এক্সক্লুসিভ ফিচার I সৌন্দর্যবিশ্বের সংকটমুক্তি
বিউটি ইন্ডাস্ট্রিও করোনাজনিত পরিস্থিতির শিকার। খোঁজা হচ্ছে উত্তরণের উপায়। কিছু মিলেছেও। লিখেছেন জাহেরা শিরীন
পৃথিবীর সবকিছুই বাঁধা পড়েছে সূক্ষ্ম এক জীবাণুর জালে। বিশেষায়িত সৌন্দর্যসেবা থেকে পণ্যসামগ্রী- সব খাতেই সংকট দেখা দিয়েছে। বিশ্বজুড়ে পিছিয়ে গেছে সৌন্দর্যপণ্যের উৎপাদন। কমে গেছে বিক্রিও। ৫৩২ বিলিয়ন ডলারের বিউটি ইন্ডাস্ট্রি বিশ্বের অন্যান্য শিল্প খাতের মতোই করোনাভাইরাসের শিকার।
আশঙ্কার ব্যাপার হচ্ছে, সৌন্দর্যশিল্পে এ মহামারির ফলে সৃষ্ট ক্ষতির প্রভাব তুলনামূলকভাবে বেশি। করোনা ও বিউটিফিকেশন অনেকটাই বিপরীতমুখী। ভাইরাসটি সংক্রমণের প্রধান কারণ স্পর্শ। অন্যদিকে সৌন্দর্যচর্চার পুরোটাই স্পর্শনির্ভর। মেকআপ, ম্যানিকিউর, ফেশিয়াল, স্পা কিংবা থ্রেডিংয়ের মতো একেবারে সাধারণ সেবাও স্পর্শহীনভাবে প্রায় অসম্ভব। যেখানে নিজের হাত দিয়ে নিজের চোখ, মুখ ও নাক স্পর্শ করায় কঠোর বিধিনিষেধ রয়েছে, সেখানে সৌন্দর্যসেবা কর্মীদের কাছে ঘেঁষতে দেওয়াও ঝুঁকিপূর্ণ। সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখাকে উৎসাহিত করা হচ্ছে বিশ্বজুড়ে। অনেক দেশই এখন লকডাউনের আওতাধীন। ফলে সাময়িকভাবে বন্ধ করে দিতে হয়েছে পার্লার, স্যালন আর বিউটি স্টোরের মতো সৌন্দর্যসেবা প্রতিষ্ঠানগুলো। যেগুলো খোলাও আছে, সেসবের দিকে খুব কম ভোক্তাই যাচ্ছেন। বিকিকিনি মন্দা। কর্মহীন হয়ে পড়েছেন বিউটি ইন্ডাস্ট্রির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সেবাকর্মী, মেকআপ আর্টিস্ট, হেয়ারস্টাইলিস্টরা। ফলে এ শিল্পে বিলিয়ন ডলারের প্রভাব পড়ছে। করোনা-আতঙ্কে অনিশ্চয়তার মুখে এখন বিশ্বের জনপ্রিয় সব ব্র্যান্ড, সার্ভিস সেন্টার তথা পুরো ইন্ডাস্ট্রি। ঝুঁকির মুখে পড়েছে ছোট প্রতিষ্ঠান ও ফ্রিল্যান্সাররা। শুট, ছোট-বড় ইভেন্ট বন্ধ হয়ে যাওয়া এবং পিছিয়ে যাওয়ার কারণে প্রায় কর্মহীন দিন কাটাচ্ছেন অনেকেই।
কসমেটিক রিটেইলাররা তাদের ব্যবসা গুটিয়ে নিয়েছেন সাময়িকভাবে। সৌন্দর্য-সচেতনদের মধ্যে দুই-তৃতীয়াংশ মানুষ এই মুহূর্তে ব্র্যান্ডগুলোর নতুন পণ্য লঞ্চের ব্যাপারে একদমই আগ্রহী নন। তাই বেশির ভাগ প্রতিষ্ঠান লোকসান সত্ত্বেও পিছিয়ে দিয়েছে তাদের নতুন পণ্যের বাজারজাতকরণ। জরিপ বলছে, হাইএন্ড ব্র্যান্ডের মেকআপ আর সৌন্দর্যচর্চার নানা পণ্য থেকে ইতিমধ্যেই ভোক্তা মুখ ফিরিয়ে নিতে শুরু করেছে। বাজারে বিক্রি বেড়েছে ডাভ, মেবলিন, নিউট্রিজিনা, কেটাফিল আর ইএলএফের মতো ব্র্যান্ডগুলোর। কারণ, এগুলো সাশ্রয়ী। বাজেট ফ্রেন্ডলি সেলফ কেয়ারের দিকেই এখন ক্রেতাদের ঝোঁক। পিছিয়ে গেছে সৌন্দর্যসংক্রান্ত বড় বড় সব ট্রেড শো। এগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য দ্য ন্যাচারাল প্রোডাক্ট ট্রেড শো। এই ইভেন্ট বাতিল হওয়ায় ভন্ডুল হয়ে গেছে ৩৫০০ এক্সিবিটর আর ৮৬ হাজার সৌন্দর্য-অনুরাগীর এক ছাদের নিচে একত্র হওয়ার পরিকল্পনা। এখন তো বটেই, বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা করছেন বিপদ বাড়বে সামনের দিনগুলোতেও। লকডাউট সৃষ্টিশীল করে তুলছে বাসায় বসে থাকা মানুষদের। আত্মনির্র্ভরশীলও। যারা পার্লারে সেবা নিয়ে অভ্যস্ত, তারাও ইন্টারনেটে জেনে নিতে পারছেন বাসায় বসে নিজেই কীভাবে সেরে নেওয়া যায় আপাদমস্তক সৌন্দর্যচর্চা। চলছে পুরোদস্তুর প্র্যাকটিস আর লুক নিয়ে নানান নিরীক্ষা। বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা করছেন, ভবিষ্যতে সবকিছু স্বাভাবিক হতে শুরু করলে বিউটি স্যালন বা পার্লারের ওপর মানুষের নির্ভরশীলতা কমে যেতে পারে। সেই সঙ্গে সচেতনতা অথবা শঙ্কা থেকে হয়তো অনেকেই সার্ভিস প্রোভাইডারদের সংস্পর্শে যেতে দ্বিধায় থাকবেন। যেসব সৌন্দর্যচর্চা মানুষ বাসায় বসে করতে পারবেন, পার্লারের সার্ভিস লিস্ট হারাতে শুরু করবে সেই সেবাগুলো। বিপদে পড়তে পারে বিউটি ইন্ডাস্ট্রি। তাই এখনই বোঝা যাচ্ছে না, ভাইরাসের উপদ্রব শেষে ক্লায়েন্টরা কীভাবে বিউটি শপিং সারবেন। সেবা প্রতিষ্ঠানগুলোও-বা কীভাবে সেবা দেবে ক্লায়েন্টদের। তবে এসব সমস্যা সমাধানে ইতিমধ্যেই নানা উপায়ের খোঁজ শুরু হয়ে গেছে বিশ্বব্যাপী বিউটি ইন্ডাস্ট্রিজুড়ে।
এই দুর্যোগকালে অনেকে ব্যবসায়িক কার্যক্রম চালানোর জন্য বিকল্প পথ বেছে নিচ্ছেন। সরাসরি সেবার সুযোগ নেই। সে ক্ষেত্রে ক্লায়েন্টদের সঙ্গে যোগাযোগ ধরে রাখতে ডিজিটাল মাধ্যম বেছে নেওয়া হচ্ছে। ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম, ইউটিউব আর টিকটকের মতো সোশ্যাল ওয়েবসাইটগুলোর ব্যবহার বেড়েছে। চিত্তাকর্ষক ও প্রাসঙ্গিক সব পোস্ট দিয়ে ভোক্তার মনোযোগ আকর্ষণের চেষ্টা চলছে। বিভিন্ন ধরনের লুক থেকে রূপচর্চার নানা কৌশল দিয়ে ভিডিও আপলোড করার প্রবণতা বেড়েছে। বিউটি প্রফেশনালরা অনলাইন কোর্স চালু করেছেন। নামমাত্র অর্থের বিনিময়ে এসব কোর্স করে নেওয়া সম্ভব হচ্ছে পৃথিবীর যেকোনো প্রান্ত থেকে, ঘরে বসেই। আগ্রহীদেরও সংখ্যা বাড়ছে। সামান্য হলেও ব্যক্তিগত অর্থনৈতিক অবস্থা সামাল দিতে এটি ভালো একটি উপায়। নতুন বিউটি প্রোডাক্টে আগ্রহী না হলেও এ-সংক্রান্ত অজানা সব কৌশল আয়ত্ত করতে সৌন্দর্যসচেতনদের ঝোঁক বেড়েছে। বিভিন্ন ধরনের মেকআপ প্রোডাক্টের অ্যাপ্লিকেশন কিংবা ব্রাশ পরিষ্কারের সহজ পদ্ধতি- সবেতেই তারা সমান উৎসাহী। ফলে ব্র্যান্ডগুলো ডিজিটাল উপস্থিতি বাড়াতে মনোযোগী। ওয়েবিনার, লাইভস্ট্রিম, চ্যাট, আইজিটিভির মাধ্যমে অনলাইন ইভেন্ট তৈরি হচ্ছে অহরহই।
এ ছাড়া কসমেটিক রিটেইলাররা কর্মী এবং ক্লায়েন্টদের স্বাস্থ্য সুরক্ষায় স্টোর বন্ধ করে দিলেও চালু রেখেছেন অনলাইন সেবা। অনেকে বিক্রিও করছেন। ফ্রি ডেলিভারি আর শিপিং সুবিধাও রয়েছে।
বেশির ভাগ বিউটি স্টোর এখন বন্ধ। তবে সেফোরা আর আল্টার মতো শীর্ষস্থানীয় প্রতিষ্ঠানগুলো বিশ্বজুড়ে গুটিকয়েক স্টোর খোলা রাখলেও বন্ধ করা হয়েছে স্যাম্পল ট্রেস্টিং। বিকল্পে প্রথম থেকেই কোম্পানিগুলোর অনলাইন টুল আর ভার্চ্যুয়াল বিউটি অ্যাপের সাহায্যে পণ্য বেছে নেওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। ক্রিশ্চিয়ান দিওর, জিভাঁশির মতো নামীদামি ব্র্যান্ডগুলো বিনা মূল্যে বিতরণের জন্য তৈরি করেছে হ্যান্ড স্যানিটাইজার। প্যারিসের বিখ্যাত সুগন্ধি তৈরির প্রতিষ্ঠানগুলোও এ কাজে এগিয়ে এসেছে।
বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশের বিউটি ইন্ডাস্ট্রিও এই দুর্যোগকালের শিকার। যার সরাসরি প্রভাব পড়েছে ৫০০ কোটি টাকার সৌন্দর্যসেবা প্রদানকারী খাতে। দেশের প্রায় ১৫ হাজার পার্লার, স্যালন এবং সৌন্দর্যপণ্য বিক্রি বন্ধ হয়ে গেছে। বিপণিবিতান বন্ধ থাকায় কাজ হারাতে বসেছে প্রায় দেড় লাখ মানুষ।
ফলে হুমকির সম্মুখীন ১ হাজার ৫০০ কোটি টাকার কসমেটিক ও টয়লেট্রিজ খাতও। যার মধ্যে ৯০০ কোটি স্থানীয় আর ৬০০ কোটি টাকা আমদানি করা পণ্যের মূল্যমান। জরিপ বলছে, সাবান, শ্যাম্পুর মতো জরুরি নিত্যব্যবহার্য পণ্য বাদে স্বাভাবিক বিক্রি কমেছে বেশির ভাগ পণ্যের। তবে অনলাইন বিউটি স্টোরগুলোর অনেকেই এখন সৌন্দর্যপণ্য পৌঁছে দিচ্ছে ক্রেতাদের হাতে। বাজার সচল রাখতে অবলম্বন করা হচ্ছে নানান কৌশল। মূল্য ছাড়, ফ্রি ডেলিভারি ছাড়াও ক্রেতাদের মনোযোগ আকর্ষণের জন্য অনেক প্রতিষ্ঠান সোশ্যাল মিডিয়ায় সরব হয়ে উঠেছে। পণ্যের প্রচারের পাশাপাশি সৌন্দর্যসংক্রান্ত গুরুত্বপূর্ণ সব কনটেন্ট ও ভিডিও আপলোড করার হার বেড়েছে।
এখনই চরম আর্থিক সংকটে সৌন্দর্যসেবা প্রতিষ্ঠান, এ-জাতীয় পণ্য ব্যবসায়ী, আমদানিকারক এবং এই সেক্টরের সঙ্গে জড়িত উদ্যোক্তারা। ভবিষ্যতে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলেও সংকট সামলে উঠতে জটিলতা দেখা দেবে। সে ক্ষেত্রে ৫ এপ্রিল প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য আশা জাগিয়েছে। তিনি ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের জন্য বিশেষ তহবিলের কথা জানিয়েছেন। যা থেকে প্রদত্ত ঋণের সুদের হার ৯ শতাংশ হলেও সরকার ৫ শতাংশ ভর্তুকি হিসেবে প্রদান করবে। বাকি ৪ শতাংশ উদ্যোক্তারাই দেবেন।
ছবি: ক্যানভাস