও চেয়ারম্যান সাদাত চৌধুরী। মনমতো সাজিয়েছেন তার বাসস্থানটি। যাপিত জীবনের সঙ্গে সমন্বয় করে। দরজার ছিটকিনি থেকে শুরু করে ওয়াশরুমের ট্যাপ পর্যন্ত নান্দনিক। শোবার ঘরটাও আয়েশি। বিছানার এক পাশে ফ্রেঞ্চ উইন্ডো। ঘাড় ঘোরালে জানালা। সবুজ গাছপালা। ফ্ল্যাটের মেঝে, দেয়ালের রং, পেইন্টিংস, স্কাল্পচার, আসবাব- সবই দৃষ্টিসুখকর। একা থাকার জন্য এমন অন্দর জুতসই বটে।
ইন্টেরিয়র করেছেন টিপিক্যাল নিউইয়র্ক পেন্টহাউসের আদলে। মেঝেতে কালো মিরর টাইলস ব্যবহার করেছেন সাদাত। তবে কালো টাইলসের যত্নআত্তি করার ঝক্কি কম নয়। অল্পেই দাগ পড়ে যায়। পারিবারিক বাসা কিংবা যে বাড়িতে পোষা প্রাণী আছে, সেখানে তা ব্যবহার না করাই ভালো। ব্যাচেলর প্যাডে রাখা যেতে পারে। মোদ্দাকথা, লাইফস্টাইলের সঙ্গে খাপ খাইয়ে ফ্লোর নির্বাচন করাই শ্রেয়। স্থপতিরা এ কারণেই নকশা তৈরির আগে গ্রাহকের যাপিত জীবন সম্পর্কে জানতে চান।
কালোর ওপর সোনালি রং ফোটে। সাদাতের ঘরের কিছু আসবাব তাই সোনারঙা। পিতলে তৈরি জিনিসপত্র আছে। এই ধাতুর চকচকে ভাব ধরে রাখা কষ্টের। সপ্তাহান্তে বিশেষ যতেœর প্রয়োজন। মাস গেলে পলিশ। পিতল ছাড়াও সাদাতের ঘরের আসবাবগুলো কাচ ও স্টিলের। বসার ঘরে মার্বেলের চৌকো টেবিল। ওজনদার, তাই নাড়ানোর উপায় নেই। এই পাথরের আসবাবের বিশেষ যত্নআত্তি লাগে। ব্যবহারেও সজাগ থাকতে হয়। এখানে পানি জাতীয় কিছু রাখলে দাগ পড়ে যায়। যেখানেই মার্বেল আছে, সেখানেই কোনো গ্লাস কোস্টার রাখা উচিত। লাইফস্টাইলের সঙ্গে না মানালে মার্বেল এড়িয়ে চললেই ভালো হবে। একা মানুষের বাসায় এমন জিনিসপত্র রাখা যেতে পারে।
ঘরের সাজে যা-ই থাকুক, পর্যাপ্ত আলোর ব্যবস্থা না থাকলে সবই ফিকে হয়ে যায়। বাসায় দারুণ অ্যামবিয়েন্স আনতে আলোক ব্যবস্থাপনার বিকল্প নেই। হোটেলে আলো-অন্ধকারের বিশেষ মেলবন্ধনে অতিথিদের মুগ্ধ করার ব্যবস্থা থাকে। সেটা বাড়িতেও করা সম্ভব। তবে অনুকরণ না করাই ভালো। তাতে হোটেল ও বাসার মধ্যে ফারাক থাকবে না। মেঝে ও দেয়ালের সন্ধিস্থলে নকশা অনুযায়ী বাতি এঁটেছেন সাদাত। সেখান থেকে মৃদু আলো সিলিংয়ে পড়ে। মনোরম আবহ তৈরি হয়। উপরে গ্যালারি লাইটও আছে। প্রয়োজনে তা ব্যবহার করেন।
দেয়াল সাজাতে পেইন্টিংসের বিকল্প কী! তবে বাসস্থানে ছবির আধিক্য দেয়ালের সৌন্দর্যের ভারসাম্য নষ্ট করে। তাতে দৃষ্টিদূষণ হয়। ঘরের এখানে-সেখানে স্কাল্পচার রাখলে চলাচলে ব্যাঘাত ঘটতে পারে। তাই এসব ব্যবহারের ক্ষেত্রে পরিমিতি বোধের পরিচয় দিতে হয়। সাদাত তা-ই করেছেন।
ঢাকার পরিবেশ ধূলিময় থাকার কারণে যেকোনো বাসায় দুর্গন্ধ হতেই পারে। পরিত্রাণ পেতে ব্যবহার করা যেতে পারে ডিফিউজার ও সুগন্ধি মোম। সাদাত এ ক্ষেত্রে প্রাকৃতিক ফুলকেই প্রাধান্য দিয়েছেন। কিছু কিছু জায়গায় তাজা ফুল রেখেছেন। মোম ও ডিফিউজার তো আছেই।
ব্যাচেলররা বিড়ম্বনা পোহান পোশাক নিয়ে। একটি আলমারিতে গাদাগাদি করে কাপড় রাখলে তা শোভনীয় হয় না। ভাঁজ ভেঙে যায়। গন্ধও হয়। প্রতিদিন সকালেই পরিচ্ছন্ন পোশাক প্রয়োজন। তা যদি হাতের কাছেই পাওয়া যায়, দিনের শুরুটা ভালো হয়। কাপড়ের ধকল সামলাতে সাদাত নিজের শোবার ঘরের পাশেই করেছেন ওয়াক-ইন-ক্লোসেট। তাতে ঝকঝকে আয়না সাঁটানো। দেয়াল শুভ্র। হ্যাঙ্গারে ঝোলানো অসংখ্য শার্ট এবং স্যুট। খুঁজে পেতে সমস্যা হয় না। ব্যবহারের পর পুনরায় জায়গামতো রেখে দিলেই জামাকাপড় এলোমেলো হবে না। নতুন জামার আধিক্যে যদি ক্লোসেট ভরে যায়, তাহলে পুরোনো জামা সরিয়ে ফেলা জরুরি। অন্যথায় গাদাগাদি হতে পারে।
অতিথিদের আরামের জন্য সোফা বা কাউচ খুব জরুরি। সেখানে প্রয়োজনের তুলনায় বেশি কুশন রাখা যেতে পারে। বসার ঘরের নিচের অংশে সবচেয়ে আকর্ষণীয় জিনিস হচ্ছে একটি ক্ল্যাসিক গ্র্যান্ড পিয়ানো। যেটি পুরো কনটেম্পরারি লুকের মধ্যে ভিন্নতর।
নির্দিষ্ট সেলফে না রেখে অতিথিদের বসার স্থানে বই রেখেছেন সাদাত। যেন হাতের নাগালে তা পাওয়া যায়। পরিশেষে পাউডার রুম। এটির নকশাতেও আছে মুনশিয়ানা। কালো দেয়াল। টিস্যুও কালো। আয়নাটি সোনালি ফ্রেমে আঁটা। প্রতিবার ব্যবহারের সঙ্গে সঙ্গেই ভালোভাবে মুছতে হয়। নইলে পানি ছিটার দাগ বসে যায় আয়না ও কলের হাতলে। এতে জিনিসপত্রের দ্রুত অবচয় হয়।
সাদাত চৌধুরীর বাসার বৈদ্যুতিক সুইচগুলো সোনালি। ব্যাচেলর প্যাড সাজানোর বিষয়ে তিনি বলেন, ‘প্যাড সাজাতে গেলে অনেক থিমই পছন্দ হবে। সবকিছু একবারে করতে গেলে সুন্দর হবে না। বাসা সুন্দর করতে অনেক কিছু বদলানো লাগে না। ছোট ছোট কিছু বদল করলেই সৌন্দর্য ফুটে ওঠে। দরজায় যদি সুন্দর একটা হাতল যোগ করা হয়, সুইচবোর্ডে সুন্দর সুইচ ব্যবহার করা যায়, সেগুলো বাসার সৌন্দর্য বহুগুণে বাড়িয়ে দেবে। বেশি আসবাব না রাখাই ভালো। কম জিনিস থাকলে বাসা আরামদায়ক হয়। নতুন জিনিস কেনার পাশাপাশি পুরোনো জিনিস কমানোর কথাও মাথায় রাখতে হবে। কেননা, যত বেশি জিনিস তত বেশি ক্লিনিং, তত বেশি মেইনটেন্যান্স।’
সাদাত চৌধুরীর ব্যাচেলর প্যাডের সৌন্দর্য দর্শনেন্দ্রিয়কে সুখী করে তোলে। এই অন্দরসাজের পরিকল্পক তিনিই।
ছবি: সন্দীপ তালুকদার